ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
আর সত্যচরণ প্রকৃত অর্থে গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। গতানুগতিক, পঙ্কিল, অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে যথার্থ সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। যে কারণে তিনি আজ ঈশ্বরীপুরের প্রণম্য ব্যক্তিত্ব। সারা গ্রাম তাঁকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, মান্য করে। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন ভালো লোক।
কিন্তু এই ভালো লোকটিই তাঁর একমাত্র মেয়ে, কল্পার কাছে ঘৃণার পাত্র। মেয়ের জন্মের পরপরই সত্যচরণের স্ত্রী, কমলিকার হঠাৎ অন্তর্ধান, তাঁর জীবনকে বেসামাল করে দেয়। সংসারের হাল ধরে সম্পর্কিত বোন প্রভা। এই বিপদে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ায় ধূর্জটিনারায়ণ। তিনি ছোট্ট কল্পাকে নিজের কাছে, শহরে নিয়ে যান, প্রকৃত অর্থে মানুষ করার জন্য। ইচ্ছে না থাকলেও পরিস্থিতির কারণে সত্যচরণকে রাজি হতে হয়। সম্পর্কের মধ্যেও যে রাজনীতির জটিল লাভের অঙ্ক কষেন ধূর্জটিনারায়ণ, সেটা সরল সত্যচরণের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না।
ভোটে জেতার তাগিদ, সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য অহংকারের সীমানাকে অতিক্রম করার অলীক চেষ্টা, পারস্পরিক সম্পর্ক, ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যাবার জেদ নিয়ে ধূর্জটিনারায়ণ, তাঁর কক্ষপথে ঘুরপাক খেতে থাকেন।
আর সত্যচরণ, দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে, মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ঈশ্বরীপুরকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাই তিনি দেবতা, হাঁসঠাকুর, বা ভালো লোক। কিন্তু মেয়ে কল্পার চোখে তিনি ঘৃণ্য, ব্যর্থ, মেরুদণ্ডহীন এক মানুষ। কিন্তু কেন? কেন না তাকে এভাবেই ভাবতে শিখিয়েছেন ধূর্জটিনারায়ণ, কল্পার ‘ড্যাডি’!
কল্পার এই উপেক্ষা,অবজ্ঞা, অসহ্য লাগে সত্যচরণের। তাঁর প্রতি মেয়ের এই আচরণের কারণ জানতে চান। মেয়ে জানায়, তার প্রকৃত পিতা তিনি নন, ধূর্জটিনারায়ণ। সত্যচরণের পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে অনেক ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে। কুয়াশার পরদা সরে যেতে থাকে। সম্পর্কের এক জটিল আবর্তের মুখোমুখি হন। এতদিনের বিশ্বাসে, দাম্পত্যে এক বড়সড় ফাটল। কাছের মানুষ কে? দূরের মানুষই বা কারা? এক ভ্রান্ত দোলাচলে পথভোলা মানুষটার ভেঙ্গে পড়াটাকে আটকায় প্রভা, এবং তার কাছে থাকা ‘সেই চিঠি’। যে চিঠি নিত্যানন্দ লিখেছিলেন তাঁর মেয়ে কমলিকাকে। মতামত না নিয়েই তার সঙ্গে সত্যচরণের বিয়ে দিয়েছিলেন নিত্যানন্দ। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে মুখোমুখি হয় দুই বন্ধু। যে চিঠি নিঃস্ব করে দেয় ধূর্জটিকে। ভেঙ্গে দেয় তাঁর দম্ভ, হিংসা, লালসাকে। যে চিঠি এক অন্য উত্তরণের পথ দেখায় কল্পাকে। যে চিঠি তাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, সত্যচরণ ব্যর্থ, মেরুদণ্ডহীন, ধূর্জটির কৃপালোভী কোনও ক্লীব মানুষ নন। সত্যচরণ প্রকৃত অর্থে একজন ভালো মানুষ। তার স্নেহপরায়ণ পিতা, তার ভালো বাবা। তার গর্ব।
ফরাসি কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার লুইজি পিরানদেল্লোর কাহিনীর সার্থক বঙ্গীকরণ করেছেন চন্দন সেন। মেঘনাদ ভট্টাচার্যের নির্দেশনা এতোটাই আঁটসাঁটো, এতটাই মেদহীন, যে মঞ্চ থেকে চোখ এক মুহূর্তের জন্য সরে না। তাঁকে উপযুক্ত সঙ্গত করেছে সৌমিক-পিয়ালীর মঞ্চসজ্জা, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আলো, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দ, এবং গৌতম ঘোষের সংগীত।
সত্যচরণ একজন সরল, পরোপকারী মানুষ, যার মুখের কথা এবং কাজে কোনও পার্থক্য নেই। নাটকের প্রথমেই এরকম এক সত্যচরণকে অতি সহজেই প্রতিষ্ঠা করে দেন মেঘনাদ। নাটক যতো এগয় ততোই সত্যচণের অনুভূতির নানা দিক উন্মোচিত হতে থাকে। স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, মেয়ের প্রতি টান, স্নেহ, বন্ধুকে প্রাপ্য সম্মান, গ্রামবাসীদের জন্য চিন্তা— সব নিয়ে মঞ্চে শুধুই সত্যচরণ। মেঘনাদকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অভিনেতা এবং তাঁর চরিত্র একাকার। সত্যচারণের ব্যথা, বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা, ক্রোধ, অসহায়তা, হাহাকারের সঙ্গে সহজেই দর্শক একাত্ম হয়ে পড়ে। মঞ্চে একাকী, নিঃস্ব সত্যচরণ। আলোর বৃত্তের মাঝখানে বসে আছেন। চারপাশে অন্ধকার। এ যেন তাঁর বেদনার, একা হয়ে যাবার প্রতীক। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, সব হারানো এক অসহায় মানুষ। ব্যাকগ্রাউণ্ডে বেজে ওঠেন কবিগুরু — সহে না যাতনা। অসাধারণ এক দৃশ্যকল্প তৈরি হয়। সত্যচণের হাহাকার, ব্যথাটা সংক্রামিত হয়ে গলার কছে দলা পাকিয়ে ওঠে। চোখ ভিজে যেতে চায়। আবেগটাকে কোথায়, কতটা ধরে রাখতে হয়, কোনখানেই বা ভেঙে দিতে হয় — মেঘনাদ আবার নতুন করে চমকে দিলেন। উচ্চারণ কোথায় তীব্র হবে, স্বর কখন গলা থেকে আসবে, আর কখনই বা নাভি থেকে উঠে আসবে সব কিছু তাঁর নখদর্পণে। শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। পাশাপাশি সুন্দর এক কনট্রাস্ট ধূর্জটিনারায়ণ। মেঘনাদের পাশে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন আশিস ঘোষ। বন্ধুত্বের চমৎকার সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন ‘জলেশ্বর’ প্রদীপ দাস। প্রভার সংযত রূপকে যথার্থ অর্থে ফুটিয়ে তুলেছেন রুণা মুখোপাধ্যায়। কথাকলির ‘কল্পা’ উপযুক্ত সঙ্গত করেছেন। ভালো লাগে অন্যান্যদেরও।