উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
শুধু কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াই একমাত্র কারণ নয়। প্রকৃত কারণ গ্রাম। গান্ধীজি বলেছিলেন, ভারত বাস করে গ্রামে। সুতরাং শহর নয়, সকলেই বুঝে গিয়েছিল গ্রামীণ মানুষ যে প্রতীকের সঙ্গে নিজেদের আইডেন্টিফাই করতে পারবে, সেটি হল লাঙল। তাই সকলের দাবি লাঙল! কিন্তু লাঙল চিহ্ন সকলকেই দেওয়া যায় কীভাবে? সোশ্যালিস্ট পার্টি মিটিংয়ের মধ্যেই চিৎকার করে বলে উঠল আশ্চর্য ব্যাপার! কংগ্রেস তো চিরকাল চরকাকে নিজেদের দলের প্রতীক পরিণত করেছে, তারা এখন তাহলে লাঙল চাইছে কেন? কী ব্যাপার? আপনারা কী গান্ধীজীকে ভুলে যেতে চান? তাই গান্ধীজীর প্রিয় চরকা আর পছন্দ নয়? রাগী কন্ঠে জানতে চায় সোশ্যালিস্ট পার্টি। নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন ঠিক করলেন কাউকেই তাহলে লাঙল চিহ্ন দেওয়া হবে না। কারণ একটি দলকে দিলে অন্য দল ক্রুদ্ধ হবে। অতএব একটা সমাধান করতে হবে।
প্রত্যেককে দ্বিতীয় পছন্দ জমা দিতে বলা হল। আর সেইমতোই অবশেষে জওহরলাল নেহরুর কংগ্রেস পেল দু’টি বলদ, সোস্যালিস্ট পার্টি পেল গাছ, হিন্দু মহাসভাকে দেওয়া হল ঘোড়ায় চড়া এক সওয়ারি, বি আর আম্বেদকেরর শিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন পার্টি প্রতীক পেল হাতি। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া নিয়েছিল কাস্তে ধানের শিষ। ভারতীয় জনসঙ্ঘ পরবর্তী সময়ে পায় প্রদীপ। ফরওয়ার্ড ব্লক (মার্কসিস্ট) পেয়েছিল সিংহ। রাম রাজ্য পরিষদ নামে পার্টির প্রতীক ছিল উদীয়মান সূর্য, রেভলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি প্রতীক পেল মশাল, বলশেভিস্ট পার্টির ভাগ্যে গেল তারা। সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ হল, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা দলগুলির নেতারা এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকারের সঙ্গে। প্রবল নেহরু ও কংগ্রেস বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এই নেতাদের যোগ্যতাবলেই একটি সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন ও উন্নত মন্ত্রিসভা গঠনের তাগিদে জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এই নেতাদের প্রথম মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁরা কেউই ওই সরকারে থাকতে পারেননি। প্রত্যেকেই প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আগেই কোনও না কোনও ইস্যুতে মন্ত্রিসভা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে এসে নিজেদের দল গঠন করেন। ফলে ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচন হয়ে উঠেছিল একঝাঁক স্টেটসম্যানের মধ্যের তুমুল আদর্শগত লড়াইয়ের ময়দান। তবে, ১৯৫১ সালের জুলাই মাসে বিভিন্ন দলকে দেওয়া নির্বাচনী চিহ্নগুলির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল একটি চিহ্ন। সেটি হল হাত। আজ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের যে নির্বাচনী প্রতীক, সেই হাত চিহ্নটি প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ব্যবহার করেছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের একটি ভেঙে যাওয়া পৃথক গোষ্ঠীর পার্টি। সেই বিক্ষুব্ধ ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃত্বে ছিলেন শ্রমিক নেতা আর এস রুইকর। অথচ সেই লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেল, রুইকরের দল সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য ফলাফল করতেই পারেনি কোনও কেন্দ্রে। তাই ভোটের পরই সেই দল মিশে গেল জে বি কৃপালনির প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টিতে। আর সেই থেকে হাত চিহ্নটিও হয়ে গেল নির্বাচনের ময়দান থেকে ভ্যানিশ। ইন্দিরা গান্ধী আবার বহু বছর পর সেই হাত চিহ্নকে নিয়ে এলেন নিজের দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে। আশির দশকের শুরুতে সিপিএম তাদের দেওয়াল লিখনে ডাকিনীরূপী ইন্দিরা গান্ধীর ‘হাত’ থেকে রক্ত ঝরছে এরকম একটি প্রতীকী আক্রমণাত্মক প্রচার করতো নিয়ম করে।
১৯৫১ সালের নির্বাচনে প্রত্যেক দলকে প্রতীক ব্যবহার করে গোটা দেশে প্রচারের সুযোগ দেওয়া হলেও একথাও জানিয়ে দেওয়া হয় ভবিষ্যতে এই সুযোগ তখনই পাওয়া যাবে যদি মোট ভোটের ৩ শতাংশ অন্তত পায় কোনও দল। তার থেকে কম পেলে আর জাতীয় দলের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। পরবর্তীকালে মাত্র চারটি দল ওই পাস মার্ক অতিক্রম করতে পেরেছিল। নির্বাচনী প্রতীককে সকলে তো আর রাস্তায় নামাতে পারে না। কেউ কেউ পারে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের এক প্রার্থী পেয়েছিলেন উট নির্বাচনী প্রতীক। তাঁকে দেখা গিয়েছিল উত্তর কলকাতায় উটের পিঠে চেপে প্রচার করতে। আর সেই উটের গায়ে লাগানো থাকতো বড় এক পোস্টার যেখানে লেখা ছিল, ‘সমস্যা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ আজ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর মরুভূমিতে একমাত্র আপনাদের সাহায্য করতে পারে উট!’ কংগ্রেস পিছিয়ে রইল না। প্রতিটি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো গোরুর গায়েই লেখা দেখা যেত ‘কংগ্রেসকে ভোট দিন’। সুতরাং স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভা ভোটের সেই প্রথম গণতন্ত্রের পরীক্ষার দিন থেকেই নির্বাচনী লড়াইয়ের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র হয়ে উঠেছে নির্বাচনী প্রতীক। আজ এই ২০১৯ সালেও তাই।
এই তো অন্ধ্রপ্রদেশের কথাই ধরা যাক। রেজোল বিধানসভা কেন্দ্রের দু’জন প্রার্থী আছেন। দু’জনের নামই রাজেশ্বর রাও। সেটা তো হতেই পারে। ডামি ক্যান্ডিডেট নতুন কিছু নয়। সর্বত্র এই প্রচলন আছে। কিন্তু, এটা তো সবকিছু ছাপিয়ে গেল। কারণ, দু’জনের নামের পরই ব্র্যাকেটে একটা ডাকনাম লেখা। দু’টিই এক। বনথু। এখানেও শেষ নয়। তাঁদের একজনের নির্বাচনী প্রতীক সিলিং ফ্যান। আর অন্যজনের নির্বাচনী প্রতীক হেলিকপ্টারের চলন্ত ব্লেড। অর্থাৎ দেখতে দুটোই এক। এবার ভোটাররা কী করবেন? কোন রাজেশ্বর রাও কার ভোট পাবেন? এই তো মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রের কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন কমিশনে নালিশ করেছেন একটি পুকুরকে সম্পূর্ণ ঢেকে দিতে হবে। কারণ সেই পুকুরে ফুটে আছে অসংখ্য পদ্মফুল। বিজেপির সিম্বল। আর সেই নালিশ শুনেই বিজেপি পালটা কমিশন বলেছে ওই পুকুর যদি ঢেকে ফেলা হয় তাহলে সকলের হাতও কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কারণ হাত কংগ্রেসের প্রতীক! সেটা প্রকাশ্যে দেখানো চলবে না! দু’টি নালিশই অগ্রাহ্য করেছে কমিশন!
প্রথম গণতন্ত্রে স্বাদ কী এসেছিল ১৯৫১ সালের প্রথম নির্বাচনে? স্বাধীন ভারতের ক্ষেত্রে সেটা ঠিক। তবে তার আগেও ভারত প্রথম ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগটি পেয়েছিল ১৯২০ সালে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার মনে করল ভারতকে দায়িত্বপূর্ণ সরকার উপহার দেওয়া জরুরি। কিন্তু, ভারতের বিদেশসচিব এডউইন মণ্টেগু ওই টার্মটা একটু বদলে দিতে চাইলেন। তিনি মন্ত্রিসভাকে বললেন, একটা কাজ করা যাক। আমরা রেসপনসিবল গভর্নমেন্টের পরিবর্তে বরং বলব সেল্ফ গভর্নমেন্ট। সেটা শুনতে অনেক বেশি ভালো। তার জন্য দরকার ভারতের একটি রাজনৈতিক সংস্কার। ভারতে এসে সবথেকে বড় আঘাত তিনি পেলেন সেটি হল, নিজের দেশের ব্রিটিশ অফিসারদের ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা দেখে। তিনি দেখলেন, বিভিন্ন ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার নেই। ১৯১৮ সালের জুলাই মানে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের সঙ্গে মন্টেগুর একটি চুক্তি হল। সেটিকে মন্টেগু চেমসফোর্ড এগ্রিমেন্ট বলা হয়। সেখানেই স্থির হল শুধু কেন্দ্রীয় আইনসভা নয়, প্রাদেশিক বিধানসভার মাধ্যমে আরও বেশি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে ভারতে। দু’টি ভাগে বিভাজিত হবে প্রশাসনিক ক্ষমতা। রিজার্ভড। যাবতীয় অর্থনৈতিক, বিচারবিভাগীয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন গভর্নর (যিনি সর্বদাই একজন ব্রিটিশই হবেন) এবং তাঁর পরামর্শদাতারা। আর ট্র্যান্সফার্ড বিভাগের মধ্যে থাকবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্যচাষ ইত্যাদি। এই ভিত্তিতেই ভোট হবে। কিন্তু, ভোটার কারা হবে? আশ্চর্য এক সিদ্ধান্ত! আয় এবং সম্পত্তির নিরীখেই ভোটাধিকার নির্ধারণ করা হল। যার ফলে দেশের সিংহভাগ মানুষেরই ভোটাধিকার থাকবে না। যেমন, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে সাড়ে চার কোটি মানুষের বসবাস। সেখানে ভোটাধিকার পেলেন মাত্র ৫ লক্ষ। বম্বে প্রেসিডেন্সির সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে ভোটার হবেন মাত্র সাড়ে ৬ লক্ষ। সর্বোপরি গোটা দেশের নারী সমাজ এই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। এরকম সেল্ফ গভর্নমেন্টের গণতন্ত্র পরিণত হয়েছিল নিছক প্রতীকি এক প্রদর্শন। কারণ, ওই ১৯২০ সালেই কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন থেকেই মহাত্মা গান্ধী ডাক দিলেন অসহযোগ!
তাই প্রকৃত গণতন্ত্রের হাওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করল ১৯৫১ সালে। চারমাস ধরে সেই নির্বাচন হল। শীতকালে তো আর হিমাচলপ্রদেশ কিংবা হিমালয় পাদদেশের অন্য রাজ্যগুলিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই প্রথমেই ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর হিমাচল প্রদেশ থেকে শুরু হল স্বাধীন ভারতের প্রথম ভোটদান। এই ভোটগ্রহণ এরপর গোটা দেশে হবে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পর্যন্ত। ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও লন্ডন ইউনিভার্সিটির ছাত্র সুকুমার সেন নিযুক্ত হলেন দেশের নির্বাচন কমিশনার। একইসঙ্গে দেশজুড়ে ৫০০টির বেশি লোকসভা আসনে এবং চার হাজার বিধানসভা আসনে বুথ। ২০ লক্ষ ব্যালট বক্স। ভোটার তালিকা তৈরি আর টাইপ করার জন্য ১,৬৫,০০ জন্য ক্লার্ক নিয়োগ করা হল নির্বাচনের জন্য। ৫৬ হাজার প্রিসাইডিং অফিসার। ২ লক্ষ ৮০ হাজার সহায়ক। প্রায় আড়াই লক্ষ পুলিশ কর্মী। সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে একটি দেশ। এবং একদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তহীন সীমান্তযুদ্ধ। আর অন্যদিকে জলস্রোতের মতো উদ্বাস্তুর আগমন। এই প্রবল চাপে নেহরুর সবথেকে বড় ভরসা ছিলেন প্রচুর বাগবিতণ্ডা, মতান্তর থাকা সত্ত্বেও একজনই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। ভোটের ঠিক আগের বছর ১৯৫০ সালে সেই প্যাটেলের জীবনাবসান হল। নেহরুর পক্ষে তাই এই বিপুল প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা ছিল জীবনের সেরা চ্যালেঞ্জ। কারণ প্যাটেল নেই পাশে। ভোটগ্রহণ করতে হবে।
সকলের জন্য কী গণতন্ত্রের এই উৎসব সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল? মোটেই নয়। দেশীয় রাজারা ভয় পেয়েছিল। রাজ্য চলে যাওয়ার পর জমিও চলে যাবে সরকারের হাতে। এই ভয় ছিল। কারণ, কংগ্রেস জমিদার ও রাজাদের হাত থেকে জমি নিয়ে নেওয়ার একটি ঘোষণা করেছিল। আর তারই ফলশ্রুতি হল গুজরাতের সৌরাষ্ট্রে আবির্ভাব হল এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের। তার নাম ভূপত সিং। ৭০ টি মার্ডারের আসামী। একসঙ্গে চারজন রাজা ও জমিদার ভূপতকে অস্ত্র আর টাকা পয়সা দিয়ে নামালো বানচাল করার লক্ষ্যে। ভূপতের সঙ্গীরা বাছাই করা মাখওয়ান। তারা নিজেদের বলতো আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর বংশধর। সেই বাহিনী নিয়ে ভূপত গ্রামে গ্রামে ভয় দেখানো, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, অপহরণ ও খুন, জখম চালিয়ে গেল ১৯৫১ সাল থেকে। লক্ষ্য কেউ যেন ভোট না দেয়। ১৯৫১ সালের বিচারে ৫০ হাজার টাকা তার মাথার দাম ধার্য হল। জীবিত বা মৃত। কিন্তু, কার সাহস আছে ভূপত সিংকে ধরবে? গোটা সৌরাষ্ট্রের মানুষ তটস্থ। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সেই প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সবথেকে বড় গণতন্ত্রের জয়কে প্রমাণ করেছিল ওই সৌরাষ্ট্রের গ্রামবাসীরাই। ভূপত দস্যুর অত্যাচার আর ভয়কে অগ্রাহ্য করে তারা দলে দলে বেরিয়ে ভোট দেন। আর ৬টি লোকসভা আসনের সবকটি আসনেই জয়লাভ করে কংগ্রেস। ৫৫টি বিধানসভা আসনের ৫০টিতেই।
মাঠে ময়দানে রাস্তায় প্রচার হচ্ছে। কিন্তু, এসবের মধ্যেই এক আশ্চর্য প্রচারের সুযোগ পেয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। এই দলটির নির্বাচনী প্রচার পাওয়া যাচ্ছিল রেডিওতে। অল ইন্ডিয়া রেডিও নয়। মস্কো রেডিও! তাসখন্দের রেডিও স্টেশন থেকে মস্কো রেডিও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়ে প্রচারে নেমেছিল। কারণ, রাশিয়ার ধারণা ছিল নেহরু আমেরিকার খপ্পড়ে পড়েছেন। তাই ভারতে কমিউনিস্ট সরকার আসা দরকার। খবরের কাগজে নির্বাচনী সংবাদের একটি ইন্টারেস্টিং সংবাদ জায়গা করে নিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের খড়্গপুরে নেহরু এসেছিলেন প্রচারে। তাঁর ভাষণ শুনতে হাজির হয়েছিলেন প্রচুর মহিলাও। নেহরুর ভাষণের আগেই ওই ভিড়ে আগত এক তেলুগুভাষী মহিলার গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয় সভাস্থলেই। যন্ত্রণায় তিনি যখন ছটফট করছেন তখন তাঁকে ঘিরে দ্রুত অন্য মহিলারা ও সভায় থাকা অ্যাম্বুলেন্সের নার্স কাপড় দিয়ে একটি মেকশিফট লেবার রুম তৈরি করে ফেললেন খোলা আকাশের নীচে। নেহরুর ভাষণের মধ্যেই ওই মহিলার সন্তানের জন্ম হয়। প্রথম লোকসভা ভোটের একঝাঁক চমকপ্রদ কাহিনী লিখেছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’ গ্রন্থে। নেহরু কতটা জনপ্রিয় ছিলেন? অসমের এক প্রত্যন্ত গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধা মহিলা এসেছিলেন ভোট দিতে। কিন্তু, সেটা তিনি দিতে পারলেন না। তাঁকে ক্ষুণ্ণমনে ফিরে যেতে হয়। কারণ, নেহরু অসম থেকে প্রার্থী নন। তাই নেহরুকে তিনি প্রার্থী হিসাবে ভোট দিতে না পেরে আর কাউকেই না দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
কী ফলাফল হয়েছিল? ৪৮৯টি লোকসভা আসনে শেষ পর্যন্ত ভোট হয়েছিল। তার মধ্যে কংগ্রেস একাই জয়ী হল ৩৬৪টি আসনে। কিন্তু, কংগ্রেস ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে বিপুল ভোট-শেয়ার পায়নি। ৪৫ শতাংশ ভোট পেল নেহরুর কংগ্রেস। সবথেকে বড় যদি কোনও অঘটন হয় সেটি হল, বি আর আম্বেদকরের পরাজয়। খুব সাধারণ অপরিচিত এক কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে তিনি পরাজিত হলেন। এর কারণও স্পষ্ট। বম্বেতে নেহরু ছিলেন বিপুল জনপ্রিয়। ভারতীয় জনসঙ্ঘের তিনজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলা থেকে দুজন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর রাজস্থান থেকে উমাশঙ্কর ত্রিবেদি। চারটি আসন জিতেছিল হিন্দু মহাসভা। আর তিনটি আসনে জয়ী হয় রাম রাজ্য পরিষদ। এই তিন দল যেহেতু হিন্দুত্ববাদী আদর্শে বিশ্বাসী, তাই লোকসভার মধ্যে পরবর্তী সময়ে তিন দল একটি ব্লক হিসাবেই জোট গড়ে সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কংগ্রেসের ৩৬৪টি আসনের পর সর্ববৃহৎ পার্টি কারা ছিল? কমিউনিস্ট পার্টি অব ইণ্ডিয়া। তারা পেয়েছিল ১৬টি আসন। তারপর সোশ্যালিস্ট পার্টি। ১২টি আসন।
দেশজুড়ে গণতন্ত্রের উৎসব চলছে। ১৯৫১ থেকে ১৯৫২ সালে। প্রথম লোকসভা নির্বাচন। ঠিক তখন অন্যদিকে বাংলার চিত্রটি কেমন ছিল? ৭ অক্টোবর ১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর একটি সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে —বরিশাল, যশোর, ঢাকা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, রাজশাহী থেকে কখনও হলদিবাড়ি প্যাসেঞ্জার, কখনও সিরাজগঞ্জ প্যাসেঞ্জার, কখনও বা ঢাকা মেলে চেপে বার্নপুরে নামছে হাজার হাজার উদ্বাস্তু। চাঁদপুর, গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জের স্টিমারঘাটে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসা নর-নারী শিশুদের দল আটকে রয়েছে। কারণ, স্টিমার আর ট্রেনে আর জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাঁরা আসতে পারছেন না। হয় স্টিমারঘাটে, কিংবা স্টেশনে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটাচ্ছেন। ১৯৫১ সালের ১৬ জুলাই হাওড়া স্টেশনে হাউ হাউ করে কাঁদছেন ৫০টি পরিবার। তাঁদের ঘিরে ধরে রাখা হয়েছে। চলে যেতেই হবে। তাঁরা যাবেন না। তাঁদের পাঠানো হয়েছিল বীরভূম, শালবনী, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুরের ক্যাম্পে। সেখানে তাঁরা থাকতে চাইছেন না। খাওয়া পাওয়া যায় না। মেয়েদের সম্মান রক্ষা হয় না। তাই তাঁরা ফিরে এসেছেন। কিন্তু, ফিরলে চলবে কেন? এভাবে তো শিয়ালদহ আর হাওড়ায় সারাজীবন রেখে দেওয়া যায় না। যদি ফিরে যায় তাহলে প্রত্যেকে মাসে ৭ টাকা আর বাচ্চাদের ৫ টাকা করে দেওয়া হবে। তারা রাজি হল। অন্যথা উপায় নেই!
৩০ জানুয়ারি ধুবুলিয়া ক্যাম্পের দৃশ্য। হাইওয়ে ধরে যখন পরপর লাইন দিয়ে তিনটি গাড়ি যাচ্ছে ভোটকর্মীদের নিয়ে, তখন দেখা যায় একটি গাছের নীচে অবিরল কেঁদে চলেছে এক কিশোর। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে বোন। তারা মাদারিপুর থেকে আসার পথে হাতে থাকা একটি বাক্স হারিয়ে ফেলেছে। কি ছিল বাক্সে? সেই ফেলে আসা স্কুলের খাতা আর কিছু জমানো ঝিনুক!
ঠিক সেখান থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের এক শহর কলকাতায় ওই প্রথম সাধারণ নির্বাচনের উদ্মাদনার মধ্যেই ওই ১৯৫১ সালে রিলিজ হয়ে গেল কিছুদিনের ব্যবধানে দু’টি বাংলা সিনেমা। ‘ওরে যাত্রী’ এবং ‘সহযাত্রী’। একটি অচেনা তরুণকে দেখা গেল পোস্টারে। তখনও কেউ চেনে না। সেই তরুণই পরবর্তীকালে উত্তমকুমার!