হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
শুভমস্তুর চার কন্যা এবার দুর্গা পুজোর কাজে হাত দিলেন। ৬৬ পল্লির দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করবেন তাঁরা। শুভমস্তু সংগঠনটিকে মহিলাদের পৌরোহিত্যে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক বললে হয়তো ভুল হবে না। পথপ্রদর্শক এই অর্থে যে, পৌরোহিত্যের সংজ্ঞাটাই বেশ একটু বদলে দিয়েছেন তাঁরা। ধার্মিক অনুষ্ঠান মানে যে শুধু মন্ত্রপাঠ নয়, তার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক আরও নানা প্রথা, গান ও পুরাণের গল্প— তা-ই স্পষ্ট করেছেন এই সংস্থার মহিলা পুরোহিতরা।
গত বছর দুর্গাপুজোর ঠিক আগেই কথা হয়েছিল নন্দিনী ভৌমিকের সঙ্গে। শুভমস্তুর চার কন্যার অন্যতম তিনি। দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘মায়ের বুঝি এখনও ইচ্ছে নয় যে তাঁর পুজোয় আমরা পৌরোহিত্য করি। তাই সরস্বতী পুজোর কাজ টুকটাক করলেও দুর্গাপুজোয় এখনও হাত দিইনি।’ তারপর একটা গোটা বছর গড়িয়ে গিয়েছে। আগামী দুর্গাপুজো আসন্ন। আর ইতিমধ্যেই নতুন চমক। ৬৬ পল্লির পুজোয় পৌরোহিত্য করবে শুভমস্তু। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত? প্রশ্ন করলাম নন্দিনীকে। তিনি বললেন, ‘আমরা শুভমস্তুর কন্যারা, রুমা, নন্দিনী, সেমন্তী, পৌলোমী— কখনওই ভাবিনি দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করব। বরং নিজেদের সামাজিক অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে বললাম, মায়ের হয়তো এবছর খুব ইচ্ছে হয়েছে মেয়ের হাতে পুজো পাওয়ার। তাই তাঁরই ইচ্ছায় আমরা মেয়েরা দুর্গাপুজোয় হাত দিয়েছি।’ শুভমস্তুর কাজের মাধ্যমে একটা সামাজিক সংস্কার শুরু করেছিলেন এই চার মহিলা। সেই সংস্কারমূলক কাজেই আবদ্ধ থাকতে চেয়েছিলেন তাঁরা। নন্দিনী বললেন, ‘সমাজ বদলানো তো মুখের কথা নয়, তার জন্য প্রচুর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় লাগে। আমরা সেই অধ্যবসায় নিয়ে কাজে নেমেছি।’ তাঁরা মনে করেন মানুষের মধ্যেই ভগবানের বাস। ফলে সামাজিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন ইত্যাদিতে পৌরোহিত্য করতে পারলেই ঈশ্বরের সেবা করা সম্ভব। তার জন্য আলাদা করে দুর্গাপুজো করতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু মাত্র এক মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন তাঁরা। আসলে গত বছর দ্বাদশীর দিন ৬৬ পল্লির পুরোহিত মহাশয় মারা যান। তারপর পুজো কমিটি যোগাযোগ করে নন্দিনীর সঙ্গে। কিন্তু তিনি তো নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। যুক্তি দিয়ে বললেন সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই তাঁরা ঈশ্বরের সেবা করতে আগ্রহী। কিন্তু অপর পক্ষও নাছোড়বান্দা। তাঁরা বললেন বারোয়ারি দুর্গাপুজোও একরকম সামাজিক অনুষ্ঠানই বটে। অতএব পুজোর কাজে হাত দিলে তাঁদের সিদ্ধান্ত থেকে মোটেও সরে যাওয়া হবে না।
‘দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করা মানেই প্রবল পড়াশোনা করা। সেই কারণেই আমাদের একটু দ্বিধা ছিল। আর সেই পড়াশোনাটাকেই ট্রাম্পকার্ড করে শুভমস্তুর টিমকে রাজি করিয়ে ফেললেন ৬৬ পল্লির উদ্যোক্তারা।’ বললেন নন্দিনী। কথায় কথায় নন্দিনীর গবেষণার প্রতি টান ও মনোযোগের দিকটি উঠে এসেছিল। আর সেই তাসটাই খেলে দিলেন পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট। বললেন, ‘আপনি যখন পড়াশোনা করতে এতই ভালোবাসেন, তখন আগামী এক বছর না হয় দুর্গাপুজো নিয়েই পড়াশোনা করুন। দুর্গাপুজোর বিভিন্ন দিক বিষয়ে গবেষণা করুন। সেগুলো নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিন। বাকি কাজ তো পরেও হতে পারে। কিন্তু মায়ের যখন এতই ইচ্ছে মেয়েদের হাতে পুজো পাওয়ার তখন সেই কাজটা তো তুচ্ছ করা চলে না।’ কথার মারপ্যাঁচে নন্দিনী ও তাঁর দলের অন্যরাও দেখলেন তাঁরা নিজেদের অজান্তেই ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলেছেন!
শুভমস্তুর যে কোনও কাজেই মূল চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট লেখেন নন্দিনী। তাই তিনিই মূলত গবেষণার কাজটা করেন। কেমনভাবে সাজাবেন অনুষ্ঠান, তার কাঠামোটাও গড়ে ফেলেন তিনি। সেই কাঠামোর উপর মাটি ও রঙের প্রলেপ লাগান বাকিরা। সেমন্তী ও পৌলোমীর গান আর রুমার মন্ত্রের জোগানে অনুষ্ঠান এক অনন্য মাত্রা পায়। এক্ষেত্রেও তেমনটাই হতে চলেছে। প্রচুর পড়াশোনার মাধ্যমে চিত্রনাট্যের সিংহভাগ পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই ছকে ফেলেছেন নন্দিনী। তবে এবার যে অন্যরকম দুর্গাপুজোর আয়োজন সে বিষয়ে তিনি আহ্বায়কদের প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। নন্দিনীর কথায়, ‘যে কোনও অনুষ্ঠানই আমরা একটা অন্য ঘরানায় করি। পুজোতেও তার ব্যতিক্রম যে হবে না তা প্রথমেই জানালাম পুজো কমিটির সদস্যদের। আমার কথায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন তাঁরা। বললেন এই ভিন্ন ধারার পুজোর আয়োজনের আশাতেই নাকি তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।’ অতএব কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁরা প্রথম থেকেই পেয়ে গিয়েছিলেন। পুজোর মূল দিকগুলো থাকবে কি না, এই নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছিল। নন্দিনী বললেন পুজোর সব অনুষ্ঠান বজায় রেখেই তাঁরা পরিকল্পনা করেছেন। চিত্রনাট্যও সাজিয়েছেন সেই অনুযায়ী। তাতে ষষ্ঠীর বোধন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণের সন্ধি পুজো এবং দশমীর বিসর্জন পুজো সবই থাকবে। তবে আয়োজনে নতুনত্বের ছোঁয়া দেবেন তাঁরা।
এদিকে অক্টোবর মিটলে তো বিয়ের মরশুম। নভেম্বর, ডিসেম্বর তো বিয়ের ঠেলায় দম ফেলারও সময় পান না তাঁরা। আর তার ঠিক আগেই দুর্গা পুজো । অতএব কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু সব কাজই সহজ হয়ে গেল ক্রমশ। মা দুর্গাই বুঝি সুগম করে দিলেন তাঁদের পথ। দুর্গা বোধে মগ্ন হয়ে উঠলেন তাঁরা চারজনই। এবং ক্রমশ পুজোর পদ্ধতি, ধারা, নতুন পন্থা সবই যেন জলের মতো স্পষ্ট ভেসে উঠতে শুরু করল তাঁদের চোখের সামনে। কোথায় মন্ত্র পড়া হবে, কোন মন্ত্র কীভাবে বোঝানো হবে, কোথায় মন্ত্রের সঙ্গে গানের সঙ্গত থাকবে, সবই স্বচ্ছভাবে ভেবে ফেলতে শুরু করলেন নন্দিনী। এবং গানের ব্যবহার, মন্ত্রের সঙ্গে গানের সামঞ্জস্য, মন্ত্রের সহজ ব্যাখ্যা সবই ধাপে ধাপে মিলে যেতে লাগল। এক অসম্ভব স্নিগ্ধ ভাবে মন ভরে উঠতে লাগল এবং তাঁরা বুঝতে পারলেন এই কাজের জন্য তাঁরা প্রস্তুত।
পুজোর সংকলন প্রসঙ্গেও একটু খোলসা করেই বললেন নন্দিনী। তাঁর কথায়, ‘অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, কোন মতে পুজো হচ্ছে। এই ‘মত’ শব্দটায় আমাদের আপত্তি রয়েছে। আমরা মনে করি মত একটাই— হিন্দু মত। আমাদের পুরাণ খুবই সমৃদ্ধ। পৌরাণিক কাহিনিগুলো একত্রিত করে তারই থেকে একটা সংকলন করা হয়েছে। এবং সেই সংকলনে মন্ত্র যেমন রয়েছে তেমনই সহজে কিছু গল্পও বলা হয়েছে। আর মন্ত্র ও গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংগীত।’ গান না থাকলে পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে যাবে বলে মনে করেন নন্দিনী। গানের মাধ্যমে পুজো পদ্ধতিতে এক অন্য মাধুর্য আসবে বলে জানালেন তাঁরা। একটা নাটকীয় ভাব আনা হবে গানে, গল্পে। প্রাচীন সাহিত্যের ওপর ভর করে, পুজোর প্রতিটি আঙ্গিক রক্ষা করে নতুনভাবে সাজানো হবে শুভমস্তুর প্রথম দুর্গাপুজোটিকে। খুবই আন্তরিকভাবে পুজো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান তাঁরা। মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে পুজো করবেন তাঁরা। ফলে পুজো প্রক্রিয়াটা খুব দীর্ঘ হবে না। কিন্তু তাতে বোঝানোর ব্যাপারটা অসম্ভব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মন্ত্রে উচ্চারণ, তার সঙ্গে গানের মিলন সবই ভীষণ অন্য ধরনের একটা আবহ সৃষ্টি করবে। ফলে গোটা অনুষ্ঠানটাই ভিন্ন স্বাদ বহন করবে শ্রোতা ও দর্শকদের কাছে।
তাঁরা পুজোটাকে, তার সমস্ত আঙ্গিককে উপলদ্ধি করবেন। পুজোর মতো পুজো হবে আর প্যান্ডেলের সামনে লোকে নিজেদের মতো গল্প করবে, এমনটা শুভমস্তুর কাজে কখনওই সম্ভব নয়। আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষার এক অসামান্য মেলবন্ধন ঘটবে শুভমস্তুর দুর্গাপুজোয়। নন্দিনীর কথায়, ‘আমাদের কবি, মনীষীরা ঋষির মতো কবিতা লিখে গিয়েছেন, তার সুরও অনবদ্য। সেইগুলোকেও কাজে লাগিয়ে স্ক্রিপ্ট তৈরি হচ্ছে। তবে দুর্গাপুজোয় মন্ত্রের প্রাবল্য বেশি। ফলে সেগুলোকে অটুট রেখে গানের সংখ্যা কমানো হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে তার প্রাধান্য কিছু কমেনি।’
সন্ধ্যারতিটাকেই এক অনন্য মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে শুভমস্তুর তরফে। এই চিত্তাকর্ষক সন্ধ্যারতিকে সম্পূর্ণ রূপে মনোমুগ্ধকর করতে তাই নিয়ম মতো রিহার্সালও দিচ্ছেন তাঁরা। আর থাকছে চণ্ডীপাঠের নতুনত্ব। সেখানে সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। লোককে বোঝানো যখন উদ্দেশ্য, তাঁদের কাছে ব্যাপারটা সহজ করে তুলে ধরা যখন কাম্য তখন শুধু সংস্কৃতই বা কেন? বাংলা কেন নয়? আমাদের মাতৃভাষায় চণ্ডীপাঠ হলে তা গল্পের মতো লোকের মনে গেঁথে যাবে। তাঁরা দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারবেন। এবং পুজোপদ্ধতি তাঁদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
ফলে এই সব দিক ভেবেই এবার ৬৬ পল্লিতে এক নতুন ধরনের দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছে শুভমস্তু। সেখানে স্ত্রী আচারের প্রাধান্য থাকবে, মন্ত্রের গুরুত্ব থাকবে, পুজো পদ্ধতি বজায় থাকবে অথচ অনুষ্ঠানে একটা নতুনত্ব ধরা পড়বে। পুজোর মাধ্যমে সামাজিক এক উত্তরণ ঘটানো হবে। সবাই দেখবেন নারী শক্তির শুভ উদ্যাপন। দশভুজার আরাধনায় জীবন্ত দশভুজারা এক নতুন ধরনের নজির গড়ে তুলবেন যা সাবেকি নিয়মগুলোকেই নবরূপে উপস্থাপন করবে। আর তাঁদের এই পুজো পদ্ধতি হয়ে উঠবে চিরন্তন।