ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
যে নারী লঙ্কাপুরীর অশোকবনে এতদিন অরক্ষিত ছিলেন, রাবণ যাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই জানকীর সতীত্বে কি এতটুকু আঁচ লাগেনি? অয্যোধ্যাবাসীর মনে উঁকি দেওয়া প্রশ্ন, রামচন্দ্রের মনে এসেও ধাক্কা মারে। সীতা তাঁর স্ত্রী, সহধর্মিনী। কিন্তু দশরথ নন্দন একই সঙ্গে একটি দেশের রাজা। তাঁর কাছে রাষ্ট্র বড়, আগে প্রজা। প্রজাদের ইচ্ছে, তাদের সুখই রাজার কাছে মুখ্য। তাদের জন্য সামান্য এক নারীকে ত্যাগ দেওয়াটা বড় কথা নয়, হোক না সীতা তাঁর স্ত্রী।
কিন্তু নারীর সূচিতা, শুদ্ধতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কোন মানদণ্ডের মাপকাঠিতে? সেই মানদণ্ডে কেন পুরুষের শুদ্ধতা মাপা হবে না? সীতা সরাসরি আঙ্গুল তোলেন পুরুষ দ্বারা নির্মিত সমাজের উদ্দেশ্যে। একজন নারী পুরুষের দ্বারা অপমানিত হচ্ছে, অত্যাচারিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, তখন কেন সেই শুধু শুচিতার পরীক্ষা দেবে? তার তো কোনও দোষ নেই। পুরুষ কেন পরীক্ষা দেবে না? যে রাম গর্ভবতী স্ত্রীকে গোপনে পরিত্যাগ করতে পারে, যে স্বামী, স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারে না সেই রামচন্দ্রের কাছে সতীত্বের পরীক্ষা সীতা কেন দেবেন?
না-না প্রশ্নগুলো মহাকাব্যের সীতা করেননি, করেছেন ‘সীতায়ন’-এর সীতা। শুধু রামচন্দ্রের কাছেই নয়, সমগ্র পুরুষজাতির উদ্দেশ্যে। পূর্বরঙ্গের নাটক ‘সীতায়ন’এর মধ্যে দিয়ে এক নতুন সীতাকে দর্শকদের সামনে নিয়ে এলেন নাট্যকার-নির্দেশক মলয় রায়। মল্লিকা সেনগুপ্তের উপন্যাস অবলম্বনে মলয় রায়ের ‘সীতায়ন’ হয়ে উঠেছে ভীষণভাবে রাজনৈতিক এবং প্রাসঙ্গিক।
সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন অশোকবনে। দোষ রাবণের। তাঁর তো কোনও পাপ নেই। যা কিছু পাপ করেছে একজন পুরুষ। ‘সীতায়ন’এর সীতার প্রশ্ন, রাঘব তো দ্বিগুণ পাপ করেছেন। অমন সুন্দর লঙ্কাকে জ্বালানোর খুব প্রয়োজন ছিল কি? যে কারণে কতশত নিরপরাধ নারী, শিশুর মৃত্যু হল। সূর্পণখা শুধুমাত্র প্রেম নিবেদন করেছিল, তাই বলে তার অত ভয়ঙ্কর শাস্তি। এসব পাপ নয়?
আসলে পুরুসাশিত সমাজে পুরুষ, তার চোখ দিয়েই নারীকে দেখতে ভালোবাসে। তার মতো করেই নারীর বিচার করে। নারীর প্রতি অপমান, অবহেলা, অত্যাচার, অন্যায় করার এই বহমানতা মহাকাব্যের যুগ পেরিয়ে আজও চলছে। আধুনিকতার বেড়াজালে নারী এমন ভাবে বন্দি যে তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা, ইচ্ছে-অনিচ্ছের শেষ কথা বলে সেই পুরুষ। প্রেম বা বিয়েটাও হয়ে ওঠে পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যদি বিশ্বাস, ভালোবাসা না থাকে তাহলে তো সম্পর্কটাই মিথ্যা। আর এই মিথ্যার জোরেই দশরথ নন্দন অনায়াসে বৈদেহীকে গর্ভবতী অবস্থায় বাল্মিকী আশ্রমে পাঠিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ভয়ঙ্কর এক অন্যায় হচ্ছে জেনেও রামচন্দ্রের পুরুষাকার গর্জে ওঠেনি। আসলে তো তিনি পুরুষ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সমাজের প্রথম শ্রেণিভুক্ত। নারী যে দ্বিতীয় লিঙ্গ। আজও, এই সময়ে দাঁড়িয়ে। যে কারণে সীতাকে পাতাল প্রবেশ করতে হয়, অহল্যাকে পাথর হয়ে যেতে হয়, দ্রৌপদীকে জুয়া খেলায় বন্ধক রাখা যায় আর পদ্মিনীকে আত্মাহুতি দিতে হয়। নারীর হাহাকার, চিৎকার, ছড়িয়ে পড়ে গুজরাত, রাজস্থান হয়ে এই বাংলায়। যে বেদনা অনুরণিত হয় ‘সীতায়ন’এর সীতার মধ্যে। আজ এই ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে মনে প্রশ্ন জাগে, নারীর অবস্থানগত পরির্বতন হয়েছে কি? মেয়েরা কবে নিজের শর্তে, নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে? এই প্রশ্নগুলোকেই নতুন করে উসকে দেয় পূর্বরঙ্গের ‘সীতায়ন’।
মাত্র দু’জন শিল্পী। রোকেয়া রায় এবং প্লাবন বসু। রোকেয়া কখনও সীতা, কখনও কৌশল্যা, বা অন্য কোনও সাধারণ নারী। প্রত্যেকটি চরিত্রের বিভিন্নতা, বিচিত্রতা তাঁর অভিনয়ে প্রকাশ পায়। বেদনায় মূর্ত হয়ে ওঠা প্রত্যেকটি চরিত্র ভিন্ন হয়ে ওঠে রোকেয়ার শরীরী অভিনয়ের ওঠানামায়, সংলাপের নির্ভুল প্রক্ষেপণে। অভিনয়ের কোথায়, কতটা গভীরতার দরকার, কোথায় উচ্চকিত হওয়া দরকার, কোথায় বা নরম হতে হবে, কখনই বা গর্জে উঠতে হবে – শিল্পীর অসামান্য পরিমিতি বোধ নাটকটি ধরে রাখে শেষ পর্যন্ত। পাশাপাশি রাম, লক্ষ্মণ, বিভীষণ, বাল্মিকীকে অনায়াস দক্ষতায়, নৈপুন্যে মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করেন প্লাবন। তাঁর অভিনয় চমক লাগায়। দুরন্ত নৃত্য বিভঙ্গের মধ্যে দিয়ে রোকেয়া আর প্লাবন কত কত চরিত্র হয়ে ওঠে। সমগ্র মঞ্চ তাঁদের ছন্দময়তার সাক্ষী থাকে। বহমান সময়কাল এবং নাটকের মুডকে চমৎকার ধরেছে রোকেয়ার মঞ্চ ভাবনা, পোশাক পরিকল্পনা। নাটকটিকে পরিপূর্ণতা দান করেছে সঙ্গীতাংশ (রোকেয়া-দিশারী-জয়দীপ)। মলয় রায়ের আলো এবং রোকেয়ার প্রপস-এর ব্যবহার তারিফযোগ্য।