নিত্যানন্দ মহারাজ নিজের বিছানায় কম্বল জড়িয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসেছিলেন। সুমন্ত অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করল সেই ঘরে।
রাতের এই সময়টায় নিত্যানন্দ মহারাজের ঘরে বেশ খানিকক্ষণ থাকে সুমন্ত। মহারাজের রাতের আহার হয়ে গেলে সারাদিনের হিসেব নিকেশ আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করতে আসে সুমন্ত। আশ্রম চালানোর টাকা-পয়সায় কোনওরকম ঘাটতির সম্ভাবনা দেখা দিলে মহারাজকে আগাম জানাতে হয় সেটা। উনি বলে দেন কোথায় কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, কাকে মেল পাঠাতে হবে আর কাকে চিঠি। এই কাজটুকুর জন্য মিনিট পনেরো সময় লাগে। কাজ মিটে গেলে মহারাজ সুমন্তর সঙ্গে খানিক গল্প করেন। তখন সুমন্ত বলে কম, শোনে বেশি। মহারাজের কথা শুনতে তার ভালো লাগে। প্রায় দিনই মহারাজ তাঁর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো গল্প শোনান। সুমন্ত চুপ করে শোনে সেসব কথা। সেই পর্ব চলে আরও মিনিট পনেরো কিংবা কুড়ি। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে রেখে সুমন্ত নিজের ঘরে চলে যায়।
মহারাজ যে কেন ওইসব গল্প শোনান তার সঠিক কারণ বুঝতে পারে না সুমন্ত। অনেক ভেবে সুমন্তর মনে হয়েছে মহারাজ বোধহয় নিজের জীবনের ওই গল্পগুলো নিজেকেই শোনান। হয়তো তাঁর স্মৃতির ভাণ্ডারকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। কারণ, সুমন্ত খেয়াল করে দেখেছে নিত্যানন্দ মহারাজ এই সমস্ত কথা তাঁর শিষ্যদের সামনে খুব একটা বলেন না। তাদেরকে শুধুই জ্ঞানের পাঠ দেন। আজই যেমন শিষ্যদের শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতার খানিকটা অংশ ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছিলেন। কোনওদিন আবার শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পাঠ করে শোনান। কিন্তু, শিষ্যদের সঙ্গে মহারাজের যে সম্পর্ক তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক সম্পর্ক যেন গড়ে উঠেছে সুমন্তর সঙ্গে। আশ্রমের হিসেব-পত্র ও ওয়েবসাইট দেখভাল করার সামান্য একজন মাইনে করা কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও এক অপূর্ব নৈকট্য তৈরি হয়েছে বিরাশি বছরের মহারাজের সঙ্গে পঁচিশ বছরের যুবকের। যে কি না মাত্র দু’বছর আগে বিজ্ঞাপন দেখে একটা চাকরির আশায় এই আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছিল।
সুমন্ত নিত্যানন্দ মহারাজকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। কারণ, আচার ব্যবহার, কথাবার্তায় নিত্যানন্দ মহারাজ সকলের সেই শ্রদ্ধাটা নিজেই অর্জন করেছেন। বাঁকানাথ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা গুরু কিশোর মহারাজ প্রায় চল্লিশ বছর আগে নিত্যানন্দকে আশ্রমের মহারাজ করে সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ পাশমুক্ত করেছিলেন। তার পর উনি যে ক’বছর বেঁচে ছিলেন তার বেশিরভাগ সময়টাই বিভিন্ন তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর এখানে এলে আশ্রমেরই একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন। সেই ঘরে এখনও চৌকির ওপর কিশোর মহারাজের ছবি সাজানো আছে।
কথায় আছে গুরু মেলে লাখ লাখ কিন্তু যোগ্য চেলা সহজে মেলে না। সুযোগ্য শিষ্য পেয়ে কিশোর মহারাজ তাই পরম নিশ্চিন্তে আশ্রমের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। তখন নিত্যানন্দ মহারাজের বয়স মাত্র বিয়াল্লিশ। এসব কথা মহারাজের কাছেই শুনেছে সুমন্ত।
আজ মকর সংক্রান্তির স্নানের যোগ গেছে। প্রচুর পুণ্যার্থীর ভিড় সামলাতে হয়েছে আশ্রমে। আশ্রমের সকলেই তাই খুব ক্লান্ত। সুমন্ত ভেবেছিল হিসেবপত্তরের দুয়েকটা কথা বলেই আজ সে চলে যাবে এই ঘর থেকে। কিন্তু আজ সুমন্ত ঘরে ঢুকে কিছু বলার আগেই মহারাজ তাকে হাতের ইশারায় এবং চোখের ইঙ্গিতে কিছু না বলে চুপ করে বসতে বললেন। নির্দেশ মেনে সুমন্ত বসে আছে চুপ করে। আজ ঠান্ডাটা মারাত্মক। গায়ের চাদরটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিল। ঘরে কোনও শব্দ নেই। নৈঃশব্দ প্রকট হলে আস্তে আস্তে দেওয়াল ঘড়ির টিক-টিক শব্দ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল। হঠাৎ মহারাজ যেন ওর মনের কথাটা ধরে নিয়েই বললেন, ‘সময়, বয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছ? শুনতে পাচ্ছ তার বয়ে চলার শব্দ?’
সুমন্ত কিছু বলে না। মহারাজ বলে চলেছেন, ‘বুদবুদের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে পল অনুপল। এই মুহূর্তে যা আছে, পর মুহূর্তে তা অতীত। একটু আগেই তুমি যা চেয়েছিলে এখন আর মিথ্যা বলে তা ফিরিয়ে নিতে পার না। কারণ, সেই মুহূর্তের চাওয়া সেই মুহূর্তের জন্যই সত্য হয়ে রয়ে গেছে। এখনকার চাওয়া অন্য এক সময়ের।’
মহারাজ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর যেন নিজের মনেই কথা বলতে শুরু করলেন, ‘তখনও এই আশ্রম গুরুজি চালাচ্ছেন। আমি তাঁর মূল চেলা। আমার বয়স চল্লিশ পেরয়নি। পাকা দালান ছিল না। তাই আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করা যেত না। মেলার সময় সামনের ফাঁকা জায়গায় এখনকার মতোই বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে প্যাণ্ডেল বাঁধা হতো। পুণ্যার্থীদের রাত্রি বাসের জায়গা। পঞ্চাশ-ষাট জন লোকের থাকার জায়গা হতো সেখানে। সেবার এক স্বামী-স্ত্রী সেখানে থাকতে এল। বিহার থেকে এসেছিল তারা। গঙ্গাসাগরে বিহার থেকে দল বেঁধে এমন প্রচুর মানুষ আসে।
‘কিন্তু সেই স্বামী-স্ত্রী কোনও দলের সঙ্গে আসেনি। তারপর সন্ধেবেলা গুরুজির সাক্ষাৎ পেয়ে হঠাৎই কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পায়ে পড়ে গেল দু’জনই। জোর করে পা ছাড়িয়ে তাদের তোলার পর জানা গেল বিয়ের সাত-আট বছর কেটে গেলেও তাদের কোনও সন্তান হয়নি। লোকটি সন্তান চায়। আর মহিলাটি চায় মা হতে। গুরুজির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থেকেও অঝোরে কাঁদছে সেই মা হতে না পারা মেয়ে। লোকটি বলল, একটা তাবিজ কবজ কিছু দিন বাবাজি। গাঁয়ে সবাই খারাপ কথা বলে। মা না হলে ওকে আমার পরিবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। গুরুজি ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেও বুজরুকিতে বিশ্বাস করতেন না। গুরুজি বললেন, বাঁকাচাঁদ চাইলে তুমি ঠিক মা হবে, তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখ। তারপর মহিলার মাথায় হাত রেখে খানিকক্ষণ নামজপ করে তাদের শান্ত করলেন।
‘পরদিন সকালে ছিল স্নানের মহাযোগ। ভোরবেলাতেই সবাই বেরিয়ে গেছে স্নানে। তাঁবু প্রায় ফাঁকা। আমি স্নান সেরে আশ্রমে ফিরছি। হঠাৎ এক শিশুর কান্না শুনে উঁকি দিলাম তাঁবুর ভিতরে। দেখি, শিশুর কান্না শোনা গেলেও তাঁবুর ভিতরে আর কেউ নেই। আওয়াজ লক্ষ করে তাঁবুর এক কোণে পৌঁছে দেখি প্রায় সদ্যোজাত এক শিশু চিৎকার করে কেঁদে চলেছে। আশ্রমেরই দেওয়া কম্বলে তার বুক পর্যন্ত জড়ানো রয়েছে। যেন কেউ খুব যত্নে শিশুটিকে শুইয়ে রেখেছে এখানে। চারপাশে ডাকাডাকি করেও কাউকে পেলাম না। এমন দুধের শিশুকে এখানে একলা ফেলে রেখে তো এর মা-বাবা একসঙ্গে স্নানে চলে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও আছে। আমার ডাকাডাকিতে কাছাকাছি যারা ছিল তারা অনেকেই ছুটে এল সেখানে। কিন্তু বাচ্চাটির মা-বাবাকে পাওয়া গেল না। এক মহিলা বাচ্চাটিকে কোলে তুলতে গিয়ে কম্বলের ভাঁজে একটা কাগজ পেল। আমি সেই কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি একটা দু লাইনের চিঠি। মহারাজ, আমরা পাপ করলেও এই শিশুটির তো কোনও পাপ নেই। ওকে রক্ষা করুন। ইতি, হতভাগ্য বাবা-মা।’
নিত্যানন্দ মহারাজ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। সুমন্ত অন্যদিন মহারাজের গল্পের মাঝে চুপ করে থাকলেও আজ অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর? কী হল সেই শিশুর?’
মহারাজ স্মিত হেসে আবার শুরু করলেন, ‘এত বড় মেলায় হারিয়ে ফেলা কিংবা হারিয়ে যাওয়া খুব সোজা। ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় কত মানুষ যে হারিয়ে যায়। তখনকার দিনে ফোনের চলও তেমন ছিল না। বড় বড় শহরেও সীমিত কিছু লোকের বাড়িতে ফোন থাকত। তাই সেসময়ে হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ ছিল। শিশুটিকে নিয়ে গেলাম গুরুজির কাছে। উনি সব শুনে হো হো করে হাসতে লাগলেন। তারপরেই দু’হাত মাথার ওপরে তুলে সুর করে জয় গৌর, জয় নিতাই, বলে নাচতে শুরু করলেন।
‘আমি হতবাক হয়ে গুরুজিকে জিজ্ঞেস করলাম, এ কী হচ্ছে গুরুজি? একটা দুধের শিশু অনাথ হয়ে পড়ে আছে আর আপনি আনন্দ করছেন? গুরুজি নাচ-গান থামিয়ে বললেন, ওরে স্বয়ং বাঁকাচাঁদ যার নাথ হয়েছেন, সে অনাথ হবে কী করে? এই শিশুর মা এক্ষুনি এসে হাজির হবে এখানে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, গুরুজি, যে মা চিঠি লিখে নিজের সন্তানকে ফেলে চলে গেল সে কি আর ফিরে আসবে এখানে? আমার প্রশ্ন শুনে গুরুজি শুধু মুচকি হাসলেন।
‘কিছুক্ষণ পর পুণ্যস্নান সেরে আশ্রমে ফিরে এল সেই দম্পতি যারা কাল সন্ধ্যায় গুরুজির কাছে সন্তান কামনায় কান্নাকাটি করছিল। গুরুজি সেই মহিলাকে নিজের ঘরে ডেকে তার কোলে তুলে দিলেন সদ্যোজাত শিশুটিকে। কিন্তু কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাকে নিজের বলে মেনে নিতে ওদের মনে প্রথমে বেশ দ্বিধা ছিল। গুরুজি বোঝালেন, তোমরা সন্তান চেয়েছিলে, ঈশ্বর স্বয়ং তোমাদের সেই আশা পূরণ করে দিয়েছেন। একে অস্বীকার করবে কীভাবে? ওরা তখন বলেছিল যে আত্মীয়-পরিজন, গ্রামের মানুষ, কেউ তো এটা সহজে মেনে নেবে না। মহিলা বলল, গ্রামের লোকেরা তো বাচ্চাটাকেও খুব জ্বালাবে। গুরুজি তখন বললেন, তোমরা বছর দুয়েক আমার এখানে থাক। গ্রামের বাড়িতে চিঠি লিখে পাঠাও যে তোমরা দু’জন মিলে কিছুদিন আশ্রমে থেকে ঠাকুরের সেবা করলে তবেই তুমি মা হতে পারবে।
‘ঠিক দু’বছর এই আশ্রমে ছিল তারা। দু’বছর পরের সাগরমেলার শেষে ফিরে গেল নিজের গাঁয়ে। লক্ষ্মীসরাই জেলার লহুয়ারা গ্রাম’।
এ পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন মহারাজ। সুমন্ত আরও কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য উশখুশ করছিল। মহারাজ বললেন, ‘আলোটা নিভিয়ে দাও’।
(দুই)
সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে কম্বল জড়িয়ে শুয়েও ঘুম আসে না সুমন্তর। কোথায় যেন হিসেবের গরমিল হয়ে গেছে। দিনের অ্যাকাউন্টস মেলাতে বসে কোনও রসিদ ঠিকমতো না পেলে কিংবা হিসেবে ভুলচুক ধরা পড়লে ঠিক এমন অস্বস্তি হয়। আজ সকালের একটা ঘটনা বার বার ফিরে ফিরে আসছে মনে।
গতকাল বিকেল থেকেই মেলায় ভিড় বাড়ছিল। কারণ, পরদিন শেষ-রাতে শুরু হবে সংক্রান্তির স্নান। খুব ভোরে উঠে সুমন্তও পৌঁছে গিয়েছিল সাগর তীরে। তখন পুণ্যার্থীদের ঢল নেমেছে সাগরে। সংক্রান্তির স্নান করে পুণ্যার্জন করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তখনও ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। লম্বা খুঁটিতে লাগানো আলোতে তটভূমি আলোকিত হয়ে আছে। সুমন্ত অনেকটা দূর থেকেই দেখছিল হাজারও মানুষের পুণ্যস্নান। ওখান থেকে সমুদ্র আর তটভূমির বিশাল ব্যাপ্তির পটভূমিতে মানুষগুলিকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। সুমন্তর মনে হল প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে মানুষ সত্যিই প্রায় কীট-পতঙ্গের মতো। এই বিশাল চরাচরের কাছে পুণ্য ভিক্ষা করাই যায়। তবুও সুমন্তর কখনও সাগরে ডুব দিয়ে পুণ্যার্জনের ইচ্ছে হয়নি। প্রায় দু’বছর এই পুণ্য-সাগরের কিনারে থাকতে হচ্ছে সুমন্তকে, এই নিয়ে তিনটে সাগরমেলা দেখা হয়ে গেল তার, অথচ তার পুণ্যের ভাঁড়ার এখনও শূন্যই থেকে গেল।
সুমন্ত গায়ের চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল। কনকনে ঠান্ডায় হাতে-পায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। ভোর পাঁচটার আগেই আশ্রমের প্রায় সবাই স্নান সেরে নিয়েছে। সুমন্তর এই ঠান্ডায় সাগরে ডুব দেওয়ার ইচ্ছে নেই। আশ্রমের লোক হয়েও ও যেন এই আশ্রমের অন্যান্যদের থেকে আলাদা। বোধহয় মাইনে করা কর্মচারী আশ্রমের পুণ্যের ভাগ পায় না। ও তা চায়ও না।
বেশ খানিকক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকার পর ও কপিলমুনি আশ্রমের দিকে হাঁটতে শুরু করল। খানিক দূর যাওয়ার পর হঠাৎই কে যেন হাঁক দিয়ে ডাকল তাকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে মাধব কাকা ওর খাবারের দোকান থেকে ডাকছে সুমন্তকে।
এই দু’বছর আশ্রমে থাকার জন্য এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা সবাই চিনে গেছে ওকে। সুমন্ত এগিয়ে গেলে মাধব কাকা দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ওকে ডেকে নিল ভিতরে। বাঁশের খুঁটি আর দরমার বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট্ট দোকান। বাঁশ চিরে পেরেক গেঁথে বসার বেঞ্চ। কচুরি, শুকনো মিষ্টি আর চা-বিস্কুট পাওয়া যায়। সুমন্ত কখনও সখনও কচুরি কিংবা চা-বিস্কুট খায় এই দোকানে।
মাধব কাকা বলল, ‘দেখ তো সুমন্ত, এই বুড়ি মা বোধহয় হারিয়ে গেছে মেলায়। ভালো করে কিছু বলতেও পারছে না’।
সুমন্ত তাকিয়ে দেখে দোকানের উনুনের পাশে বেঞ্চে বসে আছে এক সত্তরোর্ধ্ব মহিলা। ভেজা কাপড়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। স্নান করে ফেরার পথেই হয়তো হারিয়ে গেছে। আসলে স্নান করে ফেরার সময় অনেকেই দিক ভুল করে ফেলে। বিপুল পারাবার আর বিস্তৃত চরাচরে দিগভ্রান্ত হয়ে মানুষের ভিড়েই হারিয়ে যায়। প্রতিদিনই মেলায় কত মানুষ যে এভাবে হারিয়ে যায়।
সুমন্ত এগিয়ে গেল বৃদ্ধার দিকে। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সঙ্গের লোকজন কোথায়?’ প্রশ্নটা করেই খুব বোকা বোকা লাগল সুমন্তর। হয়তো কিছু একটা বলতে হবে বলেই কথাটা বলে ফেলেছিল। কী করবে ভাবছে ঠিক এমন সময় সেই বৃদ্ধা বলল, ‘হাম তো ভুলা গ্যয়া।’
মাধব কাকা বলল, ‘যাক, এতক্ষণে তাও কিছু বলল। কিন্তু সুমন্ত এ তো বলছে সব ভুলে গেছে। কী হবে তাহলে?’
সুমন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘কহাঁ জানা হ্যায় কুছ ইয়াদ হ্যায় ক্যা?’
বৃদ্ধা খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘বাঁকানাথ’।
মাধব কাকা প্রায় লাফিয়ে উঠল, ‘আরে সুমন্ত, এ তো তোমাদের আশ্রমেই যেতে চাইছে। নিয়ে যাও ভাই। এই ঠান্ডায় ভেজা কাপড়ে আর বেশিক্ষণ থাকলে নিউমোনিয়া হয়ে মারা যাবে’।
(তিন)
সারারাত ভালো করে ঘুমতে পারল না সুমন্ত। কাঁটাটা বিঁধে আছে এখনও। কীসের কাঁটা ও জানে না। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে। মহারাজের কথায় কীসের ইঙ্গিত ছিল? সেই মুহূর্তের চাওয়া আর এই মুহূর্তের চাওয়া কী?
ভোর হতে না হতেই সুমন্ত ছুটে যায় মহারাজের ঘরে। এই সময় প্রাতঃকৃত সেরেই মহারাজ ধ্যানে বসে যাবেন। তার আগেই ধরতে হবে মহারাজকে। চাওয়া পাওয়ার কোনও হিসেবে গরমিল হল আজ?
ঘরের দরজা ঠেলে দেখে মহারাজ ধ্যানে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দয়ানন্দ আসন পেতে ধূপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। সুমন্ত হাত জোর করে বলল, ‘মহারাজ, একটা কথা জানার ছিল।’
মহারাজ হাত তুলে তাকে থামতে বললেন। তারপর আসনে বসতে বসতে বললেন, ‘ধ্যানের পরে এসো। আমি সব বলব। ততক্ষণ দয়ানন্দের সঙ্গে যাও, আশ্রমে যেসব পুণ্যার্থীরা রয়েছেন তাদের খোঁজ-খবর নাও, দেখভাল কর’।
সুমন্ত দয়ানন্দের সঙ্গে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসার সময় দয়ানন্দ বলল, ‘আশ্রমে সকালের চা হয়ে গেছে। চল, আশ্রমে যারা রয়েছে তাদের চা-বিস্কুট দিয়ে আসি’।
গঙ্গাসাগর মেলার সময় প্রায় একশো পুণ্যার্থী আশ্রয় পায় এই আশ্রমে। খুব বয়স্ক মানুষেরা থাকে আশ্রমের বড় বড় তিনটে ঘরে আর অন্যান্যরা থাকে আশ্রমের সামনে খাটানো তাঁবুতে। সকালে তাঁবুর ভিতরে এক কোণে চা ভর্তি স্টিলের জার বসিয়ে দেওয়া হয়। কাগজের কাপ আর বিস্কুট রাখা থাকে পাশে। সবাই যে যার মতো নিয়ে নেয়। আর বয়স্ক মানুষদের জন্য তাদের ঘরে চায়ের কেটলি নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসা হয়।
তাঁবুতে চায়ের ব্যবস্থার পর আশ্রমের ঘরে চা দিতে গিয়ে সেই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হল। সুমন্ত চায়ের কাপ তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘গাঁও কা নাম ইয়াদ হ্যায়?’
বৃদ্ধা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সুমন্ত প্রশ্নটা আবার করল। আরও খানিকক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে থাকল সেই বৃদ্ধা। তারপর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে খুব আস্তে বলল, ‘গাঁও কা নাম মনে নেই’। সুমন্ত অবাক হয়ে গেল এমন হিন্দি আর বাংলার মিশ্রিত ভাষা শুনে। তবে কি মহিলা বাঙালি? এমন সময় আশ্রমের একজন এসে সুমন্তকে বলল, ‘গুরুজি আজ বেশিক্ষণ ধ্যান করতে পারলেন না। তোমাকে ডাকছেন, যাও।’ সুমন্ত দ্রুত পৌঁছে গেল নিত্যানন্দ মহারাজের ঘরের কাছে। দরজায় টোকা দিয়ে বলল, ‘আসব?’
মহারাজ ডেকে নিলেন ঘরে। সুমন্ত ঘরে ঢুকে প্রথমেই বলল, ‘কালকের হারিয়ে যাওয়া ওই বুড়ি-মার সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?’
মহারাজ হাতের ইশারায় ওকে বসতে বলে খুব শান্ত স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গে একান্তে কথা হয়েছে’।
‘উনি কি বাঙালি?’
‘এ প্রশ্ন কেন করছ?’
‘কাল যখন প্রথম দেখা হল উনি বললেন হাম তো ভুলা গয়া। হিন্দিভাষী মানুষ নিজেকে হাম বলবে না। বলবে ম্যাঁয়। আর আজ উনি বললেন, গাও কা নাম মনে নেই’।
মহারাজ স্মিত হেসে বললেন, ‘উনি মগধী ভাষায় কথা বলছেন। মগধী ভাষায় অনেক বাংলা শব্দ আছে। আর ভুলা গয়া মানে ভুলে যাওয়া নয়, হারিয়ে যাওয়া’।
‘আচ্ছা, আপনার সঙ্গে তো উনি কথা বলেছেন শুনলাম। উনি কি আপনাকে গ্রামের নাম বলেছেন?’
নিত্যানন্দ মহারাজ চোখ বন্ধ করে রাখলেন কিছুক্ষণ। সুমন্ত অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আপনি দয়া করে বলুন। কাল রাত থেকে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ভালো করে ঘুমতে পারিনি’।
মহারাজ চোখ বন্ধ অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার এমন কেন হচ্ছে সুমন্ত?’
সুমন্ত বলল, ‘মহারাজ, কাল আপনার বলা গল্পের মধ্যে কিছুর ইঙ্গিত ছিল। সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। তাই এই বৃদ্ধার গ্রামের নাম জানতে চাইছি’।
মহারাজ চোখ খুলে খুব ধীর গলায় বললেন, ‘লহুয়ারা গ্রাম, জেলা লক্ষ্মীসরাই’।
চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সুমন্ত। ‘আপনি এই জন্য কাল রাতে আমাকে গল্পটা শুনিয়েছিলেন! তার মানে সকালে বুড়ি-মাকে দেখে আপনি ঠিক চিনতে পেরেছেন।’
‘মায়েদের চিনতে অসুবিধে হয় না, সুমন্ত। নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব মনে আছে ওঁর। কিন্তু বলেননি কাউকে। হয়তো স্নান করে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়ে ছেলেকে শেষবারের মতো দেখার সময়েও মনে মনে বলেছেন, ভালো থাকিস বাছা’।
সুমন্ত হতবাক তাকিয়ে থাকে মহারাজের দিকে। এই ক’বছরের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছে কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে মেলার ভিড়ে এভাবেই ত্যাগ করে চলে যায় তাদের নিজের সন্তান। কিন্তু অনাথ শিশুটিকে কোলে তুলে নেওয়া সেই মায়ের জন্যও অপেক্ষা করে ছিল এমন এক সময়!
মহারাজের ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে সুমন্ত। মেলার ভিড়েও নিজেকে বড্ড একা লাগে তার। হাঁটতে হাঁটতে সাগর কিনারে এসে দাঁড়ায়। অসংখ্য মানুষ স্নান করছে সাগরে। সামান্য পুণ্যের লোভে। সুমন্তর চোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে আসে। সমস্ত মানুষ হারিয়ে যায় তার দৃষ্টি থেকে। পড়ে থাকে শুধু বিপুল পারাবার।
অলংকরণ: সুব্রত মাজী