সন্ন্যাসী-শ্রেষ্ঠ বিবেকানন্দ একদিন বলেছিলেন তাঁর গভীর অনুভূতিপ্রসূত একটি কথা: “ঈশ্বরলাভ মানে কি তা বুঝলাম না ভাই, কিন্তু বুকটা বড় হয়ে গেছে, সারা বিশ্বকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।” এই সহজ উক্তি এক শাশ্বত মহামন্ত্রের অভিব্যক্তি। গুরুদত্ত জপমন্ত্র যেমন বারে বারে জপ করে যাওয়াটাই কর্তব্য, তেমনি স্বামিজীর এই মহাবাণীটি বারে বারে বলা, স্মরণ করা, মনন করা ও নিজের জীবনে সম্ভবত রূপায়িত করার প্রচেষ্টা আজ বিশেষ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। এ বাণী কখনও পুরোনো হবার নয়, দেশকালের সীমায় সীমায়িত হবার নয়। এই বাণীর গভীরে প্রবেশ করতে পারলে যে কোনও জীবন মহাজীবনের দিশা পেতে পারে। ‘বড় বুক’ মানে কি? খুব লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ বুক? না। বড় বুকের অর্থ আর কিছু নয়—অসীম আকাশের মত উদার হৃদয়। আর এই উদারতার মূল স্বার্থগন্ধহীন ভালবাসা। আর এই ভালবাসা সর্বদেশের সর্বকালের সর্বধর্মের শাশ্বত সুর। সমস্ত কর্মের পরিসমাপ্তি জ্ঞানে। কিন্তু সেই জ্ঞানের চরম পরিণতি কোথায়? জ্ঞানের পরিণতি প্রেমে। এই প্রেম ভালবাসা যেন শেষ কথারও পরের কথা। আধ্যাত্মিক জগতে যাকে বলা হয় পঞ্চম পুরুষার্থ। সমাধির সুখ নয়, লীলার আনন্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দকে বললেন—শুকদেবের মত সমাধি চাইছেন শুনে—“হ্যাঁরে তুই এ্যাতো হীনবুদ্ধি! শুধু নিজের সুখের কথা ভাবছিস! কোথায় কালে বিশাল বটবৃক্ষের মত জগতকে শান্তির ছায়া দিবি! না সমাধি চাইছিস্! ধিক্ তোর এই ক্ষুদ্র চাওয়াকে।” সেদিনের স্তব্ধ বিবেক সত্যিই বটবৃক্ষ হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের বিরাট ইচ্ছাকে রূপ দিতে। নিঃস্ব সন্ন্যাসী দেখিয়ে গেলেন ভালবাসার দৃষ্টান্ত। গৌতমবুদ্ধ, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, ঈশামসী প্রমুখ সমস্ত অবতার মহাপুরুষ জগৎকে ভালবাসলেন, আর ভালবাসার মন্ত্র দিয়ে গেলেন জগৎবাসীকে।
বাইবেলে পাই—যীশুর সঙ্গে কথোপকথনের সময় একজন উকিল তাঁকে প্রশ্ন করলেন: “Master which is the great commandment in the law?” শাস্ত্রের সবচেয়ে বড় বিধান কি? ভগবান যীশু বললেন: “Thou shalt love the Lord thy God with all thy heart and with all thy soul, and with all thy mind. This is the first and great commandment. And the second is like unto it; Thou shalt love thy neighbour as thyself. On these two commandments hang all the law and the prophets”. তোমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে, আত্মা দিয়ে, মন দিয়ে ভগবানকে ভালবাসবে। এটা হচ্ছে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় নির্দেশ এবং এরই সমান দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছে –তোমার প্রতিবেশীকে তুমি ঠিক নিজের মত ভালবাসবে। আর এই দুটি বিধানের ওপরই সকল শাস্ত্র সকল শাস্ত্রকার দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন হিন্দুধর্মের মূল কথারই প্রতিধ্বনি। ঈশ্বরকে ভালবাসা আর মানুষকে ভালবাসা একই বস্তু। তবে এটা বুঝতে হবে। মানুষের ভেতরে তিনিই রয়েছেন। একই আত্মা সর্বজীবের অন্তরতম বস্তু। কারণ, তিনিই নিজেকে বিলসিত করে এই সৃষ্টির সবকিছুতে অনুস্যূত হয়ে রয়েছেন।
স্বামী মৃগানন্দের ‘সাধনার পথে’ (১ম খণ্ড) থেকে