জলপথ পরিবহণ কর্মে বিশেষ শুভ। হস্তশিল্পী, হিসাব-শাস্ত্রবিদ প্রমুখের কর্মে উন্নতি ও সুনাম। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। ... বিশদ
অরুণাচল প্রদেশের উত্তরে রয়েছে আপার সিয়াং জেলা। এই জেলার ঠিক উপরে স্বশাসিত তিব্বতের দক্ষিণে রয়েছে মেডগ কাউন্টি। এই কাউন্টিতে খরস্রোতা ইয়ারলুং সাংপো নদীর উপরে চীন বানাতে চলেছে ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারত-চীন বিতর্কিত সীমান্তের অনতিদূরে অরুণাচল প্রদেশে ঢোকার বাঁকের মুখে তৈরি হবে বাঁধটি। মনে করা হচ্ছে, এটি শুধু বিশ্বের বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই নয়, সবচেয়ে বড় পরিকাঠামো। গত ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা করে চীন জানিয়েছে, ভাটির (লোয়ার রাইপেরিয়ান) দেশের সঙ্গে জলপ্রবাহ নিয়ে বেজিং আলোচনা করবে।
প্রস্তাবিত বিশ্বের বৃহত্তম এই নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বেজিং-এর তরফে যুক্তি— এক, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং দুই, আঞ্চলিক উন্নয়ন। ইয়ারলুং সাংপো-র জলবিদ্যুৎ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে যা চীনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে, কর্মসংস্থান এবং পরিকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে এই বাঁধ সাহায্য করবে তিব্বতের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও। এদিকে ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে এই নদী দু’টি প্লেট-এর সংযোগস্থলে অবস্থিত। তাই এখানে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে কৃত্রিম উপায়ে বাধা দেওয়া হলে আশঙ্কা বাড়বে ভূমিকম্পের। যা নিয়ে একটি কথাও বেজিংয়ের তরফে শোনা যায়নি।
চীনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাও নিংয়ের কথায়, ‘যোগাযোগের যে ব্যবস্থা আছে, তার মাধ্যমে চীন ভাটির দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে এবং নদীর তীরে জনগণের সুবিধার জন্য দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ত্রাণসহায়তা বাড়াবে।’ এই ভাটির দেশ বলতে প্রধানত ভারত ও বাংলাদেশকে বোঝায়। নাম না করে দুই দেশকে আশ্বস্ত করে নিং বলেছেন, প্রকল্প ভাটির দেশকে প্রভাবিত করবে না। কিন্তু এই যুক্তির
সারবত্তা যে নেই, তা নিয়ে শুরু থেকেই সরব ভারত। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিংয়ের কথায়, চীনের ঘোষিত প্রকল্পের বিষয়টি সরকার নোট করেছে। গত ৩০ ডিসেম্বর এই ইস্যুতে চীনের কাছে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে ভারত। বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। এই বাঁধ নিয়ে চীন যাতে আরও স্বচ্ছতা বজায় রাখে, সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০০৬ সালে স্থাপিত ‘ইনস্টিটিউশনালাইজড এক্সপোর্ট লেভেল মেকানিজমে’র মাধ্যমেই সীমান্ত পার নদী নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারত আলোচনা চালাতে চায়।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের যুক্তি— ইয়ারলুং সাংপো, যা ভারতে সিয়াং ও ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত, যা একাধিক রাজ্যের জীবনরেখা স্বরূপ। ভারত এই নদীর নিম্নতীরবর্তী রাষ্ট্র হওয়ায় নদীর জলকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে চীন। প্রবল বর্ষায় চীনের তরফে বাড়তি জল ছাড়া হলে তা অসম এবং অরুণাচল প্রদেশের বন্যা পরিস্থিতি ঘটাতে পারে। অন্যদিকে, শুখা মরশুমে বেজিং নদীর জল আটকে রাখলে প্রভাব পড়বে এই অঞ্চলের কৃষি, পানীয় জল সরবরাহ এবং জলবিদ্যুৎ শক্তির উপরে। শুধু তা-ই নয়, জলের প্রবাহ হ্রাসের ফলে নদীতে পলি জমবে, প্লাবনভূমির মাটির উর্বরতা কমাবে। ভারতের মোট মিষ্টি জলের ৩০ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে, যা এই অববাহিকা অঞ্চলের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্র্যও। লক্ষণীয়, নদীর জলবণ্টন নিয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিবাদ তত্ত্বগতভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব, যেহেতু দুই দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি রয়েছে ভারতের। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রে এখনও তা না থাকায়, বেজিং-এর বিরুদ্ধে কোনও কূটনৈতিক চাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না ভারতের পক্ষে। এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ!
এটা ঠিক, সস্তায় তেল-গ্যাসের জমানা শেষ। আগামী দিনে বিশ্বজুড়ে তেল-গ্যাসের দাম বাড়তেই থাকবে। এই কারণেই জ্বালানি শক্তির বিকল্প উৎসগুলি দিন দিন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে জলবিদ্যুৎকে প্রাধান্য দেওয়া বিপদকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৬০ হাজার বড় বাঁধের অধিকাংশই গত সাত দশকে নির্মিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই বাঁধ নির্মাণ একটি ভয়ঙ্কর গতিতে চলছে। ২০১৪ সালে কমপক্ষে ৩৭০০টি উল্লেখযোগ্য বাঁধ নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনাধীন ছিল। তখন থেকে বাঁধের গর্জন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল বিশ্ব এখন এই ধরনের বাঁধ নির্মাণের একটি হটস্পট হয়ে উঠেছে। তার প্রমাণ চীন। শুধু নিজেদের মাটিতেই নয়, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চীন ৩৮টি দেশে চীনা প্রযুক্তিতে মোট ২৭ গিগাওয়াটের বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে চার হাজার চারশো কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়ও বাঁধ নির্মাণে দ্বিধা করছে না চীন। চীন ভালো করেই জানে, ২০০৮ সালের ওয়েনচুয়ান ভূমিকম্পের (যার ফলে তিব্বত মালভূমির পূর্বাঞ্চলে ৮৭ হাজারের বেশি লোক মারা গিয়েছিল) সঙ্গে সেই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে বানানো নতুন জিপিংপু বাঁধের যোগসূত্র থাকার কথা বলেছিলেন তাঁদের বিজ্ঞানীরাই।
শুধু তাই-ই নয়, বাঁধগুলির কারণে সামাজিক ক্ষেত্রেও চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। ২০০৭ সালে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও জানিয়েছিলেন, জলপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাঁদের ভাটি এলাকার ২ কোটি ২৯ লাখ লোককে সরিয়ে নিতে হয়েছে। ২০১২ সালে চালু হওয়া বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎকেন্দ্র দ্য থ্রি জর্জেস ড্যাম ১৪ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি।
তবে ইতিবাচক দিক হল, ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখনও পাকিস্তানের মতো তলানিতে এসে ঠেকেনি। ২০২০ সালে ভারত ও চীনের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কিছু সেনার মৃত্যুর পরেও দিল্লি–বেজিং কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছে। এর ফলে ২০২৪ সালে ভারত ও চীনের সম্পর্কের খানিকটা উন্নতি হয়েছে। গত বছরে ভারত দ্বিপাক্ষিকভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে চীনের সঙ্গেই। ১১৮ বিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে আমেরিকা নেমে গিয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। গত বছরের শেষের দিকে দুই দেশই জানিয়েছে, প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত নিয়ে তাদের মধ্যে চলা দীর্ঘদিনের বিবাদ মেটাতে তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে। এই ধরনের বিবৃতি তারা অতীতে দেয়নি। কিন্তু ইয়ারলুং সাংপো নদীর উপরে চীনের বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেবে— সেটাই স্বাভাবিক।
তবে এর প্রভাব কাটাতে অরুণাচলে সিয়াংয়ের উপরে বড় বাঁধ গড়ার কথা ভাবছে ভারতও। জলশক্তি মন্ত্রক জানিয়েছে, অরুণাচলে আপার সিয়াং ও সিয়াং জেলার মধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াটের বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। যা চীনা বাঁধের প্রভাবকে মোকাবিলা করবে। আপার সিয়াংয়ে এই প্রকল্প অতিরিক্ত জলের ভার বহন করবে ও জলের ঘাটতি হলে সঞ্চিত জল দিয়ে তা সামলাবে। তবে বিদেশনীতির অস্ত্র হিসেবে অরুণাচলে বড় বাঁধ গড়া কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বড় বাঁধ গড়তে বিপুল অরণ্য ধ্বংস হবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনও শুরু হয়েছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু সহ প্রায় গোটা মন্ত্রিসভা বাঁধ নির্মাণের পক্ষে একাধিক যুক্তি দিয়েছেন। অরুণাচলের পর্যটনমন্ত্রী ওজিং তাসিং বলেছেন, বাঁধ নির্মাণ না হলে চীন অরুণাচলকে বিরাট বিপদে ফেলবে। চীনের প্রকল্পের প্রভাব শুধু অরুণাচলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা পশ্চিমবঙ্গকেও বিপদে ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তাসিং।
তাহলে কি চীনকে ঠেকাতে ‘বাঁধের জবাবে বাঁধ!’ নীতি নেবে ভারত? নাকি ‘চায়না-ফোবিয়া’ থেকে বেরিয়ে এসে কূটনৈতিক ফ্রন্টে লড়াই শুরু করবে। নতুন বছরে চীন-ভারত সংঘাত কোন দিকে মোড় নেবে তা দ্রুত ঠিক করতে হবে সাউথ ব্লককেই!