আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
যাত্রার আগে গাণ্ডীব ধনু আর অক্ষয় তূণীর বিসর্জন দেবার সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন গভীর মনঃকষ্টে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। এ কষ্ট, নিরাপত্তাহীনতা তার কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে। যখন থেকে সামান্য ব্যাধের হাতে পরমসখা যাদবকুলচূড়ামণি কৃষ্ণের মৃত্যুর খবর শুনেছেন, তখন থেকেই বেদনার থেকে ভয়টাই বড় হয়ে উঠেছে। তা সত্ত্বেও দ্বারকায় গিয়ে দস্যুদের হাত থেকে কুলকামিনীদের রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। অসহায় ক্রোধ আর গ্লানির সঙ্গে অনার্য দস্যুদের হাতে যাদবকুলের লাঞ্ছনা আর উৎকৃষ্ট রমণীদের অপহরণ দেখতে হয়েছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় গমন করছে দেখে নিষ্ফল আক্রোশে মাথা কুটেছেন। গাণ্ডীব শরাসন ধারণ করেও তাদের পরাস্ত করতে পারলেন না। বাহুতেও যেন বল নেই। যে সমস্ত অস্ত্রের জন্য অর্জুন এতকাল অনায়াসেই শত্রু দমন করতে পারতেন বিস্মৃতির গাঢ় তমসায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সেই সব দিব্যাস্ত্র।
আর আজ নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় পথের ধারে পড়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন মহাকাব্যের মহাবীর। আচমকা কার হাতের ধাক্কায় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন কৃষ্ণবর্ণের এক বালক। দেখে মনে হয় নিম্নবর্ণের— ব্যাধ, নিষাদ, কীরাত শ্রেণির। অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন— কে তুমি বালক? এই জনহীন মৃত্যু উপত্যকায় কী করছ?
বালকের মুখে ব্যঙ্গের হাসি— আমাকে চিনতে পারছ না?
অর্জুন বিস্ময়ে প্রায় বুজে আসা চোখ খুলে বললেন— না তো, আমরা কি পূর্বপরিচিত?
—এতদিনের কথা যে তুমি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছ। আমরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম।
সে তার ডান হাতের তর্জনী তুলে ছিন্ন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো মাত্র অর্জুনের মনে পড়ে গেল নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য।
একলব্যের গলায় তীব্র ঘৃণা— তুমিও রাজপুত্র আমিও রাজার কুমার। বর্ণ ছাড়া আমরা সমগোত্রীয়। আমার সঙ্গে তোমার ব্যবহার কি রাজোচিত হয়েছিল?
বালক হলেও অর্জুন তার কথায় ভীত হয়ে বললেন— আচার্য দ্রোণ গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন তোমার কাছে। এরজন্য আমাকে দোষারোপ করছ কেন?
—নিজেকে বাঁচাবার বৃথা চেষ্টা কোরো না। সবাই জানে দ্রোণের কাছে নির্জনে নাকে কান্না কেঁদেছিলে তুমি। তোমার থেকেও শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরের সন্ধান পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। গুরুদেব কি কখনও প্রিয় শিষ্যের মলিন মুখ সহ্য করতে পারেন? ফলে আমার সবথেকে জোরের জায়গাটাকেই গুরুদক্ষিণা দিতে হল। তোমাদের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের জোট আমার শরক্ষেপণের পরীক্ষা নিয়ে আগের মতো জোর নেই দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় নিয়েছিলে সেদিন।
অন্তরের দোলাচল চেপে অর্জুন জিজ্ঞেস করল— সেই ঘটনা স্মরণ করে তুমি আজ এসেছ প্রতিশোধ নিতে?
একলব্য অট্টহাস্য করে বলল— পাগল। মরার গায়ে খাঁড়ার ঘা দেওয়া তোমাদের একচেটিয়া। চিরকাল দুর্বলের ওপর জোর খাটিয়েই তোমরা রাজা। আমাকে তো তবু প্রাণে মারনি। বেশ আটঁঘাট বেঁধে যাদের হত্যা করেছ, যারা তোমাদের উন্নতি অগ্রগতির জন্য প্রাণ দিয়েছে ওই যে তারা আসছে দলে দলে দেখ—
একলব্যের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল দূরে অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, নাগ তাদের দগ্ধ,অর্ধদগ্ধ শরীরে তুষারে ঢাকা পথ ধরে এগিয়ে আসছে।
অর্জুন বিস্মিত ভীত কণ্ঠে বললেন— যুদ্ধে অনেক হত্যা করেছি, কিন্তু সে তো ক্ষত্রিয়ের পরম কর্তব্য। মারি অরি পারি যে কৌশলে, কিন্তু এই নিরীহ নিরস্ত্র প্রাণীদের বধ করেছি বলে তো মনে পড়ে না।
একলব্য তিক্ত হেসে বলল— একদম বিস্মরণ তাই না? খেলার ছলে তুমি আর তোমার প্রিয় সখা খাণ্ডব বন দগ্ধ করেছিলে মনে নেই।
—সে তো পরম পবিত্র অগ্নিকে রক্ষা করবার জন্য। অতিরিক্ত ঘি সেবনে অগ্নির ক্ষুধামান্দ্য রোগ হয়েছিল, তার নিরাময়ের জন্য পশুমাংসের প্রয়োজন হয়েছিল।
—শুধু যদি পশু হত্যা করতে সেটা বিশ্বাস করা সম্ভব হতো। রাজারা চিরকাল মৃগয়ায় যায় তার জন্য এত আটঘাট বাঁধার দরকার হয় না।
অর্জুন প্রতিবাদ করে কিছু বলবার চেষ্টা করতেই একলব্য তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল— এখানেও সেই উচ্চবর্ণের জোট। তোমরা চাইছিলে নতুন রাজধানী খাণ্ডবপ্রস্থের রাজ্যসীমা বাড়াতে। ব্রাহ্মণরা চাইছিল, রাজাদের সাহায্যে নিজেদের ক্ষমতার সীমা বাড়িয়ে নিতে। মোটকথা ওই বনাঞ্চলটি তোমাদের দরকার। কিন্তু খাণ্ডববনবাসীরা যথেষ্ট শক্তি ধরে। ওই বনভূমি দখলের লড়াই চলছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু কিছুতেই আদিবাসীদের পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছিল না। তাই তোমরা ঠিক করলে এবার শুধু উচ্ছেদ নয় নির্বিচারে হত্যা করে শেষ করে দিতে হবে অরণ্যের শেষ প্রাণবিন্দু। অরণ্যের অধিকার ছাড়তে না চাওয়া খাণ্ডববনের অধিবাসীদের চরম শিক্ষা দিতে হবে।। মনে পড়ে তোমার সেইদিনের কথা? তোমরা খেলাচ্ছলে ধ্বংসে মেতেছিলে। সেই খেলার কত অস্ত্র। অগ্নি তোমার জন্য বরুণের থেকে চেয়ে নিয়ে এল গাণ্ডীব ধনু, অক্ষয় তূণীর, কপিধ্বজ রথ। যুদ্ধাস্ত্রে পূর্ণ বিশ্বকর্মার তৈরি চার ঘোড়ার রথ। কৃষ্ণ পেলেন সুদর্শন চক্র আর কৌমোদকী গদা।
অর্জুন বললেন— বিশ্বাস কর গ্রীষ্মের প্রখর তপন তাপ থেকে বাঁচবার জন্য আমরা সবাই রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে যমুনার ধারে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিনোদনই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। খাণ্ডবদাহন অগ্নির মস্তিষ্কপ্রসূত।
—অগ্নি নিজের হৃত পরাক্রম ফিরে পেতে চাইছিলেন। ব্রহ্মা চাইছিলেন দেবশত্রু অসুরদের শক্ত ঘাঁটি খাণ্ডববন ধ্বংস করতে। তোমরা চাইছিলে রাজ্যসীমা বাড়াতে— এই মণিকাঞ্চন যোগ হল বলেই তো এমন বিশাল বিপুল মারণযজ্ঞ সম্ভব হল। সেইদিনটা কল্পনা কর, একদিকে অগ্নিকে নিয়ে তুমি ও কৃষ্ণ হত্যাযজ্ঞের নীল নকশা তৈরি করছ। অন্যদিকে দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য পুরনারীরা ক্রীড়ামদে মত্ত। বিপুলনিতম্বা, পীনন্নোতপয়োধরা নারীদের বেণু বীণা মৃদঙ্গ সহযোগে সুমধুর সঙ্গীতসুধায় প্রকৃতি পর্যন্ত বিভোর। এই পটভূমিতে ন্যায় আর ঔচিত্যের আড়ালে নির্বিচার হত্যার ছক তৈরি হল । এই কালবেলায় অর্জুন নিজেই যখন মৃতপ্রায় কেন এই বালকটি অতীত খুঁড়ে তাঁর বেদনা আরও বাড়িয়ে চলেছে। মৃত্যুর আগেই এর হাতে মরণের মতো চরম অপমান যেন না ঘটে। অর্জুন এই কালান্তক বালকটির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য চারদিকে তাকিয়ে আড়াল খুঁজলেন।
একলব্য তাঁর মনের কথা বুঝে ফেলে বলল— আমার থেকে পালালেও নিজের মৃত্যুর আগে একবার তোমার স্মৃতিতে ফিরে আসুক সেইসব হতভাগ্যেরা।
—কিন্তু সবাইকে তো হত্যা করা হয়নি।
আবার অট্টহাস্য করে ওঠে একলব্য।
—খাণ্ডববনের চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। সেই অগ্নিজাল থেকে ছেলেকে বাঁচাবার জন্য নাগরাজ তক্ষকের ছেলে অশ্বসেনকে তার মা গিলে ফেলেছিল। কিন্তু তোমার নজর এড়ানো কী সোজা কথা? তুমি সেই মায়ের মাথা কেটে ফেলেছিলে তীক্ষ্ণ অস্ত্রে। তোমার পলকের অন্যমনস্কতায় একমাত্র অশ্বসেন পালিয়ে বেঁচেছিল। আর চারটি মাত্র পাখি। নয়তো চারদিকে হাজার হাজার জনের আর্ত চিৎকারেও তোমার মন গলেনি। নারী পুরুষ বাছবিচার করনি। শিশু থেকে বৃদ্ধ রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছ অজস্র ধারে। রক্ত মেদ মজ্জায় পিছল হয়ে গিয়েছিল খাণ্ডববনের মাটি। এতটাই নিষ্ঠুরতা ছিল তোমাদের আচরণে। এদিকে ময়াসুরের আবেদনে গলে গেলে একেবারে? তুমি কী ভাবছ তোমার মতলব বুঝিনি? বাকিদের তো তোমার দরকার নেই কিন্তু এই অসুরটিকে তোমাদের প্রয়োজন। ত্রিভুবনে তুলনাহীন এক রাজসভা গড়ে তুলবে ময়দানব যা ভবিষ্যতে প্রবাদে পরিণত হবে। ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের অতুল কীর্তির কাহিনি ছড়িয়ে যাবে দেশে বিদেশে।
—দুর্গতকে রক্ষা করে প্রতিদান চাওয়া ক্ষত্রিয়ের স্বভাববিরুদ্ধ। আমিও চাইনি।
—উপযুক্ত মুখপাত্র থাকতে তুমি নিজমুখে চেয়ে জাত খোয়াবে কেন? ধরে নিলাম দৈত্যকুলের বিশ্বকর্মা বিখ্যাত স্থপতি ময়াসুরের নাম তুমি জানতে না। কিন্তু প্রাণভয়ে সে নিজের পরিচয় দেবার পর তো জানলে তখনই সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র সংবরণ করলে। কেন? ওই বধ্যভূমিতে আর তো কারওকে দয়া করনি। তারপর সে যখন প্রতিদান দিতে চাইল ভালোমানুষ সেজে পাঠিয়ে দিলে তাকে কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণের বেশি সময় লাগেনি কৃতজ্ঞতা আদায় করে নিতে। ময়াসুরের রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তারপর তোমরা গেলে যুধিষ্ঠিরের কাছে। তিনি ময়দানবকে সম্মান জানিয়ে রাজসভা নির্মাণের অনুমতি দিলেন। ধর্মপুত্র, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কী জানতেন না কী পরিমাণ ধ্বংস আর ভস্মের ওপর শুরু হল নির্মাণ কার্য। কতটা আতঙ্ক আর ঘৃণা মিশে গেল তার স্ফটিকের সভাগৃহে। সব জানতেন।
পোড়া আধপোড়া শরীরগুলো ক্রমশ আরও কাছে এসে পড়েছে। আগুনের তাপে তাদের শরীর গলে গিয়েছে। চোখের মণি বাইরে ঝুলে পড়েছে। কেউ সন্তানকে কেউ বাবাকে ভাইকে জড়িয়ে ধরেই দগ্ধ হয়েছিল। তারা সেই অবস্থাতেই এগিয়ে আসছে। হাজার হাজার পাখি পোড়া ডানা, চোখ, পা নিয়ে ঘষটে ঘষটে চলেছে। এই হিমশীতল ভূমিতে তৈরি হয়েছে মায়া জলাশয়। ভয়ঙ্কর তাপে তার জল ফুটছে টগবগ করে। রাশি রাশি মাছ, কচ্ছপ মরে ভেসে উঠেছে। গায়ে আগুন ও রক্ত নিয়ে ছোটাছুটি করছে যক্ষ রক্ষ মানুষ পিশাচ আর মনুষ্যেতর আরও হাজার প্রাণী। তারা সংখ্যায় এত যে দিকচক্রবাল রেখা ঢেকে গিয়েছে। রক্তে ভেজা কর্দমাক্ত পথ ধরে তাদের দীর্ঘ মিছিল আসছে তো আসছেই।
একলব্য ক্রূর হেসে বলল— চামড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছ? তোমার আর তোমার প্রিয় সখার আগুন খেলার ফল।
অর্জুন জীবনেও এত ভয় পাননি। কতবার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু এমন অসহায় কখনও বোধ করেননি। এক অনার্য বালকের অপমানের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে পারছেন না ভুবনজয়ী বীর— এ কী গভীর কলঙ্ক। যে বংশধরদের হাতে রাজ্যভার দিয়ে এলেন এত রক্তপাতে পাওয়া সেই রাজ্য চলে যাবে নিম্নবর্ণের হাতে, এভাবে অপমান করে যাবে ব্যাধের ছেলে এ কি কোনওদিন কল্পনাও করেছিলেন? অর্জুনের চোখ থেকে মুক্তোবিন্দুর মতো অশ্রু টপটপ করে ঝরে পড়ল। তিনি তা গোপন করার জন্য মুখ ডুবিয়ে দিলেন নরম তুষারে। প্রিয় সখার মুখ ভেসে উঠল মানসপটে। ঘোর বিপদে যে শঙ্খচক্রগদাধারী পুরুষ তার রথের সম্মুখভাগে বিরাজ করতেন, যিনি ছিলেন শত্রুর ত্রাস ও মিত্রের পরম সহায় এ ঘোর বিপদে তিনি কোথায়? যাঁর অভয়বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্লীবতা ত্যাগ করে মুক্ত চিত্তে স্বজন গুরুজন বধে দ্বিধা করেননি, মৃত্যুর আগে তাঁর বরাভয় হাতখানির জন্য অর্জুনের মন শিশুর মতো কেঁদে উঠল। তুষারে মুখ গুঁজে অর্জুন সেই শ্রীমুখের ধ্যানে মগ্ন হয়ে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করলেন।
হঠাৎ পিঠে কার করস্পর্শ! এ তো ব্যাধের ছেলের কর্কশ হাত নয়। অর্জুনের সমস্ত শরীরে শিহরন খেলে গেল? মুখ তুলে দেখেন সেই চতুর্ভুজ পীতাম্বর পুরুষ মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বরাবরের মতো চরম মুহূর্তে অর্জুনকে অভয় দিতে উপস্থিত। চারিদিক শান্ত। কৃতান্তের মতো ব্যাধবালক আর খাণ্ডববনের বিভীষিকা উধাও।
এতক্ষণ ধরে দেখা দুঃস্বপ্নের মুক্তিতে অর্জুন প্রিয় সখাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন বালকের মতো। কৃষ্ণ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন— কাঁদো কেন? আর কিছুক্ষণ বাদেই সব দুঃখ যন্ত্রণার অবসান-অক্ষয় স্বর্গবাস।
—সেটা ভেবেই তো এতদিন নিশ্চিন্ত ছিলাম। পৃথিবীতে যে ধর্মরাজ্য গড়ার জন্য যুদ্ধ করেছি সারাজীবন তা অক্ষত থাকবে পুরুষানুক্রমে। আমাদের বংশধরেরা ক্ষমতা ভোগ করবে চিরকাল। কিন্তু কী দেখলাম? অচ্ছ্যুতের হাতে তোমার মৃত্যু, দ্বারকার সর্বনাশ। আমাকে অপমান করে গেল নিষাদ বালক। এইভাবে নিম্নবর্ণের হাতে তছনছ হতে দেখলাম আমাদের সাজানো বাগান। তাহলে কী লাভ হল জীবনভর সংগ্রাম করে?
অর্জুনের এত আকুলতা সত্ত্বেও চিরকালের সঙ্কটমোচন সখার মুখে প্রসন্ন হাসি। একহাত অর্জুনের কাঁধে অন্য হাতে বরাভয়।
অর্জুন বললেন— এই ভয়ানক দুর্দিনেও তোমার স্মিত প্রসন্ন মুখ দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।
—দুর্দিন বটে কিন্তু দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। চক্রবৎ ঘুরে ঘুরে আসে এই রকম বিদ্রোহ। আগেও এসেছে। পরেও আসবে। তবে এই দশা বেশিদিনের নয়। এই মহা ভারতে উচ্চবর্ণ যে ভাবে শক্ত হাতে ক্ষমতার রাশ ধরে রেখেছে, বিদ্রোহ দমন করে অধিকারের পরিসর বাড়িয়ে নিয়েছে অনুরূপ ঘটনাই ঘটবে পরবর্তীকালে। যুগ ভেদে তা অন্য চেহারা নেবে। কিন্তু এতবড় আশ্বাসেও অর্জুন নিশ্চিন্ত হন না। বলেন— আমার বিশ্বাস হয় না।
—তবে আর একবার বিশ্বরূপ দর্শন কর।
শ্রীকৃষ্ণ মুখ ব্যাদান করলেন। পলকের মধ্যে নিরন্তর বয়ে চলা কালস্রোতে অর্জুন ভেসে গেলেন। তিনি দেখলেন অরণ্য কেটে তৈরি হচ্ছে শহর অট্টালিকা প্রাসাদ। দলে দলে গৃহহীন দেশহীন কর্মহীন অভুক্ত শীর্ণ আবালবৃদ্ধবনিতা চলেছে শেষ সম্বল মাথায় নিয়ে। গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে নদীর ওপর গড়ে উঠছে বাঁধ। শস্যশ্যামল খেত জ্বালিয়ে কলকারখানা।
এই পৃথিবীকে অর্জুন চেনেন না কিন্তু কৃষ্ণের ক্রমাগত ধারাবিবরণীতে চিনে নিচ্ছেন হাজার হাজার বছর পরেও দমনের স্বরূপটিকে। ভারী খুশি হলেন ক্ষমতার কাছে দরিদ্র, সাধারণ মানুষ, ব্যাধ, শবর, শ্রমিক, অরণ্যচারী আদিবাসী একই রকম অসহায় আছে দেখে।
অর্জুন খানিকটা শান্ত হয়েছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন— একটি দু’টি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় তুমি হতাশ হয়েছ। এখন প্রত্যক্ষ করলে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রতাপ। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, অন্য নামে অন্য চেহারায় বীরভোগ্যা বসুন্ধরার দখল নিতে আমরাই আসব বারে বারে।
উত্তরসূরিদের জন্য ভূমি, ধনজন, সম্পদ অক্ষত আছে দেখে প্রশান্তচিত্তে চোখ বুজলেন অর্জুন।