ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
দিনটি ছিল ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রবিবার। স্টার থিয়েটারে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব সপার্ষদ গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখতে এসেছেন। হাতিবাগানের মুখে যে স্টার থিয়েটার আমরা দেখি, এই স্টার থিয়েটার সেটি নয়। এর ঠিকানা ছিল ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিট। বর্তমান সেন্ট্রাল এভিনিউ ও বিডন স্ট্রিটের উত্তরদিকের সংযোগস্থলে এই মঞ্চটি ছিল। এখন সেখান দিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ’র রাস্তা চলে গেছে। দক্ষিণেশ্বর থেকে এসে উঠেছিলেন মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেখান থেকে স্টার থিয়েটারে। এই প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্রের আত্মজীবনীতে যে তথ্য পাই, ‘চৈতন্যলীলা হইতেছে, আমি থিয়েটারের বাহিরের Compund-এ বেড়াইতেছি, এমন সময়ে মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক একজন ভক্ত আমায় বলিলেন, ‘পরমহংস থিয়েটার দেখিতে আসিয়াছেন, তাঁহাকে বসিতে দাও ভাল, নচেৎ টিকিট কিনিতেছি।’ আমি বলিলাম, ‘তাঁহার টিকিট লাগিবে না, কিন্তু অপরের টিকিট লাগিবে’। এই বলিয়া তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে অগ্রসর হইতেছি, দেখিলাম, তিনি গাড়ী হইতে নামিয়া থিয়েটারের Compound মধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন; আমি না নমস্কার করিতে করিতে তিনি অগ্রে নমস্কার করিলেন, আমি নমস্কার করিলাম, পুনর্বার তিনিও নমস্কার করিলেন, আমি আবার নমস্কার করিলাম, পুনর্বার তিনিও নমস্কার করিলেন। আমি ভাবিলাম, এই রূপই তো দেখিতেছি চলিবে। আমি মনে মনে নমস্কার করিয়া তাঁহাকে উপরে লইয়া আসিয়া একটি Box-এ বসাইলাম ও একজন পাখাওয়ালা নিযুক্ত করিয়া দিয়া শরীরের অসুস্থতা বশতঃ বাড়ি চলিয়া আসিলাম।’
থিয়েটার শুরু হল। ঠাকুর নাটক দেখতে দেখতে প্রায়ই ভাবসমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন। থিয়েটার শেষের পর ভক্তেরা ঠাকুরকে নিয়ে গেলেন মঞ্চের পাশে অফিসঘরে। জনৈক ভক্ত জিজ্ঞাসা করলেন,‘কেমন লাগল নাটক?’ ঠাকুর জবাব দিলেন, ‘আসল নকল সব এক হয়ে গেছে।’ একে একে সবাই ঠাকুরকে প্রণাম করতে এলেন। চৈতন্যলীলার চৈতন্যরূপিণী নটী বিনোদিনী যখন এসে দাঁড়ালেন, ঠাকুর তাঁর পায়ের ওপর পড়তে যাচ্ছিলেন, ভক্তেরা অবশ্য ঠাকুরকে ধরে ফেলেছিলেন। বিনোদিনী তাঁকে প্রণাম করতেই ঠাকুর আশীর্বাদ করে বললেন, ‘মা তোর চৈতন্য হোক।’ মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘বল মা, হরি গুরু, গুরু হরি।’
এমন অভিনব ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেই সময়ে কোনও ভদ্রঘরের মেয়েরা থিয়েটার পাড়ায় এসে অভিনয় করেননি। সকল অভিনেত্রীরাই এসেছেন নিষিদ্ধপল্লি থেকে। সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রথম দিকে পুরুষেরাই নারী চরিত্রগুলিতে অভিনয় করতেন। মধুসূদন দত্তের পরামর্শে বেঙ্গল থিয়েটারেই প্রথম নারী চরিত্রে অভিনেত্রীদের প্রবেশ ঘটে। যখন ভদ্রঘরের মেয়ে পাওয়াই যাবে না তখন পতিতালয় থেকেই অভিনেত্রীদের আনা হতো। ফলে সেদিন থেকে ভদ্র শিক্ষিত সমাজ থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিলেন। এমনকী থিয়েটারের নটেরা পর্যন্ত সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে পড়লেন। এখানেই শেষ নয় কেশবচন্দ্র সেনের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকার ১২৮১ বঙ্গাব্দের ১ পৌষ সংখ্যায় লেখা হল; ‘যাত্রার পরিবর্তে নাটক অভিনীত হইতে দেখিয়া আমরা মনে করিয়াছিলাম যে এতদিনের পর বিশুদ্ধ আমোদ আস্বাদ করিবার উপায় হইল। কিন্তু সে আশায় ছাই পড়িল। বেশ্যাদ্বারা অভিনয় করাইলে, নাট্যমন্দির আর বিশুদ্ধ আমোদের স্থল রহিল না।’ শুধু কি তাই ঠাকুরের খুব কাছের মানুষ রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকলেও, থিয়েটারের যাননি, অশুচিতার ভয়ে। রাস্তার যে ফুটপাতে থিয়েটার আছে, সে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতেন না স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি নারীর কল্যাণ কর্মে সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তিনিও থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করলেন এই অপরাধের জন্য।
সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে ঠাকুর এলেন, দেখলেন, আশীর্বাদ করলেন বিষবৃক্ষের বীজ যে অভিনেত্রী সম্প্রদায় তাঁদের একজনের মাথায় হাত রেখে। মহাপ্রভুর ভূমিকায় নটী বিনোদিনীর অন্তর আলোড়নকারী অভূতপূর্ব ভাবদ্যোতক সাত্ত্বিক অভিনয় ঠাকুরকে এতখানি অভিভূত ও আত্মহারা করে তুলেছিল যে, তাৎক্ষণিক মুহূর্তে ঠাকুরের দৃষ্টিতে আসল-নকল সব এক হয়ে গিয়েছে। শুধু গিরিশচন্দ্র ঘোষ কেন, বঙ্গ রঙ্গমঞ্চেরই পরমপ্রাপ্তি ঘটেছে এই ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক থেকে। ঠাকুর সেদিন বিনোদিনীকে যে আশীর্বাদ করেছিলেন তা বিশেষ এক শিল্পীর প্রতি নয়, নবজাত রঙ্গমঞ্চেরই প্রতি গুরুর অসীম আশীর্বাদ। ভদ্র সমাজের, বিশেষ করে ব্রাহ্ম সমাজের ঘৃণায় জর্জরিত শিল্পীকুল সেই আশীর্বাণী থেকে আপন কর্তব্য ও অধিকারের নির্দেশ খুঁজে পেয়েছেন। এই শিল্পীরা যে সমাজেরই অবিভাজ্য অংশ এবং সমাজের কল্যাণ সাধনে লোকশিক্ষা দানের মাধ্যম রূপে নাটকের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছেন। তাই তো শিল্পীকুল অপরিসীম শ্রদ্ধায় ঠাকুরকে গ্রহণ করেছেন মঞ্চের গুরুরূপে, দেবতারূপে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকের অভিনয় সেইসব নীতিবাগিশ সমাজপতিদের যোগ্য প্রত্যুত্তরই দিয়েছে। শিল্পী তিনি যে সমাজভুক্তই হোন না কেন, অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাঁর নৈপুণ্যই মোদ্দা কথা। তাই নিঃসন্দেহে বলা চলে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চেরই ইতিহাসে ‘চৈতন্যলীলা’ এক নব অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
ঠাকুর দেহ রাখার পর রামচন্দ্র দত্ত স্থাপিত যোগোদ্যান তাঁর অস্থি প্রতিষ্ঠার দিন শোভাযাত্রার পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনেত্রী সমাজ। তাঁরা উদার কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘চৈতন্যলালী’ নাটকের গান; ‘হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায়’। ব্রাহ্মসমাজ প্রভাবিত গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে নরেন্দ্রনাথ দেখতে গিয়েছিলেন ‘চৈতন্যলীলা’। তাঁর কণ্ঠে তখন ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকেরই গান; ‘রাধা বই আর নেইকো আমার রাধা বলে বাজাই বাঁশী।
মানের দায়ে সেজে যোগী
মেখেছি গায় ভস্মরাশি।’
রঙ্গমঞ্চের বদ্ধ পরিবেশ থেকে ‘চৈতন্যলীলা’র গান ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে। ভাবতে অবাক লাগে সামান্য একটি নাটকের ভাব প্রেরণা কতভাবে কত মানুষের অন্তরে বৈরাগ্যের দীপ জ্বালাতে সক্ষম হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে যে নাটকগুলি দেখেছেন সেগুলি হল চৈতন্যলীলা, প্রহ্লাদচরিত, নিমাই সন্ন্যাস, দক্ষযজ্ঞ, বৃষকেতু ও বিবাহ বিভ্রাট। প্রথম পাঁচটি গিরিশচন্দ্রের লেখা, শেষেরটি রসরাজ অমৃতলাল বসু’র লেখা। যে বিনোদিনীকে তিনি প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছেন, উপরিউক্ত নাটকগুলির সবক’টিতে তিনি অভিনয় করেছেন; ‘চৈতন্যলীলা’য় নিমাই, ‘প্রহ্লাদচরিতে’ প্রহ্লাদ, ‘নিমাই সন্ন্যাসে’ চৈতন্য, ‘দক্ষযজ্ঞে’ সতী, ‘বৃষকেতু’তে পদ্মাবতী, ‘বিবাহ বিভ্রাটে’ (বিলাসিনী কারফরমা)। ‘প্রহ্লাদচরিত’ দেখতে এসে ঠাকুর গিরিশকে বলছেন; ‘বা! তুমি বেশ লিখেছে না!’ গিরিশ প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘মহাশয়, ধারণা কই? শুধু লিখে গেছি।’ ঠাকুর বললেন, ‘না, তোমার ধারণা আছে। সেই দিন তো তোমায় বললাম ভিতরে ভক্তি না থাকলে চালচিত্র আঁকা যায় না।’ অভিনয় যে লোকশিক্ষার প্রধান বাহন, একথা ঠাকুর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানতেন। অভিনয়ে একসঙ্গে অনেক মানুষকে উদ্দীপিত করে তোলা যায়। গিরিশচন্দ্র রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে সারাজীবন যুক্ত থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে লোকশিক্ষা বিতরণ করুক, ঠাকুর সর্বদা সে সম্বন্ধে গিরিশচন্দ্রকে উৎসাহ দিয়েছেন। গিরিশ একবার বললে; ‘মনে হয়, থিয়েটারগুলো আর করা কেন।’ বাধা দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘না না, ও থাক, ওতে লোকশিক্ষা হবে।’ গিরিশচন্দ্রের কাছে ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন অবতার পুরুষ। একদিন ঠাকুরই গিরিশকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি আমার মধ্যে কি দেখেছ?’ গিরিশচন্দ্র নতমস্তষ্ককে করজোড়ে বলেছিলেন, ‘ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর কী বলতে পারি?’ এই অচল অটল বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন মহাকবি গিরিশচন্দ্র। গিরিশচন্দ্র আরও অভিভূত এই কারণে যে, যে অভিনেত্রী সমাজ হীন, ঘৃণিত ছিলেন, পতিতপাবন তাঁদেরই একজনকে শ্রীচরণে স্থান দিয়েছেন। গিরিশচন্দ্রের স্বীকারোক্তির উল্লেখ করি,’ অনেকে আজীবন তপস্যা করিয়া যে মহাফললাভে অসমর্থ হয়, সেই চতুর্বর্গ ফলস্বরূপ শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের পাদপদ্ম বিনোদিনী লাভ করিয়াছে।’