নিবেদিতার প্রতি স্বামীজীর নির্দেশ ছিল—ভারতীয় মেয়েদের জাতীয়ভাবে দেশীয় ঐতিহ্য বজায় রেখেই শিক্ষা দিতে হবে। তিনি আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ শুধুমাত্র নারীমুক্তির জন্য আসেননি, তিনি জনগণেরও ত্রাণকর্তা। স্বামীজীর এই ভাবনাই নিবেদিতাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল একটি বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। স্বামীজী চেয়েছিলেন মানুষ তৈরির শিক্ষা। নিবেদিতা সেটিকে জাতিগঠনের দিকে প্রসারিত করেন। সেইদিক দিয়ে বিচার করলে এই বিদ্যালয়টি ছিল তখনকার দিনে ভারতের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়। সেই বিদ্যালয়ের মেয়েরা প্রতিদিন প্রার্থনার সময়ে গাইত ‘বন্দে মাতরম্’—ব্রিটিশ সরকার যে সংগীতের ওপর তখন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহারেও নিবেদিতার আগ্রহের সীমা ছিল না। তাই কোনওরকম দ্বিধা না করে তিনি লেডি মিন্টোকে (তৎকালীন ভাইসরয়ের পত্নী, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ নং বোসপাড়া লেনে নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করতে আসেন) আপ্যায়িত করেছিলেন স্বদেশি কাপ-ডিশে স্বদেশি চা, চিনি ও বিস্কুট দিয়ে। তখন ভারতীয়দের ঘরে ঘরেও ওই স্বদেশি বস্তুর কোনও কদর ছিল না। আবার লেডি মিন্টো যখন ১৯১০-এর ১৮ মার্চ নিবেদিতাকে গভর্নমেন্ট-হাউসে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তখনও নিবেদিতা এক প্যাকেট স্বদেশি বিস্কুট (লেড়ে বিস্কুট) সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এটি বোধহয় নিবেদিতার পক্ষেই সম্ভব।
একথা সুনিশ্চিত যে, ধর্মের ক্ষেত্রে ভারতের বিদেশ থেকে শেখার বিশেষ কিছুই নেই, বরং দেওয়ার মতো সম্পদ অনেক আছে। আমাদের সমাজে অবশ্য বর্তমানে পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সমাজে নতুন কিছুর প্রবর্তন ভারতীয়রা নিজেরাই করবে। কোনও বিদেশির তো সে-ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।
তিন হাজার বছরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা কি এতই গুরুত্বহীন যে, পশ্চিমের তরুণজাতি প্রাচ্যের মানুষকে দিগ্দর্শন করাবে! ইউরোপে সভ্যতার জন্ম তখনও হয়নি। সেই সুপ্রাচীন কালেই ভারতবর্ষ সভ্যতার মূলভাবগুলি হৃদয়ঙ্গম করেছিল। সভ্যতার শেষ কথা ঐশ্বর্য, শক্তি অথবা সংগঠন নয়, সভ্যতার অর্থ মানুষকে উচ্চতর মূল্যবোধে জাগ্রত করা, সূক্ষ্ম মহত্তর কৃষ্টির সঞ্চার করা এবং সেইসঙ্গে গড়ে তোলা উদার প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতীয় মেয়েরা অজ্ঞ—এমন ভুল ধারণা কোনওমতেই মেনে নেওয়া যায় না। বরং ভারতীয় মেয়েদের সমুন্নত চারিত্র্যমহিমা, তাদের মর্যাদাবোধ, কোমলতা, হৃদয়মনের উৎকর্ষ যা তারা নিজেদের সহজ-সরল জীবনযাত্রার মধ্যেই লাভ করেছে—সেগুলি তো জাতীয় জীবনের মহার্ঘ্য সম্পদ!
প্রব্রাজিকা বেদান্তপ্রাণা সম্পাদিত ‘নিবেদিতার ধ্যানে শাশ্বত ভারত’ থেকে