এষণা আর ইস্তা। মা-মেয়ের যুগলবন্দিতে চলে নানা ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী বানানোর কাজ। লকডাউনে আর সবার মতো হতাশা-উদ্বেগ ঘিরে ধরেছিল তাদেরও। তবে বাকিদের সঙ্গে এই মায়ের একটাই তফাত। তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা। লিখেছেন অন্বেষা দত্ত।

ইস্তার বয়স মাত্র ছয়। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার রয়েছে তার। ছ’বছরের বাচ্চার মতো অনেক কিছুই তাই সে করতে পারে না। এই সত্যিটা মেনে নেওয়া অনেক মায়ের পক্ষেই খুব কঠিন। কিন্তু এষণা দে বুঝেছিলেন সত্য লুকিয়ে বাঁচা যায় না। তাতে মা হিসেবে তাঁর নিজের তো কষ্ট হবেই, আর একইভাবে বঞ্চিত হবে তাঁর একরত্তিটিও। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে মহামারীর কঠিন সময়ে নিজে যেমন সৃষ্টিশীল কাজে মন দিয়েছিলেন, তেমনই সঙ্গী করে নিয়েছিলেন ইস্তাকেও। ওর পক্ষে যতটা করা সম্ভব, সেটাই পরম যত্নে ব্র্যান্ডের জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। এতে একদিকে মন ভরে উঠেছিল ছোটটির, আর অন্যদিকে তাকে আনন্দে রেখে তৃপ্তি পেয়েছিলেন তার মা। তিনি জানেন, মনের সেই খুশি ব্যক্ত করার ক্ষমতাও নেই তাঁর ইস্তার। সে কথা বলতে পারে না এখনও। কিন্তু নাড়ির টানেই মা হয়তো বুঝে যান, খুদের খুশি কোথায় লুকিয়ে রয়েছে। এভাবে সাহসে ভর করে একটু একটু করে এগিয়েছে তাঁর কন্যার নামের ব্র্যান্ড ইস্তা।
হ্যান্ডমেড সোপ দিয়ে হাত পাকানোর কাজ শুরু করে এখন বিভিন্ন ধরনের ত্বকের জন্য ক্রিম বানিয়ে দিচ্ছেন এষণা। সঙ্গে থাকছে চুলের পরিচর্যার হরেক উপাদানও। আর এই সব কাজের মধ্যেই ইস্তার স্পর্শ থাকে। প্রথম প্রথম একটু ধৈর্য ধরে শিখিয়ে দেওয়া। এভাবেই ছোট্ট মেয়েটা রপ্ত করেছে প্রসাধনী বানানোর প্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটা সহজ ধাপ। যেমন স্কিনের কোনও প্রোডাক্ট বানানোর সময় অ্যালোভেরা কেটে কেটে তার হাতে ধরিয়ে দেন এষণা। সে রোল করে তার ভেতর থেকে বের করে আনতে পারে রসটা। কখনও বা গোলাপজল তৈরির সময় মা হাতে ধরিয়ে দেন গোলাপ। সে ধীরে পাপড়ি বের করে মাকে দেয়। তারপর ধুতে বললে ধুয়ে দেয়। এমন ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে ইস্তাকে ব্যস্ত রাখেন তার মা। ব্র্যান্ড ইস্তার মোটিফের মধ্যে অটিজমের প্রতীক ব্লু শেড রেখেছেন এষণা। তাঁর কথায়, ‘এই সত্যি কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। কিন্তু এভাবেই সৃষ্টিশীলতার মধ্যে দিয়ে সত্যিটা আপন করে নেওয়া যায়।’
অর্গ্যানিক স্কিন কেয়ার নিয়ে ব্রিটেনের একটি সংস্থা থেকে অনলাইনে কোর্স করছেন এষণা। তাতে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। ডে ক্রিম এবং নাইট ক্রিম বানানোর দিকে এগিয়েছেন তিনি। ক্রেতার ত্বকের ধরন বুঝে, তার কোনও অ্যালার্জি আছে কি না জেনে, বা অন্য কোনও সমস্যা আছে কি না দেখে তবেই ক্রিম তৈরির কাজে হাত দেন। তাঁর কাছে আগে থেকে তাই বানানো প্রোডাক্ট থাকে না। তাঁর মতে, ‘পাঁচজন যদি অর্ডার করেন, আমি পাঁচজনের স্কিনের আলাদা আলাদা ধরন বুঝে তবেই জিনিস বানিয়ে দিই। এতে ক্রেতার সন্তুষ্টি শেষ কথা।’ ইস্তার ব্র্যান্ডে রয়েছে অ্যালোভেরা সোপ, চারকোল সোপ, কফি সোপ, রোজ পেটাল সোপ, টারমারিক স্যান্ডাল সোপ, লেমন হানি সোপ এবং পাপায়া সোপের মতো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হ্যান্ডমেন্ড সাবান। তাছাড়া তিনি বানিয়ে দিতে পারেন রেড ওয়াইন বডি স্ক্রাব, চারকোল ফেস স্ক্রাব, কফি বডি স্ক্রাব এবং কোকো বাটার বডি ক্রিম। মুখের জন্য আছে ওটস আমন্ড ফেস প্যাক, ফেস বাটার ক্রিম, চারকোল ফেস ওয়াশ এবং মরোক্কান ট্যান রিমুভিং ফেস প্যাক। চুলের যত্নে তিনি রেখেছেন হেয়ার কেয়ার শ্যাম্পু এবং শিয়া বাটার হেয়ার মাস্ক, অনিয়ন অয়েল ইত্যাদি। 
‘ক্রিম বেস তৈরি করাটা শিখে নিতে পারলে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে এই ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী বানানো খুবই সহজ,’ বলছিলেন এষণা। তাঁর বক্তব্য, ‘ত্বকের ধরন অনুযায়ী বুঝে নিতে হবে কোথায় অ্যালোভেরা এক্সট্র্যাক্ট দেব, কোথায় ভিটামিন ই ক্যাপসুল বা কোথায় চাল ভেজানো জল দিতে হবে। চালের জল নেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম আছে। চাল তিন-চার ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেই জল একটা কৌটোতে রেখে দিতে হয়। তারপর ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওটা ফারমেন্টেড হয়ে যায়। আর সেই জলটা মিনারেল সমৃদ্ধ হয়। সেটাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হবে তা-ও জানতে হবে। প্রফেশনালি করতে গেলে ক্রিম বেস না হলে মুশকিল। বাড়িতে এই সব উপকরণ দিয়ে ক্রিম বানানোর পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেটা মেখে ফেলতে হয়। ক্রিম বেস থাকলে যে কোনও বাজারজাত সামগ্রী যেমন হয়, সেভাবেই তা ব্যবহার করা যাবে।’ দামও তিনি রেখেছেন সাধ্যের মধ্যেই। 
এষণার এই সব প্রোডাক্ট যখন ক্রেতাকে খুশি করে, তখন ইস্তা কি বুঝতে পারে? তিনি বলেন, ‘ওর আবেগ নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ওকে দিয়ে যখন নানা কাজ করাই, ও বুঝতে পারে কোনটা ক্রিম বা কোনটা সোপ। কোনটার কী আলাদা গন্ধ, বারবার বুঝিয়ে দিই। ও সবসময় রিলেট করতে পারে না। কিন্তু আমি সবসময় ওকে বলতে থাকি। ওকে দিয়ে যতটা করানো যায়, ও যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়, বোঝাতে থাকি। জানি ও খুব খুশি হয়। কারও জন্য একটা প্রোডাক্ট বানানো হলে সেটা ওকে হাতে দিয়ে বোঝানো হয়, কাজের পরিণতি এটা‌—  ও স্পর্শ করে ঠিক বুঝে যায়। এখন কোভিডে সবসময় সম্ভব হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি যখন একটু ভালো ছিল, তখন জিনিসগুলো ক্যুরিয়ার করার সময়েও ওকে নিয়ে যেতাম। বলতে না পারলেও ও হাতে করে কাউকে তুলে দিচ্ছে জিনিসটা, এই বোধটা ওর হয়েই গিয়েছে।’  ব্র্যান্ড ইস্তার পাঠানো প্রোডাক্টে থ্যাঙ্ক ইউ নোটে লেখা থাকে, ‘a very special gift from a very special child’। 
এষণা আর ইস্তার পাশে থাকার জন্য দেখতে পারেন ওদের ফেসবুক পেজ ishtaa’s। আর যোগাযোগ করতে পারেন ৯৮৩১৪১৯২১৭ নম্বরে।