কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস এন জে পি স্টেশন থেকে যখন ছাড়ল বাইরে মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ঘণ্টা দেড়েক বৃষ্টির পর আবার আকাশ মেঘমুক্ত। হাসিমারা স্টেশন পার হয়ে গিয়েছে, বক্সার গভীর অরণ্যর মধ্যে এঁকে বেঁকে চলেছে ট্রেন। দরজায় দাঁড়িয়ে দূরের ডিজেল ইঞ্জিনকে দেখা যায়। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে নিজস্ব ছন্দে চলেছে। আলিপুরদুয়ার জংশন মধ্যাহ্নে ১২.১০-এ পৌঁছনোর কথা কিন্তু ঘণ্টাখানেক বিলম্বে চলছে ট্রেন। গতি কম, রাজ্য বনদপ্তরের নির্দেশে ট্রেনের গতি কমাতে হয়েছে। হাতির সঙ্গে ট্রেনের দুর্ঘটনায় হস্তিশাবক সহ পূর্ণবয়স্ক হাতির মর্মান্তিক মৃত্যু ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা, তাতে পর্যটক আরও গভীরভাবে ডুর্য়াসের এই সবুজ জঙ্গলের দৃশ্য উপলব্ধি করতে পারে। একটা নাগাদ আলিপুরদুয়ার পৌঁছলাম। উত্তরবঙ্গের শেষ বড় রেলওয়ে জংশন আলিপুরদুয়ার। এখান থেকে কোচবিহারের দিনহাটা পর্যন্ত একটা রেলপথ আছে আর সোজা লাইন চলে গিয়েছে নিউবনগাঁইগাঁও হয়ে অসমের নানা প্রান্তে। নিউ জলপাইগুড়ি ছাড়ার পর রাস্তায় যে বৃষ্টি পেয়েছিলাম এখানে তার ছিটে ফোঁটা নেই। বেশ চড়া রোদ। স্টেশনের বাইরের দোকান বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একজন লোককে জিজ্ঞেস করে রাজাভাতখাওয়া যাওয়ার অটোর নিশানা পাই। আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়ার দূরত্ব চোদ্দো কিলোমিটার। এই স্বল্প পথ আঁকাবাঁকা গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছায়াময়। হাতি, ভল্লুক, বুনোশূকরের অবাধ বিচরণ। মাঝে মাঝে শুকনো নালা পড়ে। নালার উপর সেতু। সেতু পার হয়ে চলে অটো। পাহাড়ি নালা। বিস্তর বোল্ডার পড়ে আছে। এর মধ্যে বয়ে চলেছে ক্ষীণ জলধারা। দীর্ঘ জঙ্গল পার হয়ে ছোট জনপদ দেখা যায়। ড্রাইভার বলে এই রাজাভাতখাওয়া। বাঁদিকে ঘুরে রেল লাইন পার হয়ে জঙ্গল ঘেরা পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বক্সা জঙ্গল লজ। বক্সা জঙ্গল লজের কম্পাউন্ড বিশাল। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে ঘুরলেই সময় কেটে যায়। দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে জঙ্গলের বুক চিরে চলে যায় দূরপাল্লার ট্রেন। তিনটি আলাদা আলাদা ইউনিট আছে বক্সা বন বাংলোয়। আমাদের বুকিং ইউনিট থ্রি-তে। সামনে বারান্দায় জিনিসপত্র রেখে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিই। দূরের জঙ্গল দেখে মনের তৃষ্ণা মেটে। সামনের গাছে ময়ূর এসে বসেছে। মাঝে মাঝে কর্কশ শব্দ করে ডেকে ওঠে। কোকিল দেখেছি আগে কিন্তু বনে কোকিল দেখেনি। কুপ কুপ করে মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে কে ডাকছে? চা দিতে এলেন পারিজাতবাবু। পারিজাত বর্মন। আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা। পারিজাতবাবুকে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম বন কোকিলের কথা। সাধারণ কোকিলের মতোই তবে সাইজে বেশ বড় লেজশুদ্ধ লম্বা প্রায় আড়াই ফুট। গায়ের রং কালো তবে গলার কাছটা লাল। ঝোপ জঙ্গলে বসে থাকে। গাছের পোকামাকড় প্রধান খাদ্য। পরে পানাগড়ের কাছে দেউল পার্কে এই কোকিলের দর্শন পেয়েছিলাম।
দীর্ঘ ট্রেন জার্নির ক্লান্তি দূর হয় স্নিগ্ধ জলে স্নান করার পর, গা যেন জুড়িয়ে যায়। পারিজাতবাবু বলেন, খেতে যাওয়ার কথা। ক্যান্টিন একটু দূরে তবে সুন্দর পরিবেশ। ছিমছাম পরিষ্কার ঝকঝকে। ভাত, ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, আলুঝিঙে পোস্ত, চারা পোনা, চাটনি সহযোগে সুন্দর খাওয়া হল। মে মাসে কলকাতায় যখন তীব্র গরম তখন রাজাভাতখাওয়ায় স্নিগ্ধ বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। দ্রুত গড়িয়ে যায় বেলা। অপরাহ্ণের আলো ম্লান হয়ে আসছে। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়। সূর্যের শেষ আলো যাই যাই করে চলে যায়। অন্ধকার বিদীর্ণ করে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠল। চাঁদের আলোয় প্লাবিত বনাঞ্চল আরও স্বচ্ছ আরও সুন্দর।
ভোরবেলা জঙ্গলের পথে হেঁটে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। শুকনো পাতা মাড়িয়ে বুনো গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হেঁটে যাই জঙ্গলের পথে। ফিরে এসে উষ্ণ চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখি এক্সপ্রেস ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে জঙ্গল বিদীর্ণ করে চলে যায়। ট্রেন অদৃশ্য হয় কিন্তু ডিজেল ইঞ্জিনের ঘস ঘস শব্দ অনেকক্ষণ কানে বাজে। আজ আমরা অর্থাৎ আমি ও আমার দুই বন্ধু যাব জয়ন্তীর জঙ্গলে। চুক্তির ভিত্তিতে গাড়ি ঠিক করা হয়েছে। জয়ন্তীর জঙ্গলে ঢোকার আগে পারমিশন করাতে হয়। সঙ্গে বাধ্যতামূলক গাইড নিতে হয়। দীর্ঘকায় শাল, সেগুন, আকাশমণি, শিরীষ গাছের জঙ্গলের বুক চিরে জিপ যাওয়ার রাস্তা। ভাগ্য ভালো থাকলে হাতি, ভল্লুক, হরিণ, বুনোশূকর দেখতে পাওয়া অসম্ভব নয়। একের পর এক রাস্তা ঘুরে চলে, এক জায়গায় হঠাৎই দেখা মেলে শাবক সহ দুই হস্তীর। রাস্তা পার হয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকে যায়। অনেকটা ঘোরার পর জয়ন্তী নদীর ধারে এসে দাঁড়াই। শুকনো নদী বড় বড় পাথর মাঝে ক্ষীণ জলধারা বয়ে চলেছে। দূরে যে পাহাড় দেখা যায় তার ওপারেই ভুটান। গাইড আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে ওই মেঘের মতো দূরে ওই পাহাড়ের খাঁজে দুর্গম বিখ্যাত মহাকাল মন্দির। গাড়ির মধ্যে খাবার আনা হয়েছে টিফিন ক্যারিয়ারে। জলের বোতল আছে। জয়ন্তীর পাহাড়ে বসে নদীর কূলে দুপুরের খাওয়া পিকনিকের সমতুল্য। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আবার শুরু পথচলা। জয়ন্তীর জঙ্গলে ঢোকার জন্য যে গাইডকে নিয়েছিলাম বেরবার সময় সে নেমে যায়। গেটের বাইরে কতগুলো দোকান। মামুলি চা জলখাবার ওমলেট আর স্থানীয় মিষ্টি পাওয়া যায়। ওমলেট আর চা খেতে খেতেই আকাশের দিকে তাকাই— চারদিক গুমোট। গাছের পাতা নড়ছে না। পশ্চিম আকাশে ঘনকালো মেঘ জমেছে। ওই দিকেই ভুটান ঘাট। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ড্রাইভার বলে, চলেন বাবু তাড়াতাড়ি ঝড় উঠবে। যাওয়ার পথের শুরুতেই ধুলোঝড় শুরু হল। প্রথমে অল্প অল্প তারপর মুষল ধারায় বৃষ্টি নামল। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মতো বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। আর তখনই দেখলাম রাজাভাতখাওয়া জয়ন্তী মিটারগেজ রেল লাইনের পরিত্যক্ত সেতু। আগে জয়ন্তী অবধি ট্রেন চলত দীর্ঘদিন তা বন্ধ। জয়ন্তী নদীর উপরে সেই পরিত্যক্ত সেতু অক্ষত পড়ে আছে।
ফরেস্ট বাংলো যখন পৌঁছলাম তুমুল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। প্রবল ঝড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দীর্ঘকায় শাল গাছ মাঝে মাঝে প্রবল ঝড়ের দাপটে নুয়ে পড়ছে। এক্ষুনি বুঝি ভেঙে পড়বে। বলতে বলতেই বিশাল গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। দুমদাম শব্দে জানলা বন্ধ হচ্ছে আবার খুলে যাচ্ছে। কেমন গা ছমছম করছে। বাধ্য হয়েই জানলা বন্ধ করে দিতে হয়। জয়ন্তীর জঙ্গলে এইরকম ঝড়বৃষ্টি মার্চ-এপ্রিল মাসে মাঝে মাঝেই হয় আর তার পর দু-একদিন রীতিমতো ঠান্ডা পড়ে যায়।
ঘণ্টা দুয়েক হয়ে গেল একটানা ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। পারিজাতবাবু ছাতা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাক্সে চা বিস্কুট নিয়ে এলেন। বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এই প্রবল ঝড় বৃষ্টি দেখার আনন্দই আলাদা। পারিজাতের কথায় জানতে পারলাম এই ঝড়বৃষ্টি শুধু ডুর্য়াসে নয়, অসমের বরাক ভ্যালির বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলে মার্চ এপ্রিল মাসে এইরকমই ঝড়বৃষ্টি হয়। তার জন্য লামডিং করিমগঞ্জ শিলচর শাখায় প্রায়ই রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পারিজাত জানান রাতে ক্যান্টিনে যেতে হবে না ও খাবার নিয়ে আসবেন। তবে এই গভীর দুর্যোগের রাতে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা করতে পারেননি। কেবল ভাত, দিশি মুরগির মাংস আর আলুভাজা সঙ্গে স্যালাড। কোনও ব্যাপার নয়, খিদের মুখে তাই যেন অমৃত! দীর্ঘক্ষণ ঝড়বৃষ্টি একনাগাড়ে চলার পর থামল যখন ঘড়ির কাঁটায় দশটা বেজে গিয়েছে।
জঙ্গলের মাঝে এটাই গভীর রাত। ঝড়বৃষ্টির দাপট কমেছে। দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অজস্র শুকনো পাতা বারান্দায় উড়ে পড়েছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে, রীতিমতো শীত করছে। পরের দিন সকালে আমাদের বক্সার দুর্গ দেখতে যাওয়ার কথা কিন্তু ড্রাইভার ফোন করে জানায় জঙ্গলের পথে গাছ পড়েছে তাই গাড়ি চলার পথ বন্ধ। বক্সা যাওয়া আর হল না। আরও একটা দিন কেটে যায়। শুনলাম রাজাভাতখাওয়া থেকে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার রাস্তাতেও গাছ উপড়ে পড়েছে। সুতরাং অটো-ট্রেকার চলবে না। প্রায় বন্দিদশায় আরও দুটো দিন কেটে গেল। তবে একঘেয়েমি লাগে না। অসাধারণ প্রকৃতির মাঝে আরও দুটো দিন কেটে যায়। পরদিন জিনিস গোছানোর পালা চলে। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরবার জন্য প্রাইভেট গাড়ির কথা বলেছি। ঠিক সময়ে গাড়ি এসে যায়। রাজাভাতখাওয়া পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলতে থাকে গাড়ি।
ছবি : লেখক