অর্থকর্মের ক্ষেত্রে প্রগতি বজায় থাকবে। মরশুমি দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়বে। শরীর-স্বাস্থ্য এক প্রকার থাকবে। ... বিশদ
আজ নারী শিক্ষিত। আজ নারী স্বনির্ভর। তবু আজও নারী স্বাধীন নয়। শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা তাহলে নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে ব্যর্থ! সনাতন প্রথামতে আজও তাই বিবাহের মন্ত্রে কন্যাকে সম্প্রদান করা হয় পাত্রের কাছে। অর্থাৎ পিতার কাছ থেকে নারী চলে যায় স্বামীর দায়িত্বে। আগেকার দিনে এই রীতি যদি বা সমর্থন করা যেত, এখন তো তা কোনওমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবু প্রথাগত বিবাহের এই দিকটি নিয়ে ততটা প্রশ্ন ওঠে কি আমাদের সমাজে? মেয়েরাও কি এই নিয়ে আদৌ ভাবে? আজকের আধুনিক সমাজে কন্যা সম্প্রদান কি সত্যিই প্রয়োজনীয়? সাক্ষাৎকারে এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর দিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপিকা তথা মহিলা পুরোহিত নন্দিনী ভৌমিক।
আজকের আধুনিক সমাজেও কি কন্যা সম্প্রদান প্রথা যুক্তিযুক্ত?
প্রথমেই বলে রাখি, বিয়েতে কন্যা সম্প্রদানের প্রথা বৈদিক যুগে ছিল না। পরবর্তীকালে নারী যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে, বাল্য বিবাহের রীতি যবে থেকে প্রচলিত হয়ে ওঠে আমাদের সমাজে, তবে থেকেই কন্যা সম্প্রদান প্রথাও চালু করা হয়। এক্ষেত্রে প্রথার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলার আগে সমাজের একটা চিত্র কল্পনা করে নেওয়া দরকার। তখন মেয়েদের আট-নয় বছরে বা তার চেয়েও ছোট বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো। স্বামীটি কিন্তু সেই তুলনায় বয়স্ক। কলেজে পাঠরত তো বটেই, অনেকক্ষেত্রে আবার চাকরিও করে। বয়সের এই বিপুল ফারাকে স্বামী যে তার ছোট স্ত্রীয়ের দায়িত্ব নেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আর না নিলেও তো চলবে না, আট বছরের বালিকা কি নিজের দায়িত্ব নিতে পারে? এই অবস্থায় বাবার হাত থেকে মেয়েকে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া বা সম্প্রদান করার রীতি সমর্থনযোগ্যই বটে। কিন্তু ক্রমশ সমাজ বদলেছে। বাল্য বিবাহের রীতি আজ আর প্রচলিত নয়। মেয়েরাও এখন শিক্ষিত ও স্বনির্ভর। সেক্ষেত্রে আজকের দিনে কন্যা সম্প্রদান যে নেহাতই অমূলক তা বলাই বাহুল্য।
সমাজের চোখে মেয়েরা কি তবে দানের বস্তু?
একেকটা সময় একেকরকমভাবে মানুষের মূল্যায়ন করে। আর সময় যত পালটায়, মানুষের চিন্তাধারাও ততই বদলায়। তবে কন্যাকে সম্প্রদান করার অর্থ কখনওই দান নয়, বরং কন্যার ভার বা দায়িত্ব পিতার হাত থেকে স্বামীর হাতে সমর্পণ। এই ভার তুলে দেওয়া বা দায়িত্ব অন্যকে সমর্পণ করার রীতি কারও অপছন্দ হতেই পারে। তাই বলে এটা ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে কন্যাকে সম্প্রদান করা হতো বলেই তাকে সমাজ দানের বস্তু হিসেবে দেখত। আর এখন তো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। কন্যাকে দানের বস্তু হিসেবে দেখা হলে ঘরে ঘরে কন্যাই একমাত্র সন্তান হতে পারত কি?
নারীকে কি কখনও বাবা, কখনও স্বামী, কখনও বা পুত্রের অধীনে বলেই মনে করা হয়?
খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভারতীয় মনোভাব অনুযায়ী এখনও নারীর ওপরেই সংসার সামলানোর দায়িত্ব বর্তায়। আগে মেয়েরা শুধুই অন্দরমহলের বাসিন্দা ছিলেন। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা নিয়েই ছিল তাঁদের জীবন। সেই সময় নারীকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল পুরুষের কাঁধে। এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই। মেয়েরা শিক্ষিত তো বটেই, অনেকক্ষেত্রেই স্বনির্ভরও। তবু সংসার পালনের মূল দায়িত্ব কিন্তু আজও মেয়েদের ওপরেই পড়ে। আর ছেলেরাও এখনও দায়িত্ব নেওয়ার অভ্যাসটা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। তাই সমাজ আজও নারীর অরক্ষিত রূপের সঙ্গেই অভ্যস্ত। আমাদের সমাজ এখনও ততটা উদার হতে পারেনি। তাই মেয়েরাও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি। এখনও মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আজও মেয়েদের পুরুষরূপী রক্ষাকর্তার প্রয়োজন হয়। তাই এই উন্নততর সমাজে আজও নারী কখনও বাবা, কখনও স্বামী আর কখনও ছেলের অধীনে।
হিন্দুধর্ম মতে বিবাহে কি কন্যা সম্প্রদান আবশ্যিক?
হ্যাঁ। গতানুগতিক ধারা অনুযায়ী এই প্রথা আবশ্যিক। তবে হিন্দুধর্ম মতে বিয়ের অনুষ্ঠানে বদল আনা উচিত বলেই আমার মনে হয়। কারণ বৈদিক যুগেও তো হিন্দুধর্ম মতেই বিবাহ হতো এবং তাতে কন্যা সম্প্রদানের রীতি ছিল না। তাহলে এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন সম্প্রদান আবশ্যিক হবে? তবু আজও পুরোহিতরা মধ্যযুগীয় বিবাহপ্রথাকেই মেনে চলতে ভালোবাসেন। তাই গতানুগতিকতা বজায় রেখে কন্যা সম্প্রদান বিয়ের অঙ্গ হিসেবে চলছে, চলবে।
প্রথাগত বিবাহে বদল আনার জন্য আপনি কতটা ও কীভাবে সচেষ্ট?
আমি একা নই, আমাদের চারজনের একটি দল রয়েছে। নাম শুভমস্তু। আমরা সনাতন বৈদিক প্রথা অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করি। কিছু মন্ত্র ও কিছু গানের মধ্য দিয়ে পাত্রপাত্রীর চার হাত এক হয়। আমাদের দলে আমি ছাড়া আরও যাঁরা আছেন তাঁরা হলেন রুমা, সেমন্তী ও পৌলমী।
আমরা কেউই পদবি ব্যবহার করি না। জাতপাতের বিভেদ এড়ানোর জন্যই পদবি বর্জন। রুমা আর আমি দু’জনেই সংস্কৃতের ছাত্রী। মন্ত্র পড়ার দায়িত্ব আমাদের। সেমন্তী আর পৌলমী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। রবীন্দ্রনাথের গান ও মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। কিছু আচার আমরা বাদ দিয়েছি। কন্যা সম্প্রদান, কনকাঞ্জলি আমাদের বিবাহ প্রথার অঙ্গ নয়। তাছাড়া বিয়ের অনষ্ঠানে যে শুধুই এওস্ত্রীরাই অংশ নিতে পারবেন, বিধবারা বাদ পড়বেন তাও আমরা মনে করি না। ‘শুভমস্তু’তে আমরা মনে করি বিবাহ নামক পুণ্য অনুষ্ঠানকে আনন্দময় করে তুলতে সকলের সমবেত উপস্থিতি জরুরি। তাছাড়া বিয়েতে আমরা পাত্র ও পাত্রী এবং তাদের পরিবারকে একই আসনে বসাই। বর ও কনের মায়ের উপস্থিতিও আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য অংশ।
হিন্দু নিয়মগুলো ভাঙার সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন?
যা-ই নতুন, তাকেই বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়। আমাদেরও হয়েছে। প্রথমদিকে লোকে আমাদের নিয়মগুলো মেনে নেননি। তবে ক্রমশ সময় পাল্টাচ্ছে, লোকের চিন্তাধারা বদলাচ্ছে। এখন পাত্র ও পাত্রী আমাদের এই নতুন ধরনের বিবাহ প্রথা দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন এবং আমরা ক্রমশ সমাজে গৃহীত হচ্ছি।
মধ্যযুগীয় হিন্দু বিবাহে বদল আনা দরকার এমনটা মনে হল কেন?
অধ্যাপনা করতে গিয়ে প্রথম এই ভাবনাটা মনে এসেছিল। নতুন প্রজন্মকে ঘাঁটতে ঘাঁটতে, তাদের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে মিশতে মিশতে দেখেছিলাম তারা বিভিন্ন প্রথার দিকে আঙুল তুলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করছে। তখনই মনে হয়েছিল মধ্যযুগীয় প্রথাগুলোর বদল দরকার। আর সেই বদলের জন্য আমাদের খুব একটা দূরে যেতে হয়নি। একটু পিছিয়ে গিয়ে বৈদিক বিবাহ প্রথাগুলো ঘেঁটে দেখলাম তা অনেক উন্নত। তখনই এই প্রথায় বিয়ে দেওয়ার কথা মনে হল। তারপর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আমাদের দল গড়ে উঠল। বছর তিনেক আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছি।
কন্যা সম্প্রদান ব্যতীত বিবাহ পাত্র ও পাত্রীর বাড়িতে কতটা গৃহীত?
পাত্র ও পাত্রী দু’জনেই এই নতুন প্রথাকে মুক্তহস্তে আলিঙ্গন করেছে। তাদের বাড়ির লোকেরাও অনেকেই উদারভাবে এই প্রথা মেনে নিচ্ছেন। আর আজকের মেয়েরা যে বাবার হাত থেকে স্বামীর হাতে সমর্পিত হতে চায় না তা তো বলাই বাহুল্য।