যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
শ্রীভগবান্ বলিলেন, পরমেশ্বরের ভজন দ্বারাই জীবের উদ্ধার হয়—এই বিশ্বাস দৃঢ় করিয়া যাঁহারা আমার বিশ্বরূপে মনোনিবেশপূর্বক মচ্চিত্ত হইয়া অহোরাত্র অতিবাহিত করেন, তাঁহারাই আমার মতে শ্রেষ্ঠ যোগী। কিন্তু যাঁহারা সর্বদা ইষ্ট-ও অনিষ্ট-প্রাপ্তিতে রাগ-ও দ্বেষরহিত, সকল প্রাণীর কল্যাণে নিযুক্ত এবং ইন্দ্রিয়সংযমী, যাঁহারা শব্দাদিপ্রমাণ দ্বারা অপ্রতিপাদ্য, প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অগোচর, সর্বব্যাপী, মনের অতীত, কুটস্থ (মায়াধিষ্ঠান), অচ্যুতস্বরূপ এবং শাশ্বত নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন। যাঁহাদের চিত্ত নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মে অভিনিবিষ্ট, তাঁহাদিগকে সিদ্ধিলাভের জন্য ভগবৎকর্মাদিপরায়ণ সগুণ উপাসক অপেক্ষা অধিকতর ক্লেশ পাইতে হয়; কারণ নির্গুণ ব্রহ্মে নিষ্ঠালাভ করা দেহাভিমানী ব্যক্তিগণের পক্ষে অতিশয় কষ্টকর। হে পার্থ, কিন্তু যাঁহারা সমস্ত কর্ম আমাতে সমর্পণপূর্বক ‘আমিই পরম পুরুষার্থরূপে উপাস্য’—এইভাবে মৎপরায়ণ হইয়া অনন্য যোগের দ্বারা আমার উপাসনা ও ধ্যান করেন, মদগতচিত্তে সেই সকল ভক্তকে মৃত্যুময় সংসারসাগর হইতে আমি অচিরে উদ্ধার করি। অতএব আমাতেই তুমি মন সমাহিত কর, আমাতেই বুদ্ধি নিবিষ্ট কর। এইরূপ করিলে দেহান্তে তুমি নিশ্চয়ই মৎস্বরূপে স্থিতিলাভ করিবে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। হে ধনঞ্জয়, যদি তুমি আমাতে স্থিরভাবে চিত্ত সমাহিত করিতে না পার, তাহা হইলে অভ্যাস-যোগের দ্বারা আমাকে লাভ করিতে যত্ন কর। যদি তুমি এই প্রকার অভ্যাস করিতে সমর্থ না হও, তবে ভগবৎপ্রীতিকর কর্মে একনিষ্ঠ হও। কারণ আমার কর্ম করিতে করিতেই তুমি ক্রমে সিদ্ধিলাভ করিবে। আর যদি ইহাও করিতে অক্ষম হও, তবে ইন্দ্রিয়-সংযম-পূর্বক আমাতে সর্বকর্ম-সমর্পণরূপ যোগ আশ্রয় করিয়া সর্বপ্রকার কর্মের ফলত্যাগ কর। অবিবেকপূর্বক অভ্যাস অপেক্ষা শ্রুতি ও যুক্তি দ্বারা আত্মনিশ্চয় উৎকৃষ্ট। এই প্রকার আত্মনিশ্চয় অপেক্ষা জ্ঞানপূর্বক ধ্যান শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানপূর্বক ধ্যান হইতে কর্মফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ। কর্মফলত্যাগের অব্যবহিত পরেই সহেতুক সংসার নিবৃত্তিরূপ পরম শান্তিলাভ হয়। যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখে আসক্তি ও দুঃখে দ্বেষবর্জিত, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযতস্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যাঁহার মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি কাহাকেও উদ্বিগ্ন করেন না, যিনি কাহারও দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না এবং যিনি হর্ষ ও বিষাদ, ভয় ও উদ্বেগ হইতে মুক্ত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি নিঃস্পৃহ, বাহ্যাভ্যন্তর শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতশূন্য, ভয়হীন এবং সকাম কর্মের অনুষ্ঠান-ত্যাগী, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি ইষ্টপ্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না, অনিষ্টপ্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, প্রিয়বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্টবস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভাশুভ সকল কর্ম পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি আসক্তিহীন এবং শত্রু ও মিত্রে সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে ও অপমানে অবিচলিত, যিনি শীতোষ্ণজনিত সুখে ও দুঃখে নির্বিকার, পরমাত্মাতে স্থিরবুদ্ধি, প্রশংসায় হর্ষ ও নিন্দায় বিষাদশূন্য সুতরাং সংযতবাক্, সর্বাবস্থায় যৎকিঞ্চিৎলাভে সন্তুষ্ট এবং নির্দিষ্টবাসস্থানহীন তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।
‘শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা’ থেকে