ধর্ম নয়, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতেই কলম ধরেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানবতার অপমান, সংকীর্ণতা, অপব্যাখা ও অপক্ষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যেই তাঁর লেখা ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ বইটি একসময়ে সাড়া ফেলে জনমানসে। তারপর যা ঘটে সেটা প্রায় সকলেই জানেন। তাঁর মতোই নিজের অভিজ্ঞতার কথা লেখা তসলিমা নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’ এবং ‘লজ্জা’ বই দুটির জন্য তাঁকে তো দেশ ছাড়া করে দেওয়া হয়। সেকথাও আমাদের কারও অজানা নয়। ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যিনিই কথা বলেছেন তাঁর ওপরেই সমাজের কিছু মানুষ নানাভাবে আঘাত হেনেছে। এই আঘাতেই খুন হল সব্যসাচী। কিন্তু কে এই ব্যক্তি? এক নির্ভীক লেখক সব্যসাচী খাসনবিশ। জঙ্গলমহলের একজন শিক্ষক। সেখানকার আদিবাসীদের নিয়ে নাটক করেন। তাঁর লেখা সংবাদপত্রের পোস্ট। এডিটোরিয়াল, ফেসবুকের পোস্ট সবকিছুই রাষ্ট্রশক্তি সন্দেহের চোখে দেখে। প্রতিটি ধর্মের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি লিখে চলেছেন অবিরত। রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার নীতি, সমাজ, ধর্ম, নিয়ে বিভিন্ন খবরের কাগজে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয় নিয়মিত। কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে গোরুর মাংস খাওয়া নিয়েও তীব্র শ্লেষ দেখা যায় তাঁর লেখায়। স্বাভাবিক কারণেই বিভিন্ন ধর্মের গুরুরা রাষ্ট্রদ্রোহিতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সহ একাধিক মামলা তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করে। তাঁকে দেশদ্রোহী নামে আখ্যা দিয়ে তিনটি সংগঠন হিন্দুত্ববাদীদের বজরঙ্গ পার্টি, ইসলামিক ইন্ডিয়া ও সুবিধাবাদী সমাজকর্মী সংগঠন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। সব্যসাচীর তীক্ষ্ণ লেখনিতে তাঁদের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ উঠে এসেছে। তাই সে রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দি। পাঁচ বছর জেলের অন্ধকার কুটুরিতে বন্দী থাকেন তিনি। বিচারের রায় বেরনোর ঠিক আগের দিন একজন সরকারি কর্মী এসে তাঁকে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে শাস্তির হাত থেকে বাঁচার রাস্তা বলে দেন। সেইমতো সরকারি আধিকারিকের নির্দেশে সেই সেলে হাজির হয় হিন্দুত্ববাদী নেতা পবন সিং, ইসলামিক সংগঠনের নেতা শাকিল খান এবং সমাজকর্মী অরুনোদয় রায়। ওই তিনটি দলের নেতারা এক এক করে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যে তিনি ভুল করেছেন সেটা স্বীকার করতে এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কোন ধর্মের লোক? তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন আমি মানুষ। মনুষ্যধর্মই আমার কাছে সবচেয়ে বড়। রামমন্দিরের চেয়ে ওই জায়গায় একটা বড় লাইব্রেরি করার পক্ষপাতি। কারণ লাইব্রেরি হলে সেখানে অনেক মানুষ জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। আর যদি একটা অনাথ আশ্রম হয়, তাহলে হাজার হাজার অনাথশিশু আশ্রয় পাবে। মন্দির, মসজিদের চেয়ে তার মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। ইসলামিক দলের নেতাকে বলেন, আপনারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন কেন? মাদ্রাসায় কী শিক্ষা দেন ইত্যাদি। আর সমাজকর্মীকে বলেন, সরকারি অর্থ অনুদান হিসাবে নিয়ে সমাজসেবার নামে নিজেদের পকেটে ভরতে লজ্জা করে না আপনাদের? এটা কি সমাজসেবা? আসলে আপনারা প্রত্যেকেই একটি সুবিধাবাদী। সামনা সামনি একে অপরের সঙ্গে লড়াই করেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অথচ ভিতরে ভিতরে আপনারা সবাই এক এবং একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলেন। অন্তিম বিচারের আগের রাতে এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, যুক্তি পাল্টা যুক্তি দিতে থাকে সব্যসাচী। তারপর?
সব্যসাচী এখানে ‘যে কথা বলো নি আগে’ নাটকের একটি রূপক চরিত্র। সম্প্রতি নাটকটি নৈহাটির রবীন্দ্রভবনে মঞ্চস্থ হল।
একটা সরকারি ডাক সেলে এক রাতের ঘটনাই উঠে আসে নাটকে। গোটা পৃথিবী জুড়েই যে শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবীদের ওপর যেভাবে রাষ্ট্রের তথা মৌলবাদীদের কুঠারাঘাত নেমে আসছে তাদেরই যেন প্রতিনিধি এই চরিত্রটি। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে লেখা সামাজিক দলিল এটি। দেশদরদী নেতারা তলায় তলায় সবাই এক অথচ সকলের সামনে যে যার দলকে সমর্থন করতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করে আর প্রাণ যায় গরিব অসহায় মানুষের। মানুষ কি শান্তির বাতাবরণে নিশ্বাস ফেলে বাঁচতে পারবে না?
এক মর্মান্তিক ভয়াবহ দিনের প্রতিচ্ছবি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয় ‘যে কথা বলনি আগে’ নাটকে। বিভিন্ন কাগজের ক্লিপিংস, গান, স্বরচিত কবিতায় আশ্রিত নাটকটি মন ছুঁয়ে যায়। বিষয়টি অত্যন্ত প্রাঞ্জল। উপস্থিত দর্শক তো বটেই সমগ্র জনসমাজকে সত্যিকারের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোথায় কোন সমাজে আমরা বাস করছি? কেউ কি আসবে না, কোনও দিন কি এমন সমাজ গড়ে উঠবে না যেদিন মানুষকে অন্যায় অত্যাচার সইতে হবে না? সব্যসাচী চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়। সামগ্রিক পরিকল্পনায় শমিত ঘোষ একার হাতে নির্দেশনা ও সরকারি আধিকারিকের চরিত্রটি সুনিপুনভাবে সামলেছেন। অন্যান্য চরিত্রে গৌরব (পবন সিং), শুভ্রজ্যোতি (শাকিল খান), ধ্রুপদ (অরুণোদয়), রাজা (কবি), গৌতম ঘোষ (অঙ্কনশিল্পী) নাটকটিকে যথার্থ রূপ দিয়েছে। বাপ্পা সেনের আবহ, দেবস্মিতার সংগীত নাটকটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
কলি ঘোষ