হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে পারেন। চলচিত্র ও যাত্রা শিল্পী, পরিচালকদের শুভ দিন। ধনাগম হবে। ... বিশদ
কলকাতার মেয়ে অ্যানি সিংহ রায়ের নামটি খবরের শিরোনামে পৌঁছেছিল পেশাগত কারণে। তিনিই ভারতের একমাত্র মহিলা টানেল ইঞ্জিনিয়ার। মাটি কেটে সুড়ঙ্গ খোঁড়েন! পাতালরেলের লাইন বসান। এই কাজে একমাত্র মহিলা হওয়ায় বহু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। তবু কাজ করার অদম্য ইচ্ছেকে সম্বল করে এগিয়ে গিয়েছেন। আমরা মেয়েরা-র পাঠকদের বললেন, লক্ষ্য স্থির থাকলে বাধা নেহাতই সাময়িক ব্যাপার, অনায়াসেই তা কাটিয়ে ওঠা যায়।
ভিন্ন কাজের নেশা
ছোট থেকেই কিছু অন্য ধরনের প্রবণতা ছিল অ্যানি সিংহ রায়ের। যন্ত্রের প্রতি ছিল ভীষণ আকর্ষণ। তাঁর কথায়, ‘বাড়িতে যা আসত তারই খোলনলচে খুলে দেখতাম!’ কিছু জিনিস জোড়া লাগত কিছু বা খারাপও হয়ে যেত এই খোলাখুলির ঠেলায়। তাই বলে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার পাত্রী তিনি ছিলেন না। একবার বাবার একটা ঘড়ি খুলে ফেলেছিলেন দেখার জন্য। কীভাবে তা চলে, ম্যাগনেট কোথায় থাকে, কল-কব্জাগুলো অদলবদল করলে কী হয়— এইসব দেখার অমোঘ আকর্ষণ ছোট থেকেই অ্যানিকে পেয়ে বসেছিল। সেই সময়ই তিনি স্থির করেন, বড় হয়ে যন্ত্র নিয়ে কাজ করবেন। তারপর যত বড় হলেন, বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ ততই বাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে হয়ে উঠলেন টানেল ইঞ্জিনিয়ার।
সুড়ঙ্গের সন্ধানে
টানেল ইঞ্জিনিয়ারিং বা সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে অনেক বড় বড় মেশিন দরকার হয়। মাটি কাটতে হয়, ওপরের মাটিটা শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। যন্ত্র ছাড়া এই ধরনের কাজ অসম্ভব। আর সেই যন্ত্র চালানোর কাজটা সাধারণত ছেলেরাই এতদিন করে এসেছে। ফলে সেখানে যখন একজন মহিলা গিয়ে উপস্থিত হল, তখন সবাই খুব অবাক হয়েছিল, জানালেন অ্যানি। তাঁর মন্তব্য, ‘আমাদের সমাজের একটা ধারণা আছে যা-ই সুললিত, তা-ই মহিলা চালিত। ফলে মেয়েরা কাঠখোট্টা মেশিন চালানোর কাজ করবে, এমন চিন্তা আমাদের সমাজে কল্পনারও অতীত। আর এই আদি অকৃত্রিম ধারণাই আমার কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’
শুরুর দিনগুলো
‘২০০৭ সাল। খবর পেলাম দিল্লি মেট্রোর কাজ শুরু হতে চলেছে। আমার তখন কাজের ভীষণ দরকার। বাবা মারা গিয়েছিলেন। আর গোটা সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিল আমার ওপর,’ বললেন অ্যানি। খুবই মধ্যবিত্ত তাঁদের পরিবার। সে অর্থে সচ্ছলতার মুখ কোনওদিনই দেখেননি। পড়াশোনার জন্য শিক্ষা ঋণ নিয়েছেন। পড়তে পড়তে নিজের দৈনিক খরচ চালানোর জন্য কখনও গ্যারেজে, কখনও কফিশপে কাজ করেছেন। সেই কাজের সূত্রে জমানো টাকা নিয়ে অ্যানি দিল্লি পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে মাত্র পনেরো হাজার টাকা মাইনের চাকরিতে যোগ দেন। তার প্রায় পুরোটাই মাকে পাঠাতেন সংসার চালানোর জন্য। নিজের কাছে সামান্য কিছু টাকা রাখতেন। বন্ধুর বাড়িতে থাকতেন, থাকার খরচ বাঁচানোর জন্য। দিনে একবেলা খেতেন, তাও কোনওক্রমে। তার সঙ্গে ছিল কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের অসহযোগিতা। তবু হার মানেননি। দাঁতে দাঁত চেপে চাকরি করেছেন। হয়ে উঠেছেন কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য।
অনুভূতির নানা স্বাদ
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একলা মহিলার সাফল্য একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর এবং অসাধারণ একটা অনুভূতি, জানালেন অ্যানি। তাঁর কথায়, ‘আমি যখন সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে যোগ দিই, তখন আমার সহকর্মীদের কোনও ধারণাই ছিল না একজন মহিলার সঙ্গে তাদের কাজ করতে হতে পারে। আমায় দেখে তারা অবাক হয়ে গিয়েছিল। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। বরং চূড়ান্ত অসহযোগিতা করেছে। তাদের নজরেই যেন হেনস্থার ছায়া থাকত। এক এক সময় লজ্জা পেয়ে যেতাম।’ নির্মাণের কাজে মহিলা হিসেবে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে অ্যানির। সহকর্মীদের লাঞ্ছনা, অবজ্ঞা সবই সহ্য করেছেন তিনি। সিনিয়ররা তাঁকে ডকুমেন্ট ফাইলিং সেকশনে ঠেলে দিয়েছে। আর লেবার শ্রেণির সহকর্মীরা কটু মন্তব্য করেছে। কাজের সময় ফুট কেটেছে। ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।
লম্বা চুল থেকে বয় কাট
পোশাক, চেহারা ইত্যাদি নিয়েও তাঁর উদ্দেশ্যে বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েনি কেউ। অ্যানি বললেন, ‘যন্ত্র নিয়ে কাজ করতে গেলে নিজেকে আমূল বদলে ফেলতে হয়। টাইট ফিটিংস পোশাক পরা অভ্যাস করতে হয়, চুল কেটে ছোট করে রাখতে হয়। আমার খুব লম্বা চুল ছিল। কাজের ক্ষেত্রে তা যখন অন্তরায় হয়ে ওঠে তখন আমায় নিয়ে সহকর্মীরা হাসাহাসি করতে লাগল। ভাবখানা এমন যেন এই তো মহিলা এসেছে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে। সামান্য চুলটাও গুছিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই। ভীষণ রাগ হল আমার। নিজেই নিজের চুল কেটে ফেললাম। বয় কাট চুল, পরনে জিনস আর টি শার্ট, তাও কলার দেওয়া। দেখি এবার ছেলেরা কী বলে? সবাই অবাক হয়েছিল, কিন্তু মুখে কোনও কথা বলেনি। আমিও নিজের কাজে মন দিতে পেরেছিলাম।’ ক্রমশ অ্যানি সাইট কালচারটা আয়ত্ত করে নিতে শুরু করলেন। ছেলেদের সঙ্গে মিশে তাদের ভাষা, কথা বলার ধরন, চালচলন সবই অ্যানির হাতের মুঠোয় চলে এল। হাবেভাবে তিনি ‘নারীসুলভ কমনীয়তা’ ঝেড়ে ফেললেন। সুললিত ভাব তখন তাঁর পক্ষে বেমানান। এইভাবেই চলছিল, তবুও পুরুষ সহকর্মীদের চোখে তিনি মেয়েমানুষই রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে মশকরা যেন মামুলি ব্যাপার। প্রতি পদে একটা লড়াইয়ের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। অ্যানি বললেন,‘ভারতীয়দের মধ্যে এই নেতিবাচক ধ্যানধারণা যতটা প্রবল, বিদেশিদের মধ্যে কিন্তু ততটা নয়। আমার নিজের লোকেদের কাছ থেকে যেমন বাধা পেয়েছি, বিদেশিদের কাছে তেমনটা পাইনি। সেখানে দেখা হয়েছে আমি কাজটা জানি কি না। কিন্তু আমাকে মহিলা বলে কখনওই ব্যঙ্গ করা হয়নি। ভারতীয় পুরুষরা মেয়েদের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই আটকে রাখতে চায়। একটা ভয়ও বোধহয় তাদের মনে কাজ করে এই বুঝি মেয়েরা পুরুষদের ছাপিয়ে গেল, এই বুঝি মেয়েরা ঘরে-বাইরে সমান পারদর্শী হয়ে উঠল! এই হারানোর ভয় থেকেই ভারতীয় পুরুষ সমাজ মহিলাদের অবদমন করে। বিদেশে এই সংস্কৃতিটা সেভাবে প্রকট নয়।’
হল সাহেবের সঙ্গে
‘বিদেশি এক বসের সাহায্য না পেলে হয়তো আমাকেও রণে ভঙ্গ দিতে হতো,’ বলছিলেন অ্যানি। তিনি তখন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। তায় মহিলা। যাই হোক, একদিন সাইটে গিয়ে দেখলেন মাটি কাটার যন্ত্রের বুম নাকি কাজ করছে না। বুম না উঠলে মাটি কাটা যাবে না। তাহলে সুড়ঙ্গও তৈরি হবে না। সবাই চিন্তিত। কিন্তু অ্যানির মতামত কেউ নিচ্ছে না। এমন সময় তাঁদের প্রোজেক্টের যিনি বস, এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার হল এলেন সাইটে। এসেই তিনি প্রশ্ন করতে লাগলেন, সবাই যথাসাধ্য উত্তর দিচ্ছিল। কিন্তু কোনওটাই বসের মনে ধরছিল না। এমন সময় তিনি অ্যানিকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন। বিভিন্ন প্রশ্নের পর তাঁকে বললেন মেশিন খুলে গণ্ডগোলের উৎস সন্ধান করতে। সেইমতো অ্যানিকে মেশিনের একটা বল্টু খুলে দেখতে হয়েছিল গলদ কোথায়। সেখানে সামান্য চাপ দিতেই কেলেঙ্কারি। প্রেশারের কারণে হাইড্রলিক তেল ফোয়ারার মতো উঠে অ্যানিকে স্নান করিয়ে দিল। কিন্তু গলদটা ধরা পড়ল এবং তা ঠিক করে অ্যানি ওপরে উঠে এলেন তেল চুপচুপে অবস্থায়। জার্মান সাহেব কিন্তু তাঁর এই অবস্থা দেখে একটুও ঠাট্টা করেননি। বরং বলেছিলেন, ‘এইভাবে হাতেকলমে কাজ করতে হবে। না হলে শিখবে কী করে?’ বসের এই কথায় দারুণ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন অ্যানি। সেই কথাকেই জীবনের মন্ত্র হিসেবে নিয়ে হাতেকলমে কাজ করতে শুরু করেছিলেন তিনি।
মানসিকতার বদল কোথায়?
‘আমাদের পুরুষদের নজরটা বড্ড খারাপ,’ বললেন অ্যানি। তাঁর মতে, ‘কোনও সিনিয়র যদি তার জুনিয়রকে সাহায্য করে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে একটা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য পুরুষরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই মানসিকতা যত দিন না বদলাচ্ছে ততদিন আমাদের সমাজে মেয়েদের সেই অর্থে উন্নতি অসম্ভব। এবং পুরুষদের এই যে ধারণা, এতে মেয়েদেরও যথেষ্ট অবদান আছে। পুরুষ যখন মেয়েদের বদনাম করে তখন মেয়েরাও অনেক সময় তাদেরই সমর্থন করে। নিজের গায়ে আঁচ না লাগলে মেয়েরা কিন্তু প্রতিবাদ করে না। আর প্রতিবাদ যতদিন না হবে, ততদিন ছেলেদের চিন্তাধারা বদলাবে না। মেয়েরাই নিজেদের বিচারটা রূপের গণ্ডিতে বেঁধে রেখেছে। একটা পোশাক পরার সময় তারাই নিজেদের আয়নায় বারবার দেখে। সমাজ তার এই পোশাকটা আদৌ মেনে নেবে কি না, এই চিন্তাটা মেয়েদের মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খায়। তারা যেন পুরুষের স্বীকৃতি চায়। এই ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব।’ অ্যানির কথায়, মেয়েরা অনেকটা পথ এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আরও অনেকটা পথ এগতে হবে।
পরিশ্রম আর নিষ্ঠা
‘মেয়েরা আকাশ ছুঁতে পারে। শুধু লক্ষ্যে স্থির থাকা দরকার,’ দাবি অ্যানির। তাঁর কথায়, ‘নিজেকে নিজেই স্কুলিং করাতে হবে। জপের মন্ত্রের মতো নিজেকে বোঝাতে হবে যে আমরা পারি। বিরূপ পরিবেশের মধ্যে থেকেও আমরা উঠে আসতে পারি। নিজেদের কর্মদক্ষতার কারণেই উল্লেখযোগ্য হতে পারি। সমাজ বাধা দেবে, সংসার পিছনে টেনে ধরবে। কিন্তু মেয়েদের আটকে গেলে চলবে না। নিষ্ঠা, ভালোবাসা এবং মনের জোর নিয়ে কোনও কাজ করতে চাইলে সাফল্য অবধারিত। ভবিষ্যতেও মেয়েদের মনে রাখতে হবে, তারাই এই সমাজের অর্ধেক আকাশ। ফলে ঘরের চার দেওয়ালের ভেতর তাদের আটকে থাকা উচিত নয়। বরং বাঁধন ভেঙে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই তাঁদের কর্তব্য। বাধা আসে আসুক, তবু ভয় পেলে চলবে না। বরং আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হবে। এক না একদিন ঠিকই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছবে মেয়েরা।’
নাম রহস্য
বাঙালি মেয়ের এমন ইংরেজি নাম কেন? প্রশ্ন শুনে হেসে উঠলেন অ্যানি সিংহ রায়। বললেন ‘নামের একটা গল্প আছে বটে। ছোটবেলায় ছিলাম ভীষণ ডানপিটে। শিয়ালদার পুরনো বাড়িতে জানলার বড় গরাদ ছিল। সেই গরাদ গলে রাস্তায় নেমে পড়তাম। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতাম ততক্ষণই ছুটতাম। আমাকে আটকায় এমন সাধ্য কারও ছিল না!’ একদিন হলিউডের একটা ছবি দেখছিলেন অ্যানির বাবা। সেই ছবির নামচরিত্র অ্যানিও ভীষণ দুরন্ত। সারাক্ষণই ছুটে ছুটে কেটে যায় তার। সিনেমার সেই একরত্তি মেয়েটিকে দেখেই বাবা নিজের মেয়ের নাম রাখেন অ্যানি। তাই নাকি বাঙালি মেয়ের এমন ইঙ্গো নাম!
ভালোলাগা সবকিছু
চেহারায় ও চরিত্রে ডানপিটে টমবয় হলেও অ্যানি কিছু ক্ষেত্রে অনেকটাই ‘ঘরোয়া।’ তিনি ভালোই রান্না করতে পারেন। তাঁর হাতের চালের পায়েস নাকি অনবদ্য। এছাড়া মাটন কষাও তিনি দারুণ বানান। তবে রান্নাটা করেন নেহাতই প্রয়োজনে। তাঁর ভালোবাসার মধ্যে রান্না পড়ে না। যন্ত্র ছাড়া তাঁর ভালোবাসা বলতে সাঁতার আর আঁকিবুকি। ছুটি পেলেই স্কেচবুক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মানুষের মুখ আঁকেন, সিনারি আঁকেন। তাহলে কি ইঞ্জিনিয়ার না হলে রং-তুলি নিয়েই থাকতেন অ্যানি? মোটেও না, ছোটবেলায় তিনি একবার ভেবেছিলেন ফ্যাশন দুনিয়ায় নাম লেখাবেন। তবে বিউটি আর ফ্যাশনের জগতের হাতছানি অবশ্য খুব বেশিদিন টেকেনি। যন্ত্রের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে একমাত্র মহিলা হয়ে ওঠা? অ্যানির কথায়, ‘ওটা বোধহয় আমার জীবনের ভবিতব্যই ছিল।’