আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
রিকশওয়ালার নাম নেত্র। নেত্রকে পিশাচ সাধু বলেন, তিনে নেত্র। তাকে দেখেই সেই কবে একদিন পিশাচ সাধু হুংকার দিয়েছিলেন, নেত্র তুই মহাদেব, তুই ব্যোম শঙ্কর! তোর তিন নম্বর চোখটা আছে কপালে। সেটা বন্ধ হয়ে আছে। অন্ধ হয়ে আছে। তোকে খুলতে হবে, ওপেন করতে হবে—।
নেত্র ঘাড় নেড়েছে। ব্যস! নেত্র সেই তিন নম্বর চোখের খোঁজেই পিশাচ সাধুর পায়ে পড়ে আছে। সে তার তিন নম্বর চোখটা ওপেন করতে চায়। একবার ওপেন করলেই সে মহাদেব। ব্যোম শঙ্কর! আর এ-জন্মের যাতনা তাকে ভোগ করতে হবে না। সারাদিন স্বর্গে থাকবে, নেশায় থাকবে! সুখ আর ভোগ!
পিশাচ সাধু বলেছেন— ‘নেত্র, তুই তোর তিন চোখে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল দেখতে পাবি। একটু চেষ্টা করে যা নেত্র, তুই তিনে নেত্র!’
নেত্র চেষ্টা করে। মন দিয়ে চেষ্টা করে কপালের বন্ধ চোখটি, অন্ধ চোখটি খুলতে। একদম বিফল হয়নি। কেউ না জানুক সে জানে। গাঁজার খুব ধুমকি হলে মনে হয় চোখটা চিড়িক চিড়িক করে খুলছে— মনে হয় স্বর্গে আছি! ধুমকিতে তার স্বর্গদর্শন হয়! ধুমকিতে উড়তে উড়তে তার সাধুবাবার কথা মনে পড়ে। সাধুবাবা তাকে ঠিক কথাই বলেছে, সে এক এক চোখে এক একটা জিনিস দেখবে। এই যেমন গাঁজা খেলেই মনে হয় তার ডানা আছে, ঊর্ধ্বাকাশে উড়ছে। আবার যেদিন যেদিন পিশাচ সাধুর কাছে বাংলা-প্রসাদ পায়, বাংলা-সেবা করে সেদিনই মনে হয় তাকে কেউ নীচের দিকে টানছে। এ কথা সে পিশাচ সাধুকে বলেছে। সাধুবাবা তার কথা শুনে থম মেরে থাকে। তারপর বিড়বিড় করে, ‘সাধন করতে হবে রে নেত্র এমনি এমনি হবে না, ওটা বিভ্রম!’
নেত্র বলে, ‘বাবা পেটে একটু জল পড়লেই পা দুটি কিলবিল করে। যেন আমার পুরো শরীল পাতাল প্রবেশ করবে।’
পিশাচ সাধু বলেন, ‘নেত্র বাংলা-সেবার পর পাতাল দেখতে পাস?’
‘দেখতে পাই না, তবে খুব লীচে, ধরিত্রীর গভভে কিছু যে এট্টা হচ্ছে বেশ টের পাই।’
‘গুড! গুড! তুই সাধন পথেই চলেছিস।’
নেত্র বলে, ‘বাবা সগ্গ আর পাতাল স্বল্প হলেও ঠাহর হল, এবার বাকি মর্ত!’
পিশাচ সাধু হাসেন, বলেন, ‘মর্ত তোর রিকশার চাকা। চাকাই সব। চাকাই সভ্যতা, চাকাই ধর্ম, চাকাই কর্ম! চাকাই টানছে! চাকাই গড়াচ্ছে। পাকে পাকে গোটাচ্ছে। পাকে পাকে ছাড়ছে!’
সেই নেত্রই রিকশর চাকা ঘুরিয়ে টেনে নিয়ে এসেছিল পিশাচ সাধু আর তার চার নম্বর বউ বঁড়শিকে। ওরা দারোগাবাড়ির ভেতরে সেঁধিয়ে যেতেই সে রিকশকে সেট করে সিটের ওপর দু ঠ্যাং তুলে ঘুমের আয়োজন করছিল। হাতে গাঁজার পুরিয়া। তাকে পাকড়াও করে নচে। নচে ভেতরে ডেকে নেত্রকে ফুল ট্যাঙ্কি বাংলা গিলিয়ে, ভরপেট ভাত-মাংস খাইয়েছে। নেত্র খুশ!
নেত্র খুশ হতেই নচে বলে, ‘নেত্র সুপারি নিবি।’
সুপারির মানে নেত্র ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। সে ভেবেছিল, বাবু তাকে মাংস-ভাত খাইয়ে এবার পান-সুপারি দিচ্ছে। কিন্তু নচে বলল অন্য সুপারির কথা।
নচে বলল, ‘নে নেত্র তোকে আমি সুপারি দিলাম। রিকসো সুদ্দু পিশাচটাকে খালে উল্টে দে। পড়ার সময় বউটার হাত ধরে টেনে নিবি। ওই বুড়ো পিশাচটা পচা খালে ডুবে মরুক। ভামটা সবার সামনে বলল— আমার অপঘাত আছে। আমার অপঘাতে মিত্তু! আমি কি না নগদা নিয়ে মানুষ টপকাই। আরে আমি যা করি পার্টির অর্ডারে করি। পার্টিকে ভালোবেসে করি। তোমাকে ক্যাপ্টেন বলে রেসপেক্ট করি বলে— তুমি আমাকে ফাঁসিয়ে দিলে, আমার অপঘাত আছে। নেত্র পারবি? খালের ধারে নিয়ে গিয়ে শুদু রিকসোটা কাত করে দিবি। পিশাচটা মাল খেয়ে লাট হয়ে আছে। খালে পড়লে গপ গপ করে পাঁক খেয়ে খালাস হয়ে যাবে!’
নেত্র ঘাড় নাড়ে। এই ঘাড় নাড়ার মানে নচে জানে না— সেটা হ্যাঁ, নাকি না!
পিশাচ সাধু এটা একদম ঠিক কথা বলেনি। নচের যুক্তি সে যা করেছে— তা পার্টির জন্যে করেছে। তাকে কি না সবার সামনে হ্যাটা করল। দিনকাল ভালো না। ত্রিশ বছরের গভমেন্ট উল্টে যাবে মনে হচ্ছে, আর সে সময় বলল— তার অপঘাতে মিত্তু আছে। না, না, মুখ ফুটে এ-কথা বলা তোমার উচিত হয়নি। তুমি জানো তোমার মুখের বাক্যি ফলে যায়...। নচের কান্না পেল। বহুত দিন পরে তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যাদের জন্যে চুরি করল— তারাই বলছে চোর!
নচে বলল, ‘নেত্র, তুমি আমার ভাই। আমার থেকে তোমার বয়স কম। আমার চিমড়েপানা শরীর তাই আমার বয়স তোমার ঠাহর হচ্ছে না। আমি পাক্কা চল্লিশ। হাফপ্যান্ট পরা থেকে পার্টি করছি। আর আমাকে কি না সবার সামনে বলল— মার্ডার হবি।’
নচের দোসর গৌর।
গৌর বলল, ‘নেত্র, সুপারি নিয়ে নে। খালের ধারে নিয়ে গিয়ে রিকসোটা উল্টে দিবি। আমি স্কিম করে দিচ্ছি। রিকসোয় তোলার সময় ক্যাপ্টেনকে ডান দিকে বসাব। তোর খাল পড়বে ডাইনে। খালপাড়ের মোড়ের মাথায় যেখানে ভ্যাটটা আছে, ভ্যাটটা বাঁয়ে রেখে কাটিয়েই ডাইনে উল্টে দিবি। ক্যাপ্টেন টপকে যাবে। শালা দেখ, কার অপঘাতে মিত্তু! রিকসো ডানদিকে কাত হলেই ওই মেয়ে বুড়োর গায়ে পড়বে, তারপর আর দেখতে হবে না। বলো হরি হরি বোল!’
নেত্র ওদের দু’জনের কথাতেই ঘাড় নেড়ে দিল।
নচে বলল, ‘নেত্র, ওই পিশাচটা তোকে ডাকেনি। মেয়েছেলে নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে খেতে ঢুকে গিয়েছে। অথচ তোকে বলে— তুই ওর তিনে নেত্র। তোকে এক্সপ্লয়েড করে নেত্র। মেহনতি মানুষকে শোষণ করে। ওই পিশাচটা জমিদার। সামন্ততান্ত্রিক—!’
‘তান্ত্রিক’ কথাটা নেত্রর খুব মনে ধরল। অনেকের মুখেই সাধুবাবার নামে এমন কথা বলতে শুনেছে। তান্ত্রিক! সে উৎসাহে খুব জোরে জোরে ঘাড় নাড়ল। ঠিক কথা।
গৌর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘নেত্র, তোকে আমরা ঠকাব না। আমাদের এখানে খালপাড়ের বাসিন্দাদের লিস্টে তোর নাম ঢুকিয়ে দেব। তোকে গৃহহীন করে দেব। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে কাজ শুরু হলেই তুই একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যাবি। একটা ফ্ল্যাট কম কথা নয় নেত্র। তুই সুপারি নে, রিকসো উল্টে দে। আমরা তোকে সুপারি দিলাম।’
নেত্র ঘাড় নাড়ল। ঘাড় নাড়ার কী মানে কেউ জানল না।
ক্যাপ্টেন বের হতেই গৌর দৌড়ে এল। এসে রিকশর ডানদিকের গদি ঝেড়ে— বলল, ক্যাপ্টেন এদিকে বোসো। ক্যাপ্টেন গৌরের কাঁধে ভর দিয়ে রিকশয় উঠে বসল। বঁড়শিও টপ করে উঠে রিকশয় বসল। গৌর টিপে দিল নেত্রকে। বলল, ‘ক্যাপ্টেন ডানদিকে বসেছে নেত্র, কাজটা সেরে দিস।’
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এই গৌরা, নচে কই?’
‘নচে খুব টেনশনে পড়ে গেছে ক্যাপ্টেন। তুমি দুম করে বলে দিলে— ও মার্ডার হবে!’
ক্যাপ্টেন বুজে আসা চোখ টেনে বললেন, ‘আমি! আমি কখন বললাম— নচে খালাস হয়ে যাবে?’
নচে এগিয়ে এল, ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘তুমি বলোনি— তুই অপঘাতে মরবি! এটা ঠিক কথা হল? তুমি জানো তোমার মুখের কথা ফেলনা যায় না।’
নচের কথা উড়িয়ে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল বঁড়শি! ‘ঠাকুরপো, তুমি এই বুড়োর কথা ধরো না। উনি তো দিব্যচোখে দিন রাত দেখছেন— আমি এর সঙ্গে পালাচ্ছি, ওর সঙ্গে ভাগছি! কই ওর কথা ফলছে না। আমি তো ওর সঙ্গেই ঘর সংসার করছি।’
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘একদম ঠিক। শকুনের শাপে গোরু মরে না নচে! তোর কোনও ভয় নেই, তুই লড়ে যা।’
বঁড়শি একটু হাত বাড়িয়ে বলল, ‘মনে দুঃখ রেখো না ঠাকুরপো, তুমি এত যত্ন করে খাওয়ালে, তার বিনিময়ে কেউ অভিশাপ দিতে পারে—।’
কথা বলতে বলতে বঁড়শির হাতটা হয়তো নচের দিকে একটু এগিয়ে এসেছিল। ক্যাপ্টেন সটান সোজা হয়ে বসলেন। ‘এই মেয়ে— তুমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে নাকি! ও ব্যাটা কুমির! কুমিরের কান্নায় তোমাকে ভোলাচ্ছে। এই নেত্র চালা রিকশা।’
নেত্র কষে চাপ দেয় প্যাডেলে।
দাঁত কিড়মিড় করে নচে— ‘শালা, তোমার সুপারি নিয়েছে নেত্র। তুমি আর রাস্তা টপকে ব্রিজে উঠতে পারবে না, তোমার এই খালপাড়েই আজ পিশাচ জীবন খতম।’
গৌর বলল, ‘নেত্র সুপারি নিয়েছে, ও ঠিক কাজ সেরে দেবে!’
নচে বলল, ‘দুগ্গা! দুগ্গা!’
দু’জনের চোখের সামনে থেকে রিকশ নিয়ে লটরপটর করতে করতে নেত্র হাওয়া হয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ দোতলার বারান্দায় এসে বসল নচে আর গৌর। নীচের তলায় পরমেশ্বরকে ঘিরে হুল্লোড় চলছে। কমলের বাবাকে নকল করে জুয়ারি দেবু তখন আসর জমিয়ে দিয়েছে।
খালপাড়ে উঠল রিকশ। বঁড়শি বলল, ‘আপনি ধরে বসুন। বড্ড টলমল করছেন।’
‘টলমল করুক তোর বাপ!’ হুংকার ছেড়ে ক্যাপ্টেন সোজা হয়ে বসলেন। আর বসে বসেই দু’হাত তুলে দিলেন মাথার ওপর।
‘এ কী আপনি হাত ছেড়ে দিলেন কেন?’
ক্যাপ্টেন আদুরে বললেন, ‘ধরব না। তুই আমাকে ধরে থাক, ছিটকে যেতে দিবি না। আমি ছিটকে গেলেই তুই বিধবা!’
বিধবা শুনেই মুখ ঝামটা দিল বঁড়শি, ‘আপনি বড্ড বাজে কথা বলেন।’
নেত্র চিৎকার করে হুঁশিয়ারি দিল, ‘সাধুবাবা সামনে বেপদ! রিসকা ডাইনে হেলবে।’
বঁড়শি বলল, ‘আপনি নিতাই গৌরাঙ্গ হয়ে থাকবেন না, লোক রগড় দেখছে।’
‘লোক দেখুক, আমি বগলে করে কলাটা মুলোটা নিয়ে ফিরছি না। আমি হাত ছেড়ে দিয়েছি, কোনও কিছু ধরছি না।’
ভ্যাটকে বাঁয়ে রেখে নেত্র রিকশ কাটিয়ে নিয়ে চলল।
‘উঃ আপনাকে নিয়ে আর পারি না। হাত নামান বলছি—নইলে রিকশ থেকে আমি খালে ঝাঁপ দিয়ে মরব।’
কথাটা নেত্রর কানে যেতে সে ক্যাঁচ করে ব্রেক মারল। পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্বামী-স্তিরির ঝামেলি আপুনেরা এখানে মিটিয়ে নেন, আমার গাড়ি থেকে সুইসাইট করা যাবেনি।’
নেত্রর কথায় পিশাচ সাধু হো হো করে হাসলেন, বললেন, ‘নেত্র, তোর দু চোখই খোলেনি বাপ! তুই তিন চোখের স্বপ্ন দেখছিস। ওরে পাঁঠা এটা ঝামেলি নয় প্রেম! প্রেম পিরিত বুঝিস। আমি হাত ছাড়ব আর ও ধরবে। আমাকে জড়িয়ে ধরবে। ও ছাড়বে তখন আমি জাপটে ধরব। কী বলো বঁড়শি?’
বঁড়শি খিলখিল করে হাসল। বলল, ‘আপনি যতই বলেন, ওর চোখের সাটার খুলবে না। ও তিনে নেত্র নয়, তেচোখো মাছ! ওকে কেউ ছোঁবে না, আপনি ছুঁয়ে উদ্ধার করে দিয়েছেন।’
রিকশ আবার চলছে।
বঁড়শি বলল, ‘আপনি ইদানীং খুব বাড়তি কথা বলছেন!’
‘কোন কথাটা বাড়তি বললাম?’
‘ওই ছেলেটা কি আপনার ক্লায়েন্ট— বিনি পয়সায় ওর মুখ দেখে ভালো ভালো কথা বলে দিলেন? দিলেনই যদি তবে শর্ত দিতে পারতেন, আমার ভবিষ্যদ্বাণী ফললে হাজারএক টাকা প্রণামী দিয়ে যাবি।’
‘ধুসস শালা!’
‘ওই তো গরিবের কথা বাসি হলে মিঠে লাগবে। ভালো তো ওর হবে, আপনার কী হবে?’
‘আমার কিছু চাই না।’
‘ভালো বলে কিছু জুটবে না, কিন্তু খারাপ বলে নচের কাছে গাল খেলেন। অথচ ও আপনাকে ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন করে হেঁকে ডেকে খেতে দিল। মুখে এবার কুলুপ দিন। অনেক বিদ্যা ফলিয়েছেন। তাছাড়া সকলকে ঘরের কথা বলেন কেন?’
বোকা বোকা মুখ করে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘কই বললাম?’
‘বলেননি, সেজ বউটা আসে, এসে টাকাপয়সা, বাসনকোসন নিয়ে যায়—আপনি ঘরের কথা পরকে বলেন।’
ক্যাপ্টেন হাসেন।
‘হাসি নয়, আপনি খুব খারাপ মানুষ! সবার সামনে বললেন—এই মেয়ে বঁড়শি! হ্যাঁ, আমি বঁড়শি। আমাকে বঁড়শি করে টোপ সাজায় কে? আপনি টোপ গিলেছেন— তবে একবার গাল থেকে টোপ খোলার চেষ্টা করে দেখুন— আপনার আলজিব ছিঁড়ে নিয়ে যাব! আমার নাম বঁড়শি!’