হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
উন্নত জীবন নিয়ে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখুক মেয়েরা। স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করুক মেয়েরা। এই মন্ত্র নিয়েই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উড়ান-এর পথ চলা শুরু হয়। মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ব্রতী এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার কাজ শুরু করেছেন শান্তনু মুখোপাধ্যায়। কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, নিজের বাড়ির মহিলাদের দেখেই এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর মাকে দেখেছেন দায়িত্ব নিয়ে সংসার চালাতে। স্ত্রী নিজের নানা কাজ সামলেও সংসারের খুঁটিনাটি দেখভাল করেন। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে মহিলাদের এমন অবস্থা নয়। অথচ মহিলারা সমাজের অন্যতম স্তম্ভ। তবু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পরনির্ভরশীল। সামান্য হাতখরচ চালাতে স্বামী বা ছেলের কাছে হাত পাততে হয়। আর শুধু অর্থনৈতিক চাহিদার কথাই বা বলি কেন? সামাজিক, পারিবারিক কোনও সিদ্ধান্তই মেয়েরা স্বাধীনভাবে নিতে পারে না। নিলেও তা সমাজে সবসময় গ্রাহ্য হয় না। পুরুষসমাজ মেয়েদের স্বভাবসিদ্ধ স্বনির্ভরতার দিকে এখনও আঙুল তোলে। ‘এবার কিন্তু বদলের সময় এসেছে’, বললেন শান্তনু। মহিলাদের স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাই উড়ান-এর লক্ষ্য।
নাম দিয়ে যায় চেনা
উড়ান নামটি বাছলেন কেন? শান্তনুর কথায়, মেয়েদের ইচ্ছেডানা হয়ে তাদের উড়তে শেখানোই উড়ানের আসল উদ্দেশ্য। তাই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলার সময় এই নামটিই বেছেছিলেন তিনি। তাঁর সংস্থা যেন মহিলাদের লম্বা উড়ানের সফরসঙ্গী হয়ে থাকতে পারে, সেটাই তাঁর ইচ্ছা। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করে চলেছেন। কেমন সেই কাজ? শান্তনুবাবুর কথায়, ‘মূলত মহিলাদের ক্ষমতায়নের ওপর কাজ করছি আমরা। শহুরে মেয়েরা তবু নিজেদের চাহিদা, ইচ্ছা ইত্যাদি বিষয়ে ওয়াকিবহাল। কিন্তু গ্রামের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। সেখানে মেয়েরা নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন নয়। তারা যে কত দূর যেতে পারে, সে বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই। একটু সাহায্যের মাধ্যমে এই স্তরের মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারলে সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে। সেই লক্ষ্যে এগনোই আমাদের সংস্থার উদ্দেশ্য।’
শুরুর কথা
কাজটা শুরু হয়েছিল সুন্দরবনের মহিলাদের দিয়ে। ওখানকার গ্রামের মহিলারা নানা ধরনের কাজ করেন। কিন্তু সেই কাজে সূক্ষ্মতার অভাব। তাই কাজগুলো মার্কেটে বিক্রি হয় না। কিন্তু ওদের কাজগুলো দেখে শান্তনুর মনে হয়েছিল সামান্য প্রশিক্ষণ দিলে ওদের এই কাজগুলোকেই আরও সূক্ষ্ম ও সুন্দর করে তোলা সম্ভব। সেই ভাবনা থেকেই তাঁর সংস্থা সুন্দরবনের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে মহিলাদের সেলাই, উল বোনা ইত্যাদির প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। প্রশিক্ষণের পর তাদের কিছু কাজও দেওয়া হয় এবং মহিলাদের তৈরি জিনিসগুলো বিক্রি করার বন্দোবস্তও তাঁরাই করে দেন। এইভাবে শুধু যে গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করা যায় তা-ই নয়, তাদের পরিবারেও সচ্ছলতা আনা যায়।
আগামীর পথে
সুন্দরবন ছাড়াও মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের মহিলাদের নিয়েও কাজে নেমে পড়েছে উড়ান। ওই অঞ্চল ঘুরে সমীক্ষা করে সংস্থার টিম দেখেছে যে ওখানকার মেয়েরা বেতের কাজ, পাথরের কাজ ইত্যাদি খুব ভালো করে। কিন্তু সেই কাজ বিক্রি করার বা তা থেকে উপার্জন করার ক্ষমতা তাদের নেই। সেক্ষেত্রে সংস্থাটি তাদের এই উপার্জনের পথটা দেখিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। বেতের ঝুড়ি, মাদুর, বাটি, পট ইত্যাদি এখন হ্যান্ডিক্রাফট হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে খুব ভালো বিক্রি হয়, বললেন শান্তনু। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট সার্ভে করে তাঁরা দেখেছেন, এখানে হাতে তৈরি বা ‘হ্যান্ডমেড’ জিনিসের দারুণ কদর। ফলে এই বেতের হাতের কাজগুলো তাঁরা সেই ‘হ্যান্ডমেড’ তকমা লাগিয়ে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারেন তাহলে তা খুবই ভালো চলবে। কিন্তু সাধারণ গ্রামের অল্পশিক্ষিত মহিলাদের পক্ষে এই বাজারটা ধরা মুশকিল। তাদের সেই বাজার ধরতে সাহায্য করছে উড়ান। আর পাথরের কাজও হয় নানারকম। পাথরের মূর্তি যেমন একটু কমন হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পাথরের থালা, গ্লাস, বাটি এমনকী সার্ভিং বোল ইত্যাদি ব্যবহারের চল বেড়েছে। ফলে এই জিনিসগুলোর চাহিদা বেশি। এই ধরনের বাসনের একটা অ্যান্টিক ভ্যালুও রয়েছে। অর্থাৎ সেই আদি সভ্যতার সময় মানুষ এই ধরনের বাসন ব্যবহার করত। সেই চরিত্র যদি এই ধরনের কাজে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে এর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বও আসবে। আর এটাই বিদেশি মার্কেটে ভীষণ জনপ্রিয় হবে। এই ধরনের ভাবনাগুলো তো আর গ্রামের মেয়েরা ভাবতে পারে না। তাই তাদের হয়ে এই ভাবনাগুলো ভেবে দেওয়ার কাজটা করে শান্তনুর স্বেচ্ছসেবী সংস্থাটি। এবং এগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে দেওয়ারও চেষ্টা করে তারা। এই কাজটি এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি বটে তবে আগস্ট মাস থেকেই এই প্রকল্প বেশ পাকাপোক্তভাবে শুরু করার ইচ্ছে রয়েছে শান্তনুর। সেই মতো তাঁর সংস্থা এগিয়েও পড়েছে ইতিমধ্যেই।
পেশা এবং লাভ
কীভাবে বিক্রি করেন এই পণ্য? প্রশ্নের জবাবে শান্তনু বলেন, বিভিন্ন বুটিকের মাধ্যমে পণ্যগুলো তাঁরা বিক্রি করার চেষ্টা করেন। সাধারণত বুটিকগুলো গ্রামীণ শিল্পীদের থেকে পণ্য কিনে নিয়ে তা নিজেরা বিক্রি করে। তা না করে তাদের হাতে তৈরি জিনিসগুলো সরাসরি বিক্রি করার ব্যবস্থা করে উড়ান। এইভাবে কাজের সঠিক মূল্য গ্রামের মহিলাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই উড়ানের লক্ষ্য, জানালেন শান্তনু।
সুন্দরবনের মহিলাদের নানারকম কাজ শেখানোর কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন শান্তনু। সেই প্রসঙ্গে আবারও ফিরে বললেন, ‘সুন্দরবনের মহিলারা মাদুর তৈরি করে। এখন শহুরে জীবনে মাদুরের ব্যবহার প্রায় নেই। কিন্তু অনেকেই তা দিয়ে ঘর সাজান। ফলে মাদুরের একটা মার্কেট আছে। সেই মার্কেটটা হয়তো সুদূর সুন্দরবনের গ্রাম্য মহিলা পর্যন্ত পৌঁছয় না। মাঝখানে অনেক মিডিয়েটর থাকে যারা লাভের ভাগীদার হয়ে যায়। ফলে শিল্পীদের লাভের ভাগ কমে যায়। আমরা এই মিডিয়েটরের কাজটা করি ফলে গ্রামের মহিলাদের অনেকটাই সুবিধে হয়।’
প্রশিক্ষণের খুঁটিনাটি
তবে এমনও কিছু মহিলা আছেন যাঁরা সে অর্থে হাতের কাজে পটু নন। সেক্ষেত্রে তাঁদেরও বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় উড়ানের পক্ষ থেকে। এই ধরনের মহিলারা সায়া ব্লাউজ ইত্যাদি তৈরির কাজ শেখেন। এখন তো ডিজাইনার ব্লাউজের কদর শহর ও শহরতলি জুড়ে। সেই ধরনের ব্লাউজের কারিগর হিসেবেও এঁদের কাজ শিখিয়ে নেওয়া উড়ানের উদ্দেশ্য।
উদ্যোগে বিপুল সাড়া
শান্তনু বললেন, তিনি যখন এই কাজটা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন তখন একটা সংশয় তাঁর মনে দানা বেঁধেছিল, তা হল সামাজিক বাধা। গ্রামের মহিলারা এই উদ্যোগে সাড়া দেবে কি না, তাদের বাড়ি থেকে তাদের কাজ করতে দেওয়া হবে কি না, ইত্যাদি নানা ধরনের চিন্তা ছিল তাঁর মনে। কিন্তু কাজে নেমে দেখেন মেয়েরা হাসিমুখে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে আসতে চাইছে। এমন সাড়া পেয়ে শান্তনুর ইচ্ছে দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে মহিলাদের স্বনির্ভর করা খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ এমন অনেক পরিবার রয়েছে যাদের কোনও রোজগার নেই। একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে তারা রোজগারের সব উপায় হারিয়েছে। সেই ধরনের পরিবারের কাছে মহিলাদের স্বনির্ভর করার এই উদ্যোগ আশার আলো বহন করে এনেছে। সুন্দরবনে ১১০ থেকে ১২৫ জন মহিলা কাজ শিখে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রকল্পগুলো ভাগ করে প্রতিটিতেই একজন করে টিম লিডার বা দলনেত্রী রাখা হয়েছে। তিনিই বাকিদের কাজ শেখানো, কাজ দেওয়া ও সেই কাজ তুলে উড়ানের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। এইভাবেই প্রকল্পগুলো চলছে। একটু একটু করে মেয়েদের এগিয়ে দেওয়াই উড়ানের উদ্দেশ্য। শান্তনুর কথায়, ‘মেয়েরা পারে না এমন কাজ নেই। শুধু সামান্য সাহায্যের অপেক্ষা।’ সেই সাহায্যের হাতটুকু বাড়িয়ে দিতেই তাঁর সংস্থা এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছে। মেয়েদের উন্নততর জীবন তৈরিই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য।
যোগাযোগ: ৯৩৩১৭২১৯১৪