উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট্ট শহরটায় এখনও সেভাবে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। অনেকে হয়তো নামও শোনেননি। ২৩০০ ফুট উচ্চতায় অসমের এই একমাত্র শৈলশহর হাফলং। পূর্বে অসমের উত্তর কাছাড় জেলার সদর শহর ছিল এটি। বর্তমানে ডিমা হাসাও জেলার প্রাণকেন্দ্র। ডিমা হাসাও কথাটার মানে ডিমসা ভাষায় উইয়ের ঢিবি। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ঢালে বাঁশঝাড় আর কলাগাছের বুনো গন্ধ। হালকা মেঘ কুয়াশায় মাখামাখি আদিম অরণ্যে পাইন বন আর অর্কিডের ভিড়। ফুলের ভারে অবনত জংলি লতা, উপজাতি মহিলাদের বাঁশের টুকরি পিঠে বেঁধে পাহাড় বেয়ে ওঠানামা করা— এইসব নিয়েই হাফলং।
প্রকৃতি এখানে অকৃপণভাবে নিজেকে মেলে ধরেছে। আছে নানা উপজাতি গ্রাম, জাতিঙ্গা পাহাড়ে পাখিদের আত্মহনন স্থান। যেজন্য সবাই হাফলংয়ের নাম জানে।
লামডিং স্টেশন থেকে শুরু হয় মন ভরিয়ে তোলা পথের সৌন্দর্য। সুন্দর সুন্দর নামের স্টেশন। খুব একটা জনবহুল নয় সে সব স্টেশন। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে চলার জন্য সামনে পিছনে ইঞ্জিনের সাহায্য নিতে হয়। ট্রেনে চলতে থাকে তার সঙ্গে চলে দূরে দূরে দু’একটা গ্রাম। ট্রেন পথে এক একটা বাঁক পেরিয়ে যায় আর প্রকৃতির নব নব রূপ উন্মোচিত হয় চোখের সামনে। জানালা থেকে চোখ সরানো যায় না। ঘন সবুজ বাঁশঝাড়, উপত্যকা দেখতে দেখতে অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথ পেরিয়ে এবার নিউ হাফলং স্টেশন। আটটি সুড়ঙ্গ নিউ হাফলং স্টেশন পর্যন্ত। এর মধ্যে একটি তিন কিমি লম্বা। শহরের দু’টি ভাগ আপার এবং লোয়ার। নিউ হাফলং স্টেশন লোয়ার হাফলংয়ে। আমাদের হোটেল আপার হাফলংয়ে। চারপাশে মেঘ কুয়াশায় ঘেরা নির্জন পরিচ্ছন্ন স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে রংবেরঙের ছাতার নীচে কেটে রাখা তরমুজ, পেঁপে সাজিয়ে বিক্রি করছে উপজাতি কন্যা। আনারসের সময়ে প্রচুর আনারস বিক্রি হয় এখানে। স্টেশন থেকে হোটেলে আসার রাস্তাটাও ভারী চমৎকার। আদিম অরণ্যের হাতছানি। বড় বড় গাছগাছালিতে ভরা আমাদের হোটেল। দোতলার বারান্দায় আলো-আঁধারিতে এলিয়ে দিয়েছে ডালপালা। ইচ্ছে করলেই স্পর্শ করা যায় তাদের। আশপাশে আরও বেশ কয়েকটা হোটেল আছে। সবই বড় স্নিগ্ধ মায়াময় গাছ দিয়ে ঘেরা।
চারদিনের হাফলং ভ্রমণ শুরু করলাম সাইনড ভিউ পয়েন্ট দেখে। আমাদের হোটেলের সবথেকে কাছের ভিউ পয়েন্ট। হেঁটেই যাওয়া যায়। এখান থেকে লোয়ার হাফলং শহরের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। আমাদের যাওয়া গাড়িতেই। এক এক করে দেখলাম সার্কিট হাউস, দুটি চার্চ। সার্কিট হাউসের সামনেও হাফলংয়ের সুন্দর ভিউ পয়েন্ট। দূরে নীলচে পাহাড়ের সারি, তার কোলে দায়াং নদীর ওপর রেল ব্রিজ। সে ব্রিজ দিয়ে নিউ হাফলং স্টেশন পৌঁছেছি। অসাধারণ দৃশ্য। ফিংপুই চার্চটা বেশ বড়। কোভিড সময় থেকে বন্ধ হয়েছে দর্শনার্থী প্রবেশ। এবার গেলাম হাফলং লেক দেখতে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অসমের বৃহত্তম এই প্রাকৃতিক লেক। গ্রীষ্ম বলে জলটা কম। কল্পনায় দেখে নিলাম বর্ষার টলটলে রূপ। পারাপারের জন্য রয়েছে ঝুলন্ত সেতু। দেখলাম মুলপং ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ের ফাঁকে আটকে থাকা দেবী মন্দির। সেখানে দেবী দুর্গা এবং আরও নানা দেবদেবীর বিগ্রহ। মন্দির হয়তো তত পুরনো নয়, কিন্তু আদি অকৃত্রিম প্রকৃতি এখানে অতি প্রাচীন। খাদের ধারে শেষ বিকেলের সোনা আলো, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। দিনের শেষ হল হাফলং বাজারে। হাফলংয়ে নানা উপজাতির বসবাস। তাদের মধ্যে প্রধান ডিমাসা, নাগা, কুকি, জয়ন্তিয়া ছাড়াও আরও ছোট উপজাতির মানুষও আছে। তবে ডিমাসা উপজাতির প্রাধান্য বেশি। বাজারে অনেক উপজাতি মানুষ সব্জি বিক্রি করে সংসার চালান। এছাড়াও বিক্রির জন্য রয়েছে বাঁশের খাঁচায় রাখা পায়রা। বিক্রি হচ্ছে পান, সুপারি।
পরের দিন আমাদের যাত্রা শুরু হল শহর থেকে ৬৫ কিমি দূরে পুরনো লাইকুল গ্রামের উদ্দেশে। শহর ছাড়ালেই দু’পাশে অরণ্য। যাতায়াতের পথ বেশ ভালোই।
২০২০ সালে দেড়শো বছর পূর্তির স্মৃতিফলক দিয়ে সাজানো পুরনো লাইকুল গ্রামের প্রবেশপথ। কুকি উপজাতির বসবাস এখানে। স্থানীয় গাইড তাঁদের গ্রাম সম্পর্কে বললেন এবং আমন্ত্রণ জানালেন নভেম্বর মাসে স্থানীয় উৎসবে যাওয়ার জন্য। কৃষিপ্রধান এলাকা, ফসল তোলার উৎসবটাই বড় উৎসব। আমাদের নবান্ন উৎসবের মতো। এবার আমরা একটু পাহাড় চড়ার চেষ্টা করলাম। বরাইল পর্বতের অন্তর্গত অসমের সবথেকে উঁচু শৃঙ্গ মাইন্ট সিলকাল (১৮৬০ মিটার)। ট্রেকিংও শুরু হয় এখান থেকেই।
গ্রাম থেকে গাইড নিয়ে গেলে রাস্তা চিনতে সুবিধা হয়। প্রথমে থিংবং গ্রাম। থুমজাং গ্রাম এটাও একটি পিক। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে মাউন্ট সিলকাল স্থানীয় গাইডের মুখ থেকেই সবটুকু শুনেছি। পাঁচ কিলোমিটার ট্রেকিং পথ। কিন্তু সময় এবং বয়স দুটোই আমাদের অনুকূল নয়। তাই অল্প পাহাড় চড়েই ফিরে চলা।
এবার আসালু দুর্গ। ভগ্ন ইটের দুর্গ। তবে দুর্গ বললেও এটা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ১৮২ বছরের পুরনো প্রশাসনিক ভবন। এখন সংরক্ষিত। পথের পাশে ডিমাসা মহিলার হাতে বোনা কাপড়ের দোকান।
আমরা পৌঁছে গেলাম থিংবুং গ্রামের জিনাম ভ্যালি। জিনাম ভ্যালি মূলত সান সেট পয়েন্ট। সেখানে ওয়াচ টাওয়ার খাদের ওপর ঝুলে রয়েছে। সেখান থেকেই সূর্যাস্ত দেখা। ঘন সবুজ অরণ্যে ঘেরা পাহাড়, ঠান্ডা বাতাস, প্রাণ ভরিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে। পাখিদের ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এবার হোটেলের পথে চললাম।
আর একটা নতুন দিন শুরু হল। আজ অন্য পথে রওনা দিলাম। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছলাম হাফলং স্টেডিয়াম। স্টেডিয়াম ঘুরে তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে আসতে হল। আবার সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়া। এবার পাড়ি রবি নদী। এই নদীকে আরও ভালো করে দেখার জন্য গ্রামের ভেতর দিয়ে এক কিমি মাটির পথ ধরে এগলাম নদীর কিনারে। তবে সে পথ খুব সহজ নয়, অনেকেই অর্ধেক গিয়ে রণে ভঙ্গ দিল। স্থানীয় বাচ্চরা অবশ্য অনায়াসে সে পথে ওঠানামা করছে। যাঁরা যেতে পারলেন না, আদিবাসী মানুষ আদর করে তাদের আসন পেতে দিলেন। তাঁরা সেখানেই গল্পে মাতলেন। আর যাঁরা কষ্ট করে নদীর ধারে পৌঁছলেন তাঁদের আপ্যায়ন করল মনোমুগ্ধকর স্বচ্ছ জল। রঙিন পাথরে সে জল আলপনা দিচ্ছে।
দুপুরের খাবার খাওয়া হল লাইকুলেই। ঝর্ণা দেখার জন্য এবার ওই গ্রামের পথ ধরলাম। সে পথে নানা পাখির কলতান, দিনের বেলায় ঝিঁঝির ডাক। ঘন অরণ্য শুকনো পাতা বিছানো খাড়াই মাটির পথ। পথপর্দশক এক আদিবাসী বয়স্ক গাইড। কোমরের পেছনে গোঁজা দা দিয়ে আমাদের পথ চলবার জন্য জঙ্গল থেকে গাছ কেটে লাঠি তৈরি করে দিলেন। আমরা শহুরে মানুষের কাছে সে পথ অনেক সময় একটু অসুবিধার। জলধারাও বিশাল নয় তবে পথ জয় করার আনন্দ আছে।
এরপর যাওয়া হল এথনিক ভিলেজ দেখতে। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে সাজানো আছে ডিমা হাসাও জেলার নানা উপজাতির বাসস্থান। মডেলের সাহায্যে বোঝানো আছে তাদের বেশভূষা সাজগোজ। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখা যায়। কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে এবার হাফলংয়ের সেই বিখ্যাত জায়গা জাতিঙ্গায় এলাম। যেটাকে পাখিদের সুইসাইড পয়েন্টও বলা হয়। যে কারণে হাফলং বিখ্যাত। নানা প্রজাতির পাখি এখানে বছরের একটা বিশেষ সময়ে আগুনে ঝাঁপ দিত। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘন কুয়াশা ভরা রাত বেছে নিত মৃত্যুর জন্য। প্রথমে মনে হতো পাখিরা আত্মহত্যা করে অথবা পথ বিভ্রান্ত হয়ে আগুনে ঝাঁপ দেয়। পরে অনেক তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় গ্রামের মানুষ কৌশল করে আগুন জ্বালিয়ে পাখিদের হত্যা করত। জাতিঙ্গা বার্ড ওয়াচিং সেন্টারের ভিতরে ছবিতে কত প্রজাতির পাখি এখানে আত্মহনন করত তার তথ্য আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় নীচে জাতিঙ্গা গ্রাম, ঘন বাঁশের জঙ্গল দুপুরের রোদ ঝলমল করছে। মাঝে কিছুটা অংশ ফাঁকা রাখা। ওটাই পাখিদের মৃত্যুর স্থান। এ এক অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য সেখানে পাখিরা আত্মহত্যা করে! পাখিরা আত্মহত্যা করে, নাকি তাদের মেরে ফেলা হয় এই বির্তকে না গিয়ে বলি, পাখিদের থাকবার গাছ আছে, ওড়বার আকাশও আছে। তবু কেন এমন কাণ্ড!
সূর্য ডুবছে আর একটা সানসেট পয়েন্টে। পাহাড়ের মাথায় লাল টিপ পরাতে পরাতে তিনি অদৃশ্য হলেন। শেষ হল একটি দিন। দিগন্ত জুড়ে তখন রঙের হোলি খেলা। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। চরাচর জুড়ে শীতল বাতাস দোল খাচ্ছে ঘাস ফুলে, ন্যাড়া গাছের ডালে। মনও ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেদের সঙ্গে অচিনপুরে দিকচক্রবালে।
শেষ দিনের গন্তব্য ১৯০২ সালে ব্রিটিশের তৈরি পুরনো মিটার গেজ ট্রেনের স্টেশন, সুড়ঙ্গ পথ। এখানে অটো করে যেতে হল পুরনো ট্রেন পথ ধরে। দু’পাশের জংলি লতা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। এখন আর এপথে ট্রেন চলে না। শেষ ট্রেন গেছে ২০১৪ সালে। স্টেশনের লেখা খসে গেছে। ধসে গেছে রেলপথ। জঙ্গল গ্রাস করেছে প্ল্যাটফর্ম। পাহাড়ের গায়ে রেলের কোয়ার্টার এখনও অক্ষত আছে। পাথুরে বাঁধানো পথ বেয়ে উ০ঠতে হয়। এত কষ্ট সয়েও মানুষ সেখানে আছে, তাদের বাসস্থান ছেড়ে যায়নি। পুরনো চায়ের দোকানও আছে অনেক স্মৃতির বোঝা বুকে নিয়ে। জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত ভূতুড়ে টানেল। অন্য পথে নতুন ব্রডগেজ লাইন হয়েছে। পুরনোকে ছেড়ে নতুন স্টেশনের পথে এবার। পথে এক জায়গায় গাড়ি থামল। অনেক নীচে পাখির চোখ দিয়ে স্টেশনকে দেখে নিই। কিছু ছবি ক্যামেরার লেন্সে, কিছু ছবি চোখের লেন্সে গেঁথে নিয়ে পাহাড়, বাঁশবন, কলাঝাড় পিছনে ফেলে একরাশ মনখারাপের চিঠি ব্যাগে পুরে আবার সেই পথ ধরেই হাফলং থেকে কলকাতার পথে।
কীভাবে যাবেন
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে হাফলং। এছাড়াও হাওড়া থেকে হামসফর এক্সপ্রেস আছে, এটা বেঙ্গালুরু থেকে আগরতলা অবধি হাফলং হয়েই যায়। নতুন হাফলংয়ে অনেক হোটেল আছে।
ছবি : লেখক