খাদের সীমানা বরাবর গাঁথা পাঁচিলের ঠিক পরেই, প্রায় হাত বাড়ানো দূরত্বে, নীচের সুগভীর গিরিখাত ধরে ছলবলিয়ে প্রবহমানা তীব্র স্রোতস্বিনী অলকানন্দা। তার স্বচ্ছ নীলাভ জলরাশি চলার পথে এখানে-ওখানে পাথরের বুকে ধাক্কা খেয়ে, সফেন ধারায় ছুটে চলেছে সুতীব্র গতিতে। অনুপেক্ষণীয় তার চোখ রাঙানি, অতি উদ্দাম তার উচ্ছলতা। অলকানন্দার ওপারের বজ্রগম্ভীর পর্বতশ্রেণির পিছনে থাকা ঘন সাদা মেঘের আস্তরণের উপর থেকে দৃশ্যমান শুধুমাত্র ‘নীলকণ্ঠ’ শৃঙ্গের তুষার-মুকুটখানি। আর তারই নীচে সামান্য ডানদিকে একটু কোনাকুনি তাকালেই চোখে পড়ে আলো-ঝলমল, নানা রঙে রঙিন, দৃষ্টি-আকর্ষক ‘বদ্রীনারায়ণ’-এর মন্দির (৩,১৩৩ মিটার)। তার সামনের প্রশস্ত চাতালে ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দর্শনার্থী। অসম্ভব খুশিতে মন ভরিয়ে দেওয়া অপূর্ব সব দৃশ্যের কোলাজ।
বিকেলের প্রায় শেষ লগ্নে, বদ্রীনাথের ‘ভারত সেবাশ্রম’-এর নতুন বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের গাড়ি। কাচ তোলা থাকায় গাড়ির বাইরে ঠান্ডার প্রকোপ এতক্ষণ টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই স্বাগত জানাল কনকনে ঠান্ডা হাওয়া।
চেক ইন সংক্রান্ত নিয়মকানুন দ্রুত সেরে সবাই দৌড়লাম দোতলায়– আমাদের জন্য বরাদ্দ ঘরগুলির দখল নিতে। আসলে লাগেজ খুলে কড়া ঠান্ডার উপযোগী ভারী পোশাক বের করে গায়ে চাপাতে। তারপর সন্ধের সময় ঘরের বাইরের লম্বা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খুব অল্প সময়ের জন্যই, খুশিতে মন ভরিয়ে দেওয়া এমন অপূর্ব সব দৃশ্যের কোলাজ চাক্ষুষ করার সুযোগ হল। পাহাড়ে দিনের অবসান হয় অত্যন্ত দ্রুততায়। ফলে কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই চারদিক কালো হয়ে রাত্রি নামল বদ্রীনাথে। আর নির্মল আকাশ জুড়ে ঝিকমিকিয়ে উঠল অজস্র নক্ষত্রের ঝাঁক। অলকানন্দার ওপারের পাহাড় আর আর এপারের আমাদের মধ্যে বাধাহীন বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা পেয়ে পাহাড়ি শীতল হাওয়াও তার দাপট দেখাতে শুরু করল।
খানিকক্ষণ পরে বিস্কুট আর গরম চায়ের কল্যাণে বেশ ঝরঝরে হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বদ্রীনারায়ণের মন্দির দর্শনে। পাঁচ-ছ’শো মিটার হাঁটা পথ। বেশ প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন। দু’পাশে প্রচুর দোকানপাট ও রেস্তরাঁ। দু’বার বাঁদিকে বাঁক নিয়ে গড়ানো সেই পথ ধরে গিয়ে পৌঁছলাম অলকানন্দার উপর নির্মিত সেতুর মুখে। মন্দিরের দিকে যত এগচ্ছি, ততই বাড়ছে জনসমাগম। সেতুর নীচ দিয়ে অলকানন্দা তখন ‘আপন বেগে পাগলপারা।’ আর সেতুর অপর প্রান্তে পাহাড়ের গায়ে ডানদিকে এক প্রাকৃতিক ঊষ্ণ প্রস্রবণ। দৃশ্যতই ধোঁয়া ওঠা প্রস্রবণের গরম জলে স্নান সেরে নিচ্ছেন বেশ অনেক পুণ্যার্থী! সেতু পেরিয়ে কিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমরা পৌঁছলাম মন্দিরের সেই সুপ্রশস্ত আঙিনায়।
বদ্রীনারায়ণের দর্শনপ্রার্থী হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে নানান কথার ভিড় জমছিল মনে। ভাবছিলাম এই সেই বদ্রীনাথ, যার সঙ্গে মহাভারতের কত গল্পগাথা জড়িয়ে রয়েছে। মনে পড়ে, ছোটবেলার স্কুলপাঠ্য বাংলা বইয়ে পড়া ‘বদ্রীনাথের পথে’— শীর্ষক প্রবন্ধটির কথাও। দুর্গম পথের দুঃসহ কষ্ট স্বীকার করে, এমনকী পথেই মৃত্যুবরণ হতে পারে জেনেও পিছপা হননি পুণ্যার্থীরা। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই প্রাচীন হিন্দুতীর্থে পৌঁছনোর জন্য সেই কত কাল আগের ভক্তদের আকুলতার নিখুঁত বর্ণনা যেন কোনও জীবন্ত ধারাবিবরণীর মতোই আজও গেঁথে আছে মনে। কত পরিশ্রম ও কত ত্যাগ স্বীকারের পরেই কতিপয় পুণ্যার্থীর ভাগ্যে এমন কঠিন তীর্থযাত্রায় সাফল্য লাভের স্বাদ জুটত।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে, আনমনেই কখন যেন দর্শনার্থীদের লাইন ধরে এগিয়ে এসে পৌঁছই মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজায়। ওই তো সামনেই ভগবান বিষ্ণু তথা নারায়ণের অপরূপ বিগ্রহ। এখানে ইনি ভগবান ‘বদ্রীনারায়ণ’ নামে খ্যাত। মন্দিরের ভিতরের শান্ত-সৌম্য পরিবেশে, ভগবান বদ্রীনারায়ণের সুশীল রূপের সামনে শ্রদ্ধাবনত হয়ে দু’দণ্ড কাটিয়ে, প্রশান্ত হৃদয়ে মন্দির থেকে বেরনোর সময় বেশ তৃপ্তির স্বাদ অনুভব করি। এই তৃপ্তি কোনও এক শৌখিন তীর্থযাত্রীর তৃপ্তিবোধ নয়, এই তৃপ্তি মনের গভীরে গেঁথে থাকা শৈশবের কল্পনায় আঁকা ‘বদ্রীনাথ’-এর সেই বিগ্রহ দর্শনের তৃপ্তি।
মোবাইল অ্যালার্মে পরদিন ঘুম ভেঙে যায় ভোর সাড়ে চারটেয়। বন্ধ ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, আকাশ পরিষ্কার। সামনেই সম্পূর্ণ বাধাবন্ধহীন, উন্মুক্ত পথে নীলকন্ঠ-এর শিখরে সূর্যের প্রথম আলোকপাতের মূহূর্তটি প্রত্যক্ষ করার আশায় ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে আসি ব্যালকনিতে। ডানদিকে একেবারেই জনশূন্য বদ্রীনারায়ণ মন্দিরপ্রাঙ্গণ। আর তার বাঁদিকে, একদম মুখোমুখি সাদাটে অবয়ব নিয়ে দণ্ডায়মান নীলকণ্ঠ শৃঙ্গ।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নজরে এল সামনের দুধসাদা নীলকণ্ঠের ধবধবে তুষারশৃঙ্গের একদম মাথায় সোনালি রঙয়ের ছোঁয়া। সামান্য সময় পরেই সেই স্বর্ণালি আভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল নীলকণ্ঠের শরীরে। অপূর্ব সেই দৃশ্যের ছবি মনের ক্যানভাসে এঁকে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যামেরায় ‘ক্লিক’ পড়তে থাকে অনবরত। ধীরে ধীরে দু’পাশের নীচের সবুজ পাহাড়েও এসে পড়ে কাঁচা রোদের নরম রশ্মি। আর নীলকণ্ঠের গায়ের সোনালি রং ক্ষণেক্ষণেই পরিবর্তিত হতে হতে ফিকে হলুদ থেকে হালকা সাদা হয়ে চোখধাঁধানো ধবধবে সাদায় রূপান্তরিত হয়ে রাজকীয় চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। কাকভোরের নীলকণ্ঠ-র এই দুর্দান্ত রূপান্তর চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা যেমন অসামান্য, তেমনই অবিস্মরণীয়।
সকালের পেটপুজো সেরে বেরতে প্রায় বেলা দশটা বেজে গেল। যাব মানাগ্রাম হয়ে বসুধারা জলপ্রপাত। ভারত-তিব্বত সীমান্তে এই পথের শেষ জনপদ মানাগ্রাম (৩ হাজার ২০০ মিটার) বদ্রীনাথ থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রায় সমতল পথ ধরে এগতে এগতে চোখে পড়ে, বাঁদিকে মাঝে মাঝে ভুট্টা আর রাই শাকের খেত। ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি ঘর, দু’-একটি দোকান তার সামনে উলের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের ছোটখাট পসরা আর এই সবের পিছনে উচ্ছল অলকানন্দা। গ্রামের মুখেই একটি প্রবেশতোরণ। তাতে লেখা—‘India’s Last Village: MANA।’ কেমন একটা দূরদূরান্তে পৌঁছনোর অনুভূতি হঠাৎই যেন গ্রাস করে বসে। গাড়ি থেকে নামতেই ডাইনে বাঁয়ে অনেকটা খোলা জায়গা জুড়ে শনশনে হাওয়ার দাপট টের পাই এই রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরেও। মুখোমুখি বেশ কিছুটা দূরে বিরাট এক প্রায় ন্যাড়া পাহাড়ের প্রাকৃতিক দেওয়াল।
মানাগ্রামের মূল দ্রষ্টব্য গণেশ গুহা, ব্যাস গুহা ও সরস্বতী নদীর পার্শ্ববর্তী ভীমপুল। ডানদিকের বড়-বড় রাক্ষুসে পাথরের ফাঁক গলে নির্গত সরস্বতী নদী মানাগ্রামের শেষ প্রান্ত দিয়ে বয়ে এসে মিশেছে অলকানন্দায়। হিমালয়ের এই অঞ্চলের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মহাভারতের অসংখ্য পৌরাণিক গল্পগাথা। তার একটি যেমন— মানাগ্রামের ছোট্ট এই গুহাতে বসেই ব্যাসদেব ‘মহাভারত’ রচনা করেছিলেন— তেমনই সরস্বতীর পাশের পাথরে রয়েছে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের পায়ের ছাপ। পাণ্ডবদের স্বর্গারোহিণী যাত্রার পথে বাধা সৃষ্টিকারী সুবিশাল এই পাথরটিকে নাকি ভীম পা দিয়ে সরিয়ে দ্রৌপদীকে এগনোর পথ করে দেন। সেই পায়ের ছাপই রয়েছে ওই পাথরের গায়ে।
ভীমপুলের পরেই খাড়া, পাথুরে পাহাড়ের সুউচ্চ ও সুদীর্ঘ প্রাচীর। আমরা এবার বাঁদিকে ঘুরে, কয়েকটা পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছই দেশের প্রান্তিক ‘কাফে’তে— নামটিও মানানসই ‘India’s Last Tea & Coffee Corner।’ এমন পরিবেশে, এমন একটি দোকানে চা বা কফি না খেলেই নয়। সুতরাং দ্রুত একটি টি-ব্রেকের পর, বেলা ১১টা ১৫ মিনিট নাগাদ আমাদের পদযাত্রা শুরু হল সেখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ‘বসুধারা’-র পথে। মহাপ্রস্থান যাত্রায় এই পথ ধরেই নাকি গিয়েছিলেন দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডব। কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব দেহত্যাগ করেন বসুধারার কাছেই।
শুরুর দিকে বেশ কিছু বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা ওঠার পর, মোটামুটি প্রশস্ত, পায়ে চলা ঠিকঠাক চড়াইপথ। কিন্তু কয়েকশো মিটার যেতে না যেতেই শুরু হল ছোট ছোট নুড়ি ও ভাঙা পাথরের এবড়ো-খেবড়ো টুকরো ছড়িয়ে থাকা অসমান পথ। একটু অসতর্ক হলেই — না, খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু হঠাৎ পিছলে পড়ে পায়ে বা অন্য কোথাও চোট লাগার অথবা পা মচকে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। সুতরাং খুব শ্লথ গতিতেই এগতে থাকি আমরা। ডানদিকে সেই খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল আর বাঁদিকে খাদের নীচে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা অলকানন্দার মনকাড়া দৃশ্যপট। মাথার উপরে ঝকঝকে আকাশের নির্মেঘ নীলিমা। তা সত্ত্বেও কনকনে ঠান্ডা হাওয়া জ্যাকেটাবৃত গায়ে আঁচড় কাটতে না পারলেও, নাকের ডগায় আর কানে ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে। হাঁফ ধরছে ধীরে ধীরে। এক ঢোঁক করে জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিই সবাই।
যত এগচ্ছি, চারপাশের প্রকৃতি ততই মেলে ধরছে তার অপরূপ নৈসর্গিক শোভা। অলকানন্দার ওপারের পাহাড়ের ঢাল আর আমাদের ডানদিকের প্রাচীরসম পাহাড়ের ঢাল সামনের দিকে অনেক দূরে, একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়ে ‘V’ আকৃতির রূপ ধারণ করেছে। তার মাঝখান দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এক শ্বেতশুভ্র তুষারশৃঙ্গ। যেন সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আমাদের। পথের কষ্ট ভুলিয়ে হাতছানি দিয়ে আহ্বান জানাচ্ছে, গতি বাড়িয়ে বসুধারায় পৌঁছনোর জন্য। কিন্তু দ্রুত এগব কী; রাস্তার হাল উত্তরোত্তর খারাপ হয়ে চলেছে। ডানদিকের পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি ঝর্ণার জল এক জায়গায় ধস নামিয়েছে পথে। তার এক পাশ দিয়ে জমে থাকা জল আর কাদামাটির উপর দিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে পা টিপে টিপে হেঁটে, সেই দুর্গম জায়গাটুকু পেরিয়ে গিয়ে সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
আবার সৌন্দর্যপিপাসু চোখে প্রকৃতির অপরিসীম নিসর্গ উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলি। পথের উচ্চতা যত বাড়ছে, শীতল হাওয়ার তীব্রতাও বেড়ে চলেছে। কোথাও খুব ভয় ধরানো খাড়া পথ নয় বা অপ্রশস্তও নয়। তবুও বেশ কঠিন ও রীতিমতো হাঁফধরানো এই পায়ে চলা চড়াইপথ। সবচেয়ে বড় সমস্যা পায়ের নীচে কোথাও ঝুরো পাথর, কোথাও বালির মতো মাটি, আবার কোথাও বা নড়বড়ে চ্যাপ্টা পাথর ছড়ানো। এক মূহূর্তের জন্যও অসতর্ক হওয়ার জো নেই। জ্যাকেটের ভিতরে শরীর ভিজে গিয়েছে ঘামে, অথচ মুখে আর কানে ঝাপটা মারছে প্রবল ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু বসুধারার ধারাপাত এখনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। মানা থেকে আমাদের গন্তব্যের দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের বেশি বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু থামার উপায় নেই। ওদিকে আকাশের অতর্কিত রূপবদল। কোত্থেকে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছে কালো মেঘের শামিয়ানা। সারা পথেই না আছে কোনও ‘শেড’, না কোনও মহীরুহ, না আছে ছাতা বা রেনকোট। ‘মাত্র ৫ কিলোমিটার তো’ ভেবে, প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এমন অপরিণামদর্শিতা দেখানো ঠিক হয়নি মোটেও। অতএব যতটা সম্ভব দ্রুত এগতে থাকি। মাথা তুলে দেখি, আকাশ আরও কালো হচ্ছে। হাওয়ার বেগও বাড়তে শুরু করেছে। ‘জয় বদ্রীনারায়ণ’-নাম জপতে জপতে এগই সাহসে ভর করে। চাতকের মতো দু’চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে বসুধারার বারিধারা।
অবশেষে একটি বাঁকের কাছে পৌঁছে ডানদিকে সামান্য মোড় ঘুরতেই নজরে এল আকাঙ্ক্ষিত সেই জলপ্রপাত। ডানদিকের সেই প্রাচীরসম ন্যাড়া পাহাড়ের গা বেয়েই নেমে আসছে বসুধারার জলরাশি। আয়তনে খুব স্ফীত নয়, কিন্তু সৌন্দর্যে ভরপুর। তাতেও প্রবল হাওয়ায় প্রপাতের জলরাশিকে বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আকাশের যা মতিগতি, তাতে এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করে গিয়ে বসুধারার শীতল জলকণার সান্নিধ্য লাভের প্রচেষ্টা করাটা ঠিক হবে না। সুতরাং সেখান থেকেই বসুধারাকে ক্যামেরাবন্দি করে ফেরার পথে পা চালাই আমরা। অল্পক্ষণের জন্য বেশ বড় বড় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে-মাথায় ফেলেই এ-যাত্রায় রেহাই দিল কালো মেঘের ভেলা।
বসুধারার দর্শনে লব্ধ মানসিক প্রশান্তিকে সঙ্গী করেই নেমে এলাম মানাগ্রামের সেই কাফে’তে। তখন বিকেল সাড়ে চারটে। হাজার ছুঁচো ডন মারছে পেটে। গলা শুকিয়ে কাঠ। অতি অল্প সময়ে পরিবেশিত সেই কাফে’র গরম-গরম ম্যাগির প্লেট নিঃশেষ হয়ে গেল নিমেষে। তারপর গরম কফির কাপে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে, মানাগ্রামকে বিদায় জানিয়ে আবার যখন গাড়িতে উঠে বসি, মানা-বদ্রীর আকাশে তখন অস্তরাগের রঙিন খেলা।
প্রয়োজনীয় তথ্য: ট্রেনে হরিদ্বার/দেরাদুন বা বিমানে দেরাদুন। তারপর গাড়িতে শ্রীনগর/ পিপলকোটি/ যোশিমঠ। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরদিন গাড়িতে বদ্রীনাথ। এখানে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন বেশ আরামদায়ক হলেও, রাতের জন্য পর্যাপ্ত ও ভারী শীতবস্ত্র প্রয়োজন। দরকারি ওষুধপত্র অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। বসুধারা যাতায়াতের পথে পানীয় জল, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ছাতা/ রেনকোট অবশ্যই সঙ্গে নেওয়া জরুরি।
ছবি : লেখক