‘জীবনমুক্তি’ শব্দটির সহজ অর্থ জীবদ্দশায় মুক্ত হওয়া বা বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে মোহমুক্ত হওয়া। কিন্তু এই প্রসঙ্গে ইহা অতিশয়োক্তি হইবে না যে উপরোক্ত “জীবন্মুক্তি” শব্দটির অর্থ বা তাৎপর্য্য গ্রহণে অসমর্থ মানবমন সর্বাগ্রেই প্রশ্ন করিয়া বসিবে, “ইহা আদৌ সম্ভব কি না?” শাস্ত্র বিশেষতঃ উপনিষদ্ এবং সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ(যিনি প্রকৃত গুরুপদবাচ্য) অভয় দিয়া বলিতেছেন, “ওহে অমৃতের সন্তান ও সন্ততিগণ। আমি সেই সত্যকে জানিয়াছি এবং তুমিও সেই সত্যকে জানিলে জন্ম মৃত্যুর আবর্তন হইতে মুক্তি পাইবে।” জীবন রহস্যের সমস্যা সেইখানেই যেখানে দ্বন্দ্বের প্রশ্ন আসে। দ্বন্দ্ব অন্য কিছু নহে তাহা এই যে নিজেকে বিশ্বাস করিব, না গুরু, শাস্ত্রকে বিশ্বাস করিব। বিশ্বাস নিজেকে বা গুরু, শাস্ত্রকে করার পূর্বে নিজ মনের কথা অর্থাৎ অন্তঃস্থলের গোপন ও সত্য কথাটি জানিয়া লওয়া উচিত, “মন কী চায়?” সে ক্ষেত্রে স্পষ্টই বোঝা যাইবে যে মন অনন্ত সম্ভোগ্য বস্তুভোগে সদাই লালায়িত ও তাহাতেই তৃপ্ত হইতে চায়। একক বা একটি কোনও বস্তু ভোগে সে কখনই তৃপ্ত হইতে চাহে না, কারণ তাহার বাসনাগামী মন বহুমুখী। দেখা যায়, একটি কোনও বাসনা পূর্ণ হইলেও অন্য বাসনা আসিয়া জুড়িয়া বসে। এইভাবে বাসনার পর বাসনা চরিতার্থ হইলেও বাসনারাজির আর শেষ হয় না। বাসনাবীজ তাই ক্ষয় হয় না, থাকিয়াই যায়। কাজে কাজেই সারাজীবনটাই বাসনার অনুসরণে ব্যাপৃত থাকিয়া মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী কোলে তাহার পরিসমাপ্তি ঘটে। ইহা কি অতৃপ্তি বা অভাবজনিত নয়? অতৃপ্তি, অভাব হইতেই তো বাসনার উদ্ভব। কীসের অতৃপ্তি, কীসের অভাব— এই কথা ভাবিতেও অবসর নাই। কিন্তু একথাও ঠিক, মানুষ শান্তি পাইতে চায়। অপর দিকে বাসনাই তাহাকে অশান্ত করিতেছে এবং বাসনা পূরণের জন্য সর্বদা বহির্মুখীন করিতেছে। একদিকে প্রকৃত শান্তি বা প্রকৃত সুখের দিকে অন্তর্নিহিত প্রবণতা আবার অন্যদিকে বাসনা প্রপীড়িত বহির্মূখীন ধাবনতা—এই দোটানার মধ্যেই বদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন জীবন বা প্রতিমুহূর্তের ঘটনা। এই ঘটনাকে ভগবান্ শঙ্করাচার্য্য এই ভাবে বলিতে চাহিয়াছেন—“সত্যানৃতং মিথুনীকৃত্য অয়ং নৈসর্গিকো লোকব্যবহারঃ।”
উপরোক্ত আলোচনাগুলি মনুষ্য বুদ্ধির অন্ততঃ কিছুটা শুদ্ধিতা সম্পাদন করিলেও করিতে পারে। যাহা মনুষ্যকুলের অনুভবে আসে তাহা বুদ্ধির জট বা গ্রন্থি খুলিয়া দেয়। তাই সহজ ও সরল কখনই জটিল হইতে পারে না। এখন বাঁচিয়া থাকা বা মোহমুক্তির অর্থ কীভাবে মানব বুদ্ধিতে সহজ ও সরল হইয়া আসিতে পারে সেই আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যাক্। স্থূলদেহে প্রাণনক্রিয়া, চক্ষু কর্ণ নাসিকা প্রভৃতি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সক্রিয় ভূমিকা, হস্ত পদ প্রভৃতি কর্মেন্দ্রিয়ের চালনক্রিয়া সমন্বিত বাঁচিয়া থাকারূপ মনুষ্যনামধারী আমি একটি জীব। ইহাই জীবন বা বাঁচিয়া থাকা—এই বদ্ধমূল ধারণা লইয়াই “আমি মানুষ” এই বলিয়া নিজেকে জানি।
স্বামী পবিত্রানন্দের ‘এক ও একতা’ থেকে