কাজকর্মের ক্ষেত্রে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। ক্রীড়াবিদদের সাফল্য লাভের সম্ভাবনা। পারিবারিক ক্ষেত্রটি মোটামুটি থাকবে। ... বিশদ
বাংলার রাজনীতিতে ‘অডম্যান’ দলবদলু নির্ভর সাম্প্রদায়িক বিজেপি দক্ষিণবঙ্গ তো বটেই দ্রুত পায়ের তলার মাটি খোয়াচ্ছে উত্তরবঙ্গেও। সিতাই গেল, মাদারিহাটও রইল না। মেদিনীপুরে সিপিআই প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়েছে। আসলে উত্তরের মানুষ গেরুয়া দলের বাংলা ভাগের চক্রান্ত মেনে নেয়নি। চা বাগানের শ্রমিক ক্ষিপ্ত তাঁর প্রতিশ্রুতিপূরণের কোনও চেষ্টাই করেনি মোদির বিজেপি। উল্টে বিভাজনের বিষ ঢেলে বাংলার আর্থসামাজিক কাঠামোকে দুর্বল করার চক্রান্ত হয়েছে পদে পদে। এই নির্বাচন আর একটা কাজও করেছে সচেতনভাবে। রাজ্যের ত্রিমুখী লড়াইয়ের পরিবেশকে চতুর্মুখী করে দিয়েছে। কংগ্রেস আলাদা লড়লে ভোট ভাগাভাগি বাড়বে বই কমবে না। এরকম চললে ১৬ মাস পর যে বিধানসভা ভোটের লড়াই হবে তাতে বিরোধীদের অবস্থা আরও শোচনীয় হবে।
১৪ আগস্ট মধ্যরাতে রাত দখলের উৎসাহ দেখে এ রাজ্যের বামপন্থীরা স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্ন দেখা দোষের নয়, কিন্তু ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার খোয়াব মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। মাঠে ময়দানে বিচার চাওয়ার আড়ালে ফিসফাস শুরু হয়েছিল, এবার আবার আলিমুদ্দিনের চকমেলান প্রাসাদে বুঝি নহবত বসবে, সানাই বাজবে। ঠিক যেমন বসত এগারো সালের আগে রোজ। ব্যবসায়ী, গোমস্তা এবং হার্মাদদের সেই ত্র্যহস্পর্শে যেন আচমকা দোলা। জাস্টিস ওয়ালারা রব তুললেন ক্ষমতা বদলের। বাংলার শ্রেষ্ঠ ‘উৎসব’ দুর্গাপুজো পর্যন্ত বন্ধের। আর মোদি অমিত শাহ না এলে যে বঙ্গ বিজেপির প্রচার জমে না, তাঁরা প্রমাদ গুনতে শুরু করলেন। কারণ রামের ভোটে বামেরা কোপ বসালে গেরুয়া শিবির যে চিৎপটাং। সেই অঙ্কেই গত লোকসভা ভোটে বিজেপি’র আসন ১৮ থেকে কমে ১২ হয়েছে। আরও কিছুটা ভোট কাটাকুটি হলে আসন সংখ্যা আর দু’অঙ্কেরও থাকবে না। সেক্ষেত্রে আগামী বিধানসভায় বিজেপি’র আসন তিরিশেরও নীচে চলে যাবে। আর বামেরা অক্ষয় শূন্য বুকে নিয়েই নতুন দিনের সাধনায় মগ্ন হবে।
তবু এতকিছুর পরও রাম ও বামের শিক্ষা হয় না। সাড়ে তিন মাস রাজ্য কাঁপিয়ে, হাজারো উস্কানি দিয়েও রাম বাম দুই শিবিরই শূন্যের গেরো কাটাতে পারল না। আর জি কর কাণ্ডে এক তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় গত আগস্ট মাস থেকে দেশ কাঁপানো আন্দোলনের পরেও মরা গাঙে বান তো এলই না, নিদেনপক্ষে বর্ষার জমা জলে ছিপ ফেলে ল্যাটা মাছ ধরার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হল না। অথচ একটা দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, নাগরিক আবেগকে উস্কে দেওয়ার হীন চেষ্টা কম হয়নি। মুখে বিচার চাইলেও সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা বদল। রাত, ভোর, দুপুর দখলকে স্বাধীনতা আন্দোলনের চেয়েও মহান ও পবিত্র জনজাগরণ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা জারি ছিল পুরোদমে। সঙ্গে তথ্য যাচাই না করে ক্রমাগত মিথ্যের বেসাতি। এক বিখ্যাত (পড়ুন কুখ্যাত!) ডাক্তার বলে বসলেন ১৫০ গ্রাম সিমেন মিলেছে। ভুঁইফোড় নেতানেত্রীরা আওয়াজ তুললেন, ‘দফা এক দাবি এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’। তবু ভাটার টানে মজে যাওয়া বাম ও রামের পুকুরে সামান্য স্রোত পর্যন্ত দেখা গেল না। বরং যেই রাজনীতির কারবারিরা ওই আন্দোলনকে ভোট রাজনীতির বাঁকে ফেলে জনসমর্থন যাচাইয়ের চেষ্টা শুরু করলেন এরাজ্যের মানুষ রণেভঙ্গ দিলেন। তারই পরিণাম উপ নির্বাচনের একপেশে ফল, ৬-০।
বাংলার ফল নিয়ে বিরোধীদের এই স্বপ্নভঙ্গ নতুন নয়। ১৯ মে ২০১৬, ২ মে ২০২১, ৪ জুন ২০২৪ এবং অবশেষে ২৩ নভেম্বর ২০২৪। এই দিনগুলি দুর্গাপুজোর অষ্টমী, সরস্বতী পুজো, দেওয়ালি কিংবা রামনবমীর উৎসবের স্মৃতি বয়ে আনে না। দু’শো নাচনকোঁদনের পর ভোটের ফলে বিরোধীদের হারের মাইলফলক মাত্র! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা বড় কম হয়নি। এগারো সালের ঐতিহাসিক পালাবদলের পাঁচ বছর পর কংগ্রেস ও সিপিএম জোট বেঁধেও কিচ্ছু করতে পারেনি। তারপর থেকেই এ রাজ্যে গেরুয়া রাজনীতির অনুপ্রবেশের চেষ্টা হলেও তা কোনওবারই হালে পানি পায়নি। সতেরো সালে মুকুল রায়কে বের করে একটা ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। ফলপ্রসূ হয়নি কাঁথির ব্যর্থ যুবরাজের চক্রান্তও। ইডি, সিবিআই কোমর বেঁধেও কিচ্ছুটি করতে পারেনি। মহারাষ্ট্রে বিজেপি’র জয়, ঝাড়খণ্ডে সোরেনের জয় কিংবা ওয়েনাড়ে জিতে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কার প্রবেশের চেয়েও মমতার এই জয় কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
এবার ৬টি কেন্দ্রের উপ নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটা ক্ষোভ বিক্ষোভের পরে বাড়তি আকর্ষণ গড়ে তুলেছিল। নানা মহল থেকে এটিকে ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের আগে সেমি ফাইনাল হিসেবে দেখানোরও চেষ্টা হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের সিতাই ও মাদারিহাট নিয়ে যেমন আকর্ষণ ছিল তেমনি মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার তালডাংরার রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু প্রমাণ হল, শহরের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরা ভোটযন্ত্রে শেষ কথা বলেন না। ফেসবুকও জনমত নির্ধারণ করে না। শেষ কথা বলে সাধারণ মানুষ। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁরা বাংলার বিরুদ্ধে চক্রান্ত চায় না, বদনামও চায় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চায়। গ্রাম বাংলায় এমন একটা পরিবারও নেই যেখানে মমতার একঝাঁক প্রকল্পের অন্তত একটিও ঢোকেনি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কন্যাশ্রী, বিধবা ভাতা, বাংলার আবাস, সমব্যথী— কী নেই।
বিধানসভা নির্বাচন আর ১৫-১৬ মাস দূরে। আগের সপ্তাহেই লিখেছিলাম, এমন ছন্নছাড়া পরজীবী বিরোধী শিবির দেখিনি। এটা মানতেই হবে, শাসক দলের নিচুতলার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ আছে, পদে পদে ইস্যুরও কমতি নেই। পুলিসের ভূমিকায় তাঁর অসন্তোষের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বাজির মশলা মজুত থাকলেও তা ফাটানোর লোক কোথায়? একটা গ্রহণযোগ্য মুখ নেই। সেলিম হালিম অধিকারীরা এবার ষড়যন্ত্র থামিয়ে বাংলার কথা একটু বলুন। এই ফল থেকেই স্পষ্ট বলা যায়, সওয়া এক বছর পেরিয়ে আগামী ছাব্বিশ সালের মে মাসের গ্রীষ্মের অপরাহ্ণে আবার নবান্ন দখলের জনসমর্থনের চাবিকাঠিটা অনায়াসে পেয়ে যাবেন তৃণমূল নেত্রী। পরপর চারবার। তাঁর সামনে শুধু জ্যোতি বসু। সিপিএমের বিলিতি জমিদার কমিউনিস্ট। কালীঘাটের আটপৌরে সাধারণ ঘরের মেয়ে কিন্তু এখানেও জিতে গেলেন। অদম্য সাহস আর মানুষের পাশে ৩৬৫ দিন থাকার মন্ত্রেই তিনি আর একটা ‘মাইলস্টোন’ ছোঁয়ার অপেক্ষায়। নব্য ‘পিকে’ খোঁজা সিপিএম কিংবা মোদি-অমিত শাহের ডেলি প্যাসেঞ্জারি নির্ভর গেরুয়া শিবির রাতদিন এক করেও মমতার ভাবমূর্তিতে কালি লেপতে ব্যর্থ। একবার নয় বার বার। নিশ্চিতভাবে বাংলার মানুষ ১৬ মাস পরেও মমতা আবেগেই আস্থা রাখবে।