হিমালয়ের তপস্যা শেষে গৌরীমা ঘটনাচক্রে প্রত্যাবৃত হলেন দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীগুরু কর্তৃক রোপিত বীজ শিষ্যার অন্তরে বহু সাধনায় অদ্য পত্রপুষ্পফল সংযুক্ত এক বিরাট বনস্পতি। শ্রীগুরুদেব অতিপ্রসন্ন। একদিন দক্ষিণেশ্বরে গৌরীমাতা এক সুমঙ্গল প্রভাতে তাঁর নারায়ণ সেবাকল্পে বকুল পুষ্প সংগ্রহরতা। শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন ঝাউ তলার দিক থেকে। হাতে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গাড়ুটি। শিষ্যা শ্রীগুরুদেবের উপস্থিতি মাত্রই সংগৃহীত পুষ্পরাজি নিবেদন করেন গুরুপাদপদ্মে। গুরুদেবের প্রশ্ন, “কি হচ্ছে গৌরদাসি”? গৌরীমার সাবলীল উত্তর—“এ আমার শিবপূজা।” সহসা শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্যাকে বলেন, এবং সঙ্গে বারি বর্ষণও করতে থাকেন হাতের গাড়ু পাত্র থেকে—“আমি জল ঢালি গৌরী, তুই কাদা চট্কা।” শিষ্যা মাটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপে বলেন, “কাদা কোথায় যে চটকাবো? সব তো কাঁকর।” শ্রীরামকৃষ্ণ সুস্মিত হাসিতে উত্তর দেন, “কি বললুম, আর তুই কি বুঝলি! ঢের সাধনভজন হয়েছে। এবার তোর এই তপস্যাপূত দেহটা মায়েদের সেবায় লাগিয়ে দে। এ দেশের মায়েদের বড় কষ্ট।” গৌরীমা শ্রীগুরুর কথার উত্তরে বলেন, “বেশ, ক’টা মেয়ে আমায় দাও। আমি তাদের হিমালয়ে নিয়ে গিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে এনে আবার তোমায় ফেরত দেব।” শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্যার কথার উত্তরে বলেন, “না, না তা হবে নি। এই টাউনে বসে তোকে কাজ করতে হবে।” “টাউনে বসে কাজ!”—শ্রীরামকৃষ্ণের এই আদেশ যেন গৌরীমার মস্তকে বৃশ্চিক দংশন করে ওঠে। শ্রীরামকৃষ্ণের পদতলে ভূলুন্ঠিত হয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলেন, “ঠাকুর, তোমার কাছে কি আমি এই চেয়েছি? আমি যে আমার এতকালের সাধনার মানসিকতায় একাগ্র মনে নির্জনে নির্বিকল্পত্ব লাভ করতে চেয়েছি। তোমার এই আদেশ পালন করতে পারবো না, পারবো না ঠাকুর। তুমি আমায় ক্ষমা কর। অন্য কাউকে এ আদেশ দাও।”
শ্রীরামকৃষ্ণের সুকঠোর উত্তর—“তোর ঘাড় করবে। তোর সাধনার ঘরে আমি কুলুপ দিলুম। চাবি রইলো আমার হাতে। আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন সে ঘর খোলা পাবি।” শত ক্রন্দনেও গৌরীমা শ্রীরামকৃষ্ণের কোনও প্রকার সংকল্প পরিবর্তনের আভাসটুকুও লাভ করলেন না। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দৃঢ়সংকল্পিত উপযুক্ত পাত্রী তাঁর একমাত্র সন্ন্যাসিনী কন্যা গৌরীমাতাই, যিনি সংসারের সুখ-দুঃখের উপকরণ পীড়িতা, ঐশ্বর্য-অনৈশ্বর্যের বিষয় ভোগ সংবর্ধিতা নারীসমাজ থেকে আবিষ্কার করে জাতিকে উপহার দিতে সমর্থ সেই বৈদিক যুগের মহীয়সী নারী দেবী মৈত্রেয়ীকে—যিনি সোচ্চারে জগতে প্রচার করেছিলেন অমৃতময়ী অদ্বিতীয় বাণী—‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্’। গৌরীমার অন্তরে যে আবিঃ নিত্য প্রকাশিত, চির আলোকময়ের যে প্রসন্নসুন্দর মুখচ্ছবি তাঁকে করে রেখেছে সদা তদ্ভাব ভাবিত সেই পরমের পরিচয়ে তিনি করবেন নারী জগতকে এক নব আলোকের দিব্য বিভায় বিভাসিত। শ্রীরামকৃষ্ণ গৌরীমাকে একদিকে তপস্যার দ্বারা করিয়ে নিয়েছেন এক বিশ্বদুর্লভ সাধিকা শক্তি। বর্তমানে তিনি তাঁকে দিয়ে করাতে চান অন্য এক অভিনব সৃজন যা নারীসমাজকে দর্শন করাবে অভ্যুদয়, শ্রবণ করাবে জাগরণের মহামন্ত্র, অনুভব করাবে জীবনের ঈশ্বরের অমৃতরূপের নবীনতম সৃষ্টি রূপ—‘আবিরাবীর্ম এধি’—হে স্বপ্রকাশ, তুমি প্রকাশিত হও।
‘অ-লোকদর্শিনী গৌরীমাতা’ শ্রীশ্রীসারদেশ্বরী আশ্রম থেকে