‘পাহাড়’ শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে কেমন যেন আকুলি বিকুলি করে ওঠে। কোনও এক অলিখিত সম্পর্কের টানে যা নিতান্তই ব্যক্তিগত; বাইরে থেকে তা বোঝানো কঠিন। সেই কারণেই পাহাড়ের বৃষ্টিভেজা পথ, মেঘ, কুয়াশা মাখা রকমারি সবুজের সমারোহ, পাখির কূজন কিংবা পাহাড়ের অজানা বাঁক দেখে অভিভূত হই। বরফ মাখানো পাহাড়ের গায়ে সূর্যরশ্মির ঝলকানি দেখলে যেন হারিয়ে যাই কোনও এক সীমাহীন পথে।
এক বন্ধুর কাছে থেকে যখন উত্তরাখণ্ডের অফবিট ট্রিপ কোটদ্বার, খিরসু, কনকচৌরি হয়ে কার্তিক স্বামী মন্দির, রুদ্রপ্রয়াগ ও ল্যান্সডাউন হয়ে মুম্বই ফেরার পরিকল্পনার কথা শুনি সঙ্গে সঙ্গে বলি আমি আছি। কার্তিক স্বামী মন্দিরের কথা চিন্তা করে বেশ উত্তেজিত বোধ করি কারণ সেখানে আছে হাইকিংয়ের রোমাঞ্চ, আছে হিমালয়কে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ।
সুন্দরী খিরসুতে দু’রাত কাটিয়ে সকাল সকাল আমাদের ন’জনের দল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কনকচৌরির পথে। এই আশায় যেন দুপুরের আগেই সেখানে পৌঁছে যেতে পারি। ঠিক ছিল ভোররাতে বেরিয়ে কার্তিক স্বামী মন্দিরে সূর্যোদয় দেখব। কিন্তু অজানা পথ, অন্ধকারে পাহাড়ে চড়ার কথা চিন্তা করে ঠিক হল আমরা বরং আগের দিন দুপুর নাগাদ বেরিয়ে পড়ব। রাতটা সেখানেই যাহোক করে কাটিয়ে দেব এবং সূর্যোদয় দেখে নীচে নেমে আসব। এতে লাভ হবে দুটো। প্রথমত, সেখানে সূর্যাস্তটাও দেখা হবে এবং দ্বিতীয়ত শীতের মধ্যে ভোরবেলায় আর উঠতে হবে না। অবশ্য আগাম সাবধানবাণী দেওয়া ছিল, রাতের থাকা খাওয়া মনমতো নাও হতে পারে। থাকতে হবে সেখানকার পুরোহিতের ঘরে এবং সেখানে কী ব্যবস্থা আছে জানা নেই। যাই থাকুক আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। কনকচৌরি গ্রামে পৌঁছলাম বেলা একটা নাগাদ, একটু দেরিই হয়ে গেল। দেখে মনে হয় গ্রামটিতে এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন লাগেনি, খুব অল্প মানুষেরই বাস।
কনকচৌরিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে একটি হলিডে হোমে। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নীচে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হয়। ঘরগুলো পরিষ্কার, পরিছন্ন এবং আধুনিক। বাইরে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকে মোহিনী রূপী পাহাড় আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। তারপরই ঢাল নেমে গেছে পাহাড়ে। ওপরে একটা ছোট রেস্তরাঁ, দোকানই বলা চলে সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। গরম ভাত-ডাল ও একটা পাঁচ মিশালি তরকারি, সঙ্গে আচার পেঁয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা। খাওয়া শেষ করে ব্যাকপ্যাকে গরম কাপড় ও দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গাড়ির চালক খুব সাদাসিধে ও ভালো মানুষ।
বেলা ৩টে নাগাদ আমাদের পাহাড়ের চড়াই ভাঙা শুরু হল। প্রায় ৩ কিমির পথ। দূরত্বটা বিশাল নয় কিন্তু খাড়া পথ। ৩০৫০ মিটার উঁচু পাহাড়ে চড়তে হবে এবং যেহেতু পাহাড়ে চড়ার অভ্যেস নেই তাই মনে হচ্ছে কষ্টকর। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ তৈরি হয়েছে পাথর, নুড়ি ও গাছের শিকড় দিয়ে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি, সাক্ষী রয়েছে রডোডেনড্রন আর বিভিন্ন পাখির ডাক, তাদের কলতান। ব্ল্যাক বার্ড, রামদাঙরা (সিনেরিয়াস টিট), হোয়াইট চিকড বুলবুল আরও কত নাম না জানা পাখি যেন আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। ক্রমশ উঁচুতে উঠেই চলেছি, স্বাভাবিক কারণেই শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে ১৫-২০ পা হাঁটলেই, খানিকটা দাঁড়িয়ে আবার ওপরে ওঠা। বেশি সময় ধরে বিশ্রাম নেওয়ারও উপায় নেই কারণ দেরি হলে সূর্যাস্তের আগে পৌঁছতে পারব না। আকাশ পরিষ্কার থাকায় গাছের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে হিমালয়ের চৌখাম্বার শিখরের চোখ জুড়োনো দৃশ্য। ছবিও উঠছে আমাদের ক্যামেরায় অনবরত। একে অপরের খবরাখবর নিতে নিতেই চলেছি, কখনও পিছিয়ে পড়ছি কখনও আবার এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এক সময় দেখা গেল শেষ রিজটি যার শেষ বিন্দুতেই রয়েছে কার্তিক স্বামী মন্দির। তবে পথ এখনও আছে বাকি, রাস্তাটা পুরো বাঁক নিলেই আসবে ওই রিজটি। এইভাবেই চড়াই উঠতে উঠতে বাঁ দিকের রিজ ছেড়ে ডানদিকের রিজে উঠতে শুরু করলাম। আরও কিছুক্ষণ হাঁটা এবং প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম গেস্ট হাউসের জায়গায় যেখানে থাকেন পুরোহিত ও অন্যান্যরা।
আমাদের থাকার কথা ছিল পুরোহিতের সঙ্গে, কিন্তু অবাক কাণ্ড! সেখানে যেতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পাশেই সদ্য তৈরি করা কার্তিক স্বামী মন্দির ট্রাস্টের গেস্ট হাউসে। সারি সারি গোটা পাঁচেক পরিষ্কার পরিছন্ন ঘর। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র নতুন।
জিনিসপত্র রেখে তাঁদের তৈরি করা চা পান করেএকটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরের পথে। এখান থেকে হাজার মিটারেরও একটু বেশি আরও খাড়া সিঁড়ি উঠে পৌঁছতে হবে মন্দিরে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যদেবও যেন প্রস্তুত হচ্ছেন সূর্যাস্তের জন্য। মন্দিরের শেষ পর্যায়ে এসে যখন পৌঁছলাম এখান থেকে আরও ৯১টি সিমেন্ট বাঁধানো ধাপ আছে যা পেরলেই আমাদের সামিট অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত কার্তিক স্বামী মন্দির প্রাঙ্গণ। ৯১টি ধাপ চড়া শুরু করার আগে মনে হচ্ছে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবু শরীরটাকে টানতে টানতে অবশেষে হাজির হলাম সেই প্রাঙ্গণে।
সত্যি বলতে এইরকম ধারণা আমার আগে ছিল না। কিছুক্ষণের জন্য চেতনা লোপ পায়। কী এক অদ্ভুত প্রশান্তি মনের মধ্যে আনন্দের জোয়ার এনে দিল! উজ্জীবিত হয়ে উঠলাম। সিঁড়ির মুখেই সারি সারি ঘণ্টার মালা টাঙানো। বিভিন্ন মাপের বিভিন্ন সুরের। আনন্দে সেগুলো বাজাতে শুরু করলাম। দূরে একটি সাধারণ ঘরের মন্দির। উত্তর ভারতের একমাত্র কার্তিকের মন্দির। কথিত আছে, গণেশ শিব পার্বতীকে প্রদক্ষিণ করেই পৃথিবী পরিক্রমা সেরে ফেলেন। বরও পান, যে কোনও পুজোয় প্রথম পুজো পাওয়ার অধিকার। এই দেখে কার্তিকের হল অভিমান। কঠোর ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের মাংস ত্যাগ করলেন তিনি। এরপর এখানে এসে হাড় ত্যাগ করলেন। এবং তাই এই মন্দিরে পূজিত মূর্তিতে হাড়ের অবয়ব। সমস্ত প্রাঙ্গণে এই মুহূর্তে শুধু আমরা পাঁচজন। আর রয়েছে চারদিকে বরফে মোড়া হিমালয়ের হাতছানি। এখানকার আকাশ বাতাস সব যেন আমাদের জন্যই তৈরি হয়ে রয়েছে। পশ্চিমে সূর্যাস্তের লালিমায় ক্রমশ আরও লাল হয়ে উঠছে সমস্ত আকাশ আর পুবের হিমালয়। ঈশ্বরীয় এই দৃশ্য এক ওপার আনন্দের এক অপার অনুভূতি, যাতে কোনও শব্দ বসানো যায় না। দেখতে দেখতে সূর্যদেব ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় দৃষ্টির অগোচর হলেন।
আরও কিছুক্ষণ রইলাম মন্দির প্রাঙ্গণে। সন্ধে ঘনিয়ে এল। এবার ফিরতি পথে নামাতে শুরু করলাম। কারণ, অন্ধকার পথ, যেতে অসুবিধে হবে। নীচে শহরের বিন্দু বিন্দু আলো সারা পাহাড়ের গায়ে ফুটতে শুরু করেছে। আকাশে তারাদের মিটিমিটি আলোর মেলামেশা হয়েছে শুরু। সন্তর্পণে অন্ধকারে পা ফেলতে ফেলতে ফিরে এলাম আমাদের আস্তানায়। ইতিমধ্যে ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ঘরে ঢুকেই জুতোটা কোনওরকমে খুলে সোজা বিছানায় লেপের ভেতর। খানিকক্ষণ সময় লাগল গরম হতে। আবদারের স্বরে জিজ্ঞেস করি—গরম কফি চায় কুছ মিলেগা? উত্তর এল, হাঁ জি। লেপের তলায় বসে চা পান সে কী আনন্দের! সূর্যোদয়ের সময় ৬.২০ এবং এখান থেকে মন্দির পৌঁছতে সময় লাগবে ৩০-৪৫ মিনিট। অতএব আমাদের পরের দিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় বেরতে হবে। তাই ন’টার সময় খাওয়ার ডাক এল। ঘরের বাইরে বারান্দায় খাওয়ার আয়োজন। গরম ভাত, রুটি, ডাল, তরকারির সঙ্গে আচার পেয়াঁজ ও লঙ্কা। কিন্তু খাব কী, ঠান্ডায় যে শরীরে হাড়ে কম্প, বসতেই পারছি না! কোনওরকমে দুটো রুটি ডাল দিয়ে খেয়ে ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। মোবাইলে দেখাচ্ছে ঠান্ডা ৩ ডিগ্রি। ছোটবেলার সমস্তিপুরের কথা মনে পড়ে গেল। এ ধরনের ঠান্ডা তো রোজকারই ব্যাপার ছিল, তাড়াতাড়ি লেপের তলায় ঢুকে গেলাম।
ভোর সাড়ে চারটের অ্যালার্মের ঠ্যালায় উঠে তৈরি হয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় অন্ধকারে রওনা দিলাম। ঠান্ডা ৩ ডিগ্রিই হবে। তার ওপর নিকষ কালো অন্ধকারে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান শুনতে শুনতে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলেছি। খাড়া সিঁড়িগুলো চড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। যখন উপলব্ধি করলাম আমি মেঘের রাজ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি আর আমার নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ের সব চুড়াগুলো সে এক বর্ণনাতীত আনন্দ! প্রতিটি ঘণ্টা একবার করে বাজালাম এবং তার আওয়াজে পরিবেশ হয়ে উঠল এক ঐশ্বরীক আবেশ। আকাশ ক্রমশ ফর্সা হতে শুরু করেছে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি ১০,০০০ ফিটেরও বেশি উঁচুতে। হিমালয়ের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখা যায় এখান থেকে। মন্দিরের পেছনেই ১৮০ ডিগ্রি তুষার শিখরের প্যানোরোমা।
বাঁ-দিক থেকে জাওলি, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ, সুমেরু, ভাগীরথী, মন্দাকিনী, জানুকটি, চৌখাম্বা, ত্রিশূল এবং নীলকণ্ঠ। পুবে সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি চলছে। সূর্যরশ্মির আভা ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। পাহাড়ের ওপ্রান্ত থেকে যেন কোনও সার্চলাইট থেকে আলো এসে ঠিকরে পড়তে শুরু করেছে। বিপরীত দিকের সমস্ত তুষার শীর্ষে, লাল রং ক্রমশ হলুদে পরিণত হচ্ছে। সে এক স্বর্গীয় সুখে কৃতজ্ঞচিত্তে সূর্যদেবকে জানালাম আমার প্রণাম।
মহাকাব্যের প্রতিটি পাতায় মুদ্রিত হয়ে চলেছে হিমালয়ের ইতিহাস। যখন ফিরে যাব, চোখের সামনে থাকবে শুধু বোবা দেওয়াল, পাঠ করব সেই মহাকাব্যের স্তোত্র।
শকুন্তলা তাকিয়ে ছিল ক্ষুৎপিপাসা কাতর দুর্বাসার প্রতি, কিন্তু মনশ্চক্ষু নিবদ্ধ ছিল দুষ্মন্তের দিকে। তাই দুর্বাসাকে সে দেখতে পায়নি। ক্রোধান্বিত ঋষির অভিশাপে বিদ্ধ হয়েছিল।
শকুন্তলার মতোই হিমালয়ের দিকে আমার মন ছিল, কিন্তু তথ্য সংগ্রহের দিকে চোখ ছিল না। নৈসর্গিক রূপ দর্শনে মূক, বিমূঢ়, বাক্যহারা আমি। ভাগ্যিস দুর্বাসা নেই! যদি থাকতেনও, মাথা পেতে নিতাম তাঁর কোনও না কোনও জ্বলন্ত অভিশাপ!
ছবি : লেখক