সাপ্তাহিক বর্তমান

ভারতের রহস্যময় 
ভূতুড়ে বাড়ি

ভূত প্রায় সভ্যতার মতোই বয়স্ক। দিল্লির কড়কড়ডুমা আদালতের লাইব্রেরিতে অনেকেই এক ছায়ামূর্তির দেখা পেয়েছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরির অলিন্দে কাকে দেখা যায়? মুসৌরির স্যাভয় হোটেলে জিম করবেট থেকে নোবেলজয়ী পার্ল এস বাক—অনেকেরই পদধূলি পড়েছে। স্যাভয় হোটেলে যাকে অনেকেই দেখেন সে কে? ভানগড় কেল্লার ঝরোখায় দাঁড়িয়ে ওই সুন্দরী কি মানুষ? ফিল্ম জার্নালিস্ট তাহিরা এক অভিনেত্রীর মেকআপ ভ্যানে ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে কাকে দেখলেন? রাতের অন্ধকারে সিমলার চার্লভিল ম্যানসনে কেন কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা যায়? ভূত কি শুধুই অনুভূতি নাকি দর্শনও মেলে তেনাদের?  নিজের চোখে অশরীরী দেখার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন সৌভিক দাস। 

জুলাইয়ের সেই সকালে কুয়াশার ভিজে চাদর গায়ে আড়মোড়া ভাঙছে মুসৌরি। এক হাত দূরের জিনিসও চোখে পড়ছে না। পাথুরে পথে সামান্য কয়েকটা ব্রুহাম গাড়ির আনাগোনা। সকালের গাড়িগুলো সব সাহেবদের আর পথচলা পাগুলো হয় নেটিভদের, না হলে খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো চতুষ্পদের। বেলা বাড়লেও অবশ্য এই বৈষম্যের কোনও হেরফের হয় না। ব্রুহাম গাড়ির চাকার তলায় নুড়ি পাথরের চিটপিট আর ঘোড়ার খুরের খটাখট কুহেলিকার গর্ভে প্রহেলিকা সৃষ্টি করছে। প্রতিবারই পথচলতি মানুষ ভাবছে, শব্দ আসে কোন দিক থেকে রে বাবা! হঠাৎ করে হেডলম্প যখন সামনে চলে আসছে, ধাঁধাঁর উত্তরও পাচ্ছে আর বুকটাও ছ্যাঁৎ করে উঠছে। তাই অন্যান্য দিনের থেকে অনেক বেশি সাবধানে পা ফেলছে সিউপরসাদ সিং। ঘোড়ায় ধাক্কা না মারুক, পায়ের তলায় ভেজা রাস্তায় অঘটন তো ঘটতেই পারে! 
অন্যদিন লণ্ঢৌর বাজার পেরলে রোদ উঠে যায়। আজ সেটা হল না। অন্যদিন ওপর নীচে তাকালে পাহাড়ের গায়ে রংবেরঙের ছাতগুলো দেখে মনে হয় শহরটা তাপ্পি মারা রজাই গায়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। আজ সেটাও হল না। কুয়াশার চোটে পাহাড়ের গা, বাড়ি, ছাত সবই তো ভ্যানিশ। শুধু কয়েকটা জিনিস অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। দেবদারু গাছের বুনো গন্ধ, ইসমাইলের চায়ের দোকান, ‘সালাম আলেকুম সিউপরসাদ ভাই’, ‘রাম রাম ইসমাইল মিয়াঁ’, আশি বছরের বুড়ো লাইব্রেরির সবুজ জানলা। যে ছোট্ট রাস্তাটা লাইব্রেরির দিকে উঠে গেছে, সেটা পেরতেই, দূর থেকে বিশাল কালো গেটটা দেখতে পেল সিউপরসাদ সিং। রোজই দেখে। কিন্তু আজ কেন জানি না মনে হল, রোজকার দেখা গেটের ওপারে অন্যরকম কিছু একটা ঘটবে। তখনও সিউপরসাদ জানে না আজ মুসৌরিতে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা গোয়েন্দার ভ্রূণ সঞ্চার হয়েছে।
মানবজাতির সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী আবেগ ভয়, এবং সবচেয়ে প্রাচীন আর শক্তিশালী ধরনের ভয় হল অজানাকে ভয়। কারণ যতক্ষণ না অজানাকে নিতে পারছে সে চিনে, ততক্ষণ তার সামনে বিপন্ন বোধ করাটা মনুষ্য প্রজাতির জিনে। ভূতের ভয় উদ্ভূত হয় মূলত এই অজানার প্রতি ভয় থেকে। অজানা ও অদেখা এক জগতের প্রতিনিধি ভূত। তাদের অধরা প্রকৃতি এবং তাদের অস্তিত্বকে ঘিরে থাকা রহস্য মানুষের মনে ভয় এবং অস্বস্তির অনুভূতি জাগায়। এই ভূত নিয়ে মানুষের মশকরাও কম নয় কিন্তু। হলিউডের এক জনপ্রিয় নায়িকা যেমন বলেছিলেন, ‘দেখুন মশাই, আমি ভূতে ভয় পাই না। আমার ভয় একটাই। হঠাৎ যদি ভূতের দেখা পাই, তখন আমার চুলের কী অবস্থা হবে!’ 
ভূত বলে আদৌ কি কিছু আছে? থাকুক বা না থাকুক, ভূত ব্যাপারটি প্রায় সভ্যতার মতোই বয়স্ক। এ কথাটা না মানতে পারলেও, অন্তত এটা মানতেই হবে যে যেদিন থেকে সভ্যতা গল্প বলতে শিখেছে, ভূতের অস্তিত্ব তবে থেকেই। ভূত নিয়ে চর্চাও কিন্তু অতি প্রাচীন। যিশু জন্মানোর প্রায় আঠারোশো বছর আগে মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় ‘এপিক অফ গিলগমেশ’ বা ‘গিলগমেশের মহাকাব্য’ রচনায় ভূত এবং মৃত্যু-পরবর্তী দুনিয়ার উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন গ্রিসে, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী প্লিনি দ্য ইয়াঙ্গার (৬১-১১৩ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর চিঠিতে ভৌতিক আবির্ভাবের কথা লিখেছেন এবং মুখোমুখি হওয়ার বিবরণ শুনিয়েছেন। তবে এই প্রাথমিক বিবরণগুলি প্রায়শই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং উপাখ্যানমূলক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে। দলগত ও পদ্ধতিগত বৈজ্ঞানিক গবেষণার সেরকম কোনও উল্লেখ নেই এইসব রচনায়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে ভৌতিক সাক্ষাতের দাবি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিক তদন্ত শুরু হয়। সোসাইটি ফর সাইকিক্যাল রিসার্চ (এসপিআর)-এর মতো সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু তাই নয়, প্রেতচর্চার সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্ক এমন সব মানুষ জড়িয়ে পড়েন, তা জানলে চমকে যেতে হয়। শার্লক হোমসের স্রষ্টা ডঃ আর্থার কোনান ডয়েল, ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত এবং থ্যালিয়াম পদার্থের আবিষ্কারক স্যার উইলিয়াম ক্রুকস, বাঙালির কাছে যাঁর পরিচয় দেওয়া নিষ্প্রয়োজন সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, টমাস আলভা এডিসন সহ আরও অনেকে। ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করে গবেষণাপত্রের অভাব তো নেইই বরঞ্চ আধিক্যই দুশ্চিন্তার কারণ। সেগুলো থাকুক বা না থাকুক, স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিকগণ ভূতে বিশ্বাস করুক না করুক, পৃথিবীর এক বিপুল সংখ্যক বাসিন্দা ভূতে বিশ্বাস করেন এবং তাঁদের সিংহভাগ ভয়ও পান। প্রশ্ন হল এই ভূতেদের বাসা কোথায়? উত্তরের সঙ্গে ভয়ের সম্পর্ক রয়েছে।
এই প্রবন্ধ অতিপ্রাকৃত নিয়ে বিতর্কের প্রবন্ধ নয়। বরং আজ আপনাদের ভারতের এমন কিছু ঐতিহাসিক স্থানের গল্প শোনাব, যেখানে মানুষের অদ্ভুত কিছু অনুভূতি হয়েছে, যা ব্যাখ্যাতীত। মুসৌরির স্যাভয় হোটেল সেরকমই এক স্থাপত্য।
ঐতিহ্যশালী স্যাভয় হোটেলের গেট দিয়ে সভয়ে প্রবেশ করল সিউপরসাদ সিং। হোটেলের নির্মাণ সমাপ্তি ১৯০২ সালে। রেভারেন্ড ম্যাডকের মুসৌরি স্কুলটিকে ধূলিসাৎ করে গড়ে ওঠে প্রাসাদোপম এই হোটেল। প্রশ্ন হচ্ছে সমতল থেকে শৈলশহরের এই উচ্চতায় হোটেল নির্মাণের যাবতীয় উপদান এল কীভাবে? দেরাদুন থেকে মুসৌরি যাওয়ার ভালো রাস্তা তো তৈরিই হয়নি! ভূতে আনেনি, মানুষই এনেছে। 
প্রচুর পরিমাণে এডওয়ার্ডিয়ান আসবাবপত্র, গ্র্যান্ড পিয়ানো, বিলিয়ার্ড-টেবিল, সুরার পিপে, শ্যাম্পেনের ক্রেট এবং অন্যান্য নানা উপকরণ গোরুর গাড়িতে করে ওপরে আনা হয়েছিল। সেই অন্যান্য উপকরণের মধ্যে ছিল ওক গাছের বৃহৎ টুকরোগুলি যেগুলি পরে হোটেলের বিখ্যাত ডাইনিং হলের মেঝেতে পরিণত হয়। ঝিরঝিরে পাতার গাছ থেকে মনুষ্য পাদুকার নীচে মচমচে মেঝে হয়ে মোক্ষ লাভ হয় ওদের। আর উপার্জনেই মোক্ষ, সেই বিশ্বাসে সিউপরসাদ সিং এহেন হোটেলে বেয়ারা হিসেবে কাজ শুরু করে উদ্বোধনের বছরেই। 
খুব শীঘ্রই স্যাভয় হয়ে ওঠে মুসৌরির কিরীট কোহিনূর এবং ধনী সাহেবদের কাছে উপমহাদেশের উত্তাপ থেকে নিষ্কৃতি প্রাপ্তির গন্তব্য। স্যাভয় হোটেলের বিশেষত্ব ছিল ভিক্টোরিয়ান জাঁকজমকপূর্ণ লেখকদের পানশালা, যেখানে ঔপনিবেশিক অভিজাতরা তাঁদের সাম্রাজ্যের স্বাস্থ্য কামনা করে পান করতেন। জিম করবেট থেকে শুরু করে সাহিত্যে প্রথম মার্কিনি মহিলা হিসেবে নোবেল বিজয়ী পার্ল এস বাক, অনেকেরই পদধূলি পড়েছে। যেমন হোটেলের ঐতিহ্য, তাল মিলিয়ে তেমনই অনুশাসন। 
সাবধানী পায়ে আসার জন্য যে দেরি হয়ে গেছে, সেটা আন্দাজ করে দুরুদুরু বক্ষে গেট দিয়ে ঢোকে সে। ম্যানেজার গর্ডন সাহেবের হাতে আজ গর্দান যাবে, এটাই ছিল ভয়। মনে মনে ভাবল, তাহলে এই জন্যই দূর থেকে গেট দেখে বুকটা কাঁপছিল! কিন্তু গর্ডন সাহেব দেরি দেখেও কিছু বললেন না। কেমন যেন আনমনা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অন্যদিনের প্রচণ্ড চনমনে লোকটা। খানসামা ইদ্রিস আর তার দুই শাগরেদ প্রাতরাশ তৈরিতে মগ্ন। কিন্তু অন্যদিনের মতো ইদ্রিসের মুখে কালোয়াতি গুনগুন নেই। কিছুটা যেন অন্যমনস্ক। একজনের হাতে ছনাৎ শব্দে একটা শৌখিন কাপ ভাঙল। রাধিয়া বারান্দা পরিষ্কার করছে। মাত্র কয়েক দিন আগে সে কাজে ঢুকেছে। পুরুষ সহকর্মীদের মাঝে এখনও জড়তা কাটেনি। কিন্তু তার চাউনি তীক্ষ্ণ আর উঁকিঝুঁকি মারার অভ্যাস বিরামহীন। সিউপরসাদ সিংকে ট্রলিতে প্রাতরাশ চাপিয়ে ১০৬ নম্বর ঘরের দিকে যেতে দেখে ঘাড় ঘোরাল। হোটেলে আসা ইস্তক ১০৬ নম্বরের অতিথি ঘিরে যে ভয় সৃষ্টি হয়েছে, সিউপরসাদ সিং আর রাধিয়া ছাড়া কেউ সাহস করে না ঘরে যেতে। অবশ্য রাধিয়ার চাকরি সেই অতিথির সুপারিশেই। আচ্ছা, রাধিয়া কি সামান্য হলেও ভ্রূ কুঁচকাল? হবে হয়তো! মাথায় চিন্তাটা এলেও, সিউপরসাদ গ্রাহ্য না করে দরজায় নক করল। ‘মেমসাহিব, ব্রেকফাস্ট।’ 
সেদিন ১০৬-এর অতিথিকে আর ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়নি সিউপরসাদ সিংয়ের!

সিউপরসাদের ডাকে ঘরের ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। অথচ রোজ যে সময়ে অতিথি প্রাতরাশ শুরু করেন, সেই সময়েই দোরগোড়ায় হাজির সিউপরসাদ। বড়জোর মিনিট তিনেক দেরি হয়েছে। মিনিট পাঁচেক ডাকাডাকির পরেও দরজা না খোলায়, ওই তিন মিনিটের বিলম্বই সিউপরসাদের কপালে ঘাম হয়ে দেখা দিল। দালানের অন্য প্রান্ত থেকে গর্ডন সাহেবের বুটের আওয়াজ এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। হাঁটুর নীচটা অসাড় হয়ে গেল। গর্ডন সাহেব সামনে এলেন। গভীর চোখে তাকালেন সিউপরসাদের দিকে। সিউপরসাদ প্রমাদ গুনতে শুরু করল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আন্ডার সো রহি হোগি। ইউ ট্রাই আফটার হাফ অ্যান আওয়ার।’ 
আধা ঘণ্টা কেন, সেদিন দু ঘণ্টা পরেও যখন দরজা খুলল না, গর্ডন সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘মনে হচ্ছে উনি ভিতরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মিস মাউন্টস্টিফেন কবে ফিরছেন?’
সিউপরসাদ সেদিন ঘণ্টা তিনেক সময় পেয়েছিল জীবনের এক ভয়ঙ্কর মুহূর্তে পৌঁছতে। কিন্তু ভানগড়ের বাসিন্দারা বোধহয় কোনও সময়ই পায়নি। ভানগড় কেল্লা— সময়ের তীরে এমন এক ঝিনুক যার ভগ্ন চেহারাটা স্থায়িত্ব পেয়েছে। পুলিসের খাতায় যেমন কিছু অপরাধী ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’, ভারতে যাঁরা অলৌকিকতা নিয়ে আন্তরিক ভাবে চর্চা করেন তাঁদের কাছে ‘মোস্ট হন্টেড’। শুধু তাঁরাই নন, রাজস্থান পর্যটন বিভাগের ওয়েবসাইটেও এই কেল্লার সঙ্গে অতিপ্রাকৃতের সম্পর্ক স্বীকার করা হচ্ছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাবধানবাণীও এ ক্ষেত্রে উল্লেখনীয়। তাদের নীল ফলকে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মাঝে মানুষের প্রবেশকে বেআইনি ঘোষণা করা রয়েছে। কিন্তু কারণের উল্লেখ নেই।
উত্তরপূর্ব রাজস্থানের আলোয়ার জেলায় ভানগড় কেল্লার লালচে-বাদামি রংটা সারিস্কা ব্যাঘ্র প্রকল্পের সবুজে ঘেরা। যেন রঙিন সিনেমার মাঝে সিপিয়া রঙের ফ্ল্যাশব্যাক। কেল্লাময় রাজস্থানের অন্যান্য স্থাপত্যের নিরিখে একদমই জেল্লাহীন। তিন পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট টিলা, কিছুটা বালি, বেশ কিছুটা সবুজ, অনেকটা পাথর। টিলা বেয়ে পায়ে হাঁটা পথ উঠে গেছে। কেল্লা ঘিরে বুড়ো আর বুনো গাছের জটলা; হাওয়া দিলে নিজেদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস। তাদের মধ্যে রয়েছে কাঁটাওয়ালা বাবলা, জটামাথা বট, থ মেরে দাঁড়ানো অশ্বত্থ, লম্বা পাতা খেজুর। কিছু অচেনা গাছের গুঁড়ি এমন চেহারা নিয়েছে যেন মনে হয় বৃক্ষকাণ্ড নয়, অহল্যায়িত মানবদেহ। কেল্লার সামনে সবুজ ঘাসের মখমলি চাদর। কিছু ছেলে সেই মাঠে ক্রিকেট খেলছে। পরনের ইউনিফর্ম বলে দিচ্ছে ছেলেগুলো স্কুলছুট। মাথার ওপরে আকাশটা সাদা বুটিদার নীল, ঠিক যেরকম আকাশটা কলকাতার মাথা থেকে চুরি করেছে বহুতলগুলো। কেল্লার তেতলার ছাতে দাঁড়িয়ে নরম জ্যাকেটের ওম, উলের টুপি আর শীতের রোদ উপভোগ করছি। কাছেই কেউ একজন চাপা গলায় রাজস্থানি সুর ধরেছে। আমি ভাবছি, যা দেখছি সেটা একটা স্বপ্নের তুলিতে আঁকা ঝিকিমিকি ক্যানভাস, হানাবাড়ি নয়! হঠাৎ উঁচু থেকে দূর নীচের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠতেই এক বিদেহী ধাক্কায় কয়েক পা পিছিয়ে গেল সিউপরসাদ। মুখটা ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। সবেমাত্র স্থানীয় থানার অনুমতি নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ১০৬ নম্বরের দরজা খোলা হয়েছে। ছায়া ছায়া ঘরের বিছানা থেকে নীচের দিকে মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে রয়েছেন লেডি ফ্রান্সেস গার্নেট-অর্ম। জানলা দিয়ে আসা মেঘলা দিনের মৃদু আলোতেও ফলস আইল্যাশের মাঝে ঠিকরে বেরনো দুটো চোখ ভীষণ জ্বলজ্বলে। ডান হাত বেডসাইড টেবিলের দিকে বাড়ানো, যেন কিছু একটা ধরতে চাইছেন। দেহ কাঠের মতো শক্ত। টর্চের আলোয় মনে হল চামড়ায় হালকা নীলচে আভা। ডঃ রেডিংটন দেহ পরীক্ষা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দারোগা সাহেব খুঁটিনাটি নোট করলেন ডায়েরিতে— ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ, সমস্ত জানলা বন্ধ, বিছানার চাদরে সংগ্রামের চিহ্ন, কম্বল পড়ে রয়েছে মাটিতে, বেডসাইড টেবিলে কাগজ, কলম, ওষুধের শিশি। 
‘হার্ট ফেল। আমি ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিচ্ছি। শেষকৃত্য সম্পন্ন করুন।’ ডাক্তার তড়িঘড়ি জানালেন। 
দিল্লি থেকে সদ্য বদলি হয়ে আসা দারোগা বললেন, ‘ধীরে, ডঃ রেডিংটন... ধীরে। আমার মাথায় যতগুলো সাদা চুল, তার থেকে কিঞ্চিৎ বেশিই ক্রাইম সাইট দেখেছি। কেসটা এত স্ট্রেট ফরোয়ার্ড মনে হচ্ছে না। থানায় গিয়ে ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্টের সামনে বয়ান দিতে হবে আপনাকে। বডি ময়নাতদন্তে যাবে। মিঃ গর্ডন, আমি ঘরটা সিল করে দেব।’
দারোগা সাহেব চৌকাঠের বাইরে পা রেখে দরজা বন্ধ করতে যাবেন, কিছু একটা খটকা লাগল, সাঁ করে আবার দরজা খুলে ফেললেন। ‘সেন্টার টেবিলের ওপর ওগুলো কী?’ 
প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন গর্ডন সাহেবের দিকে।

যা দেখে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল, সেগুলো কী তা আন্দাজ করতে সময় লাগল না। পাথরের ফলক বসানো যে পথ হেঁটে ভানগড় কেল্লার চত্বরে প্রবেশ করেছি, সেই পথের দুধারে সারি সারি এক কামরার বাসা। পড়ে রয়েছে পাথরের দেওয়াল, থাম, জানলা কিন্তু মাথাগুলো ছাদহীন! ওই ঘরগুলোয় মানুষ সংসার পেতেছিল? নাকি দোকান? এরকম সারি সারি ঘরের ওপর থেকে একইভাবে কী করে ছাদ ভেঙে পড়ল? তখন কী ছাদের নীচে ক্লান্ত চাষি ঘুমিয়েছিল? কোনও ছোট্ট মেয়ে ঠাকুমার কাছে গল্প শুনছিল? কেউ শুতে যাওয়ার আগে সারাদিনের দোষ স্বীকার করে নিচ্ছিল উপরওয়ালার কাছে? ভাবলাম এর পাশে এই বিশাল কেল্লার ছাদটা কী বৈপরীত্যে ভরা! যাদের আছে, যাদের নেই — এই ফারাকটা চিরকালীন। কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিন্তু পরক্ষণেই চারপাশে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার চমকানোর পালা। সে কী! কেল্লারও ছাদ নেই। এতক্ষণে সেটা নজরে এল! দাঁড়িয়ে রয়েছি কেল্লার মাথায় একটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। একে ছাদ বলা যায় না। অর্থাৎ এমন কিছু একটা ঘটেছিল, যার জন্য ‘যাদের আছে’, ‘যাদের নেই’ সব একাকার হয়ে গিয়েছিল।
আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে ভানগড় কেল্লার নির্মাণ। অম্বর রাজ্যের রাজা ভগোয়ান্ত দাস তাঁর পুত্র মাধো সিং-এর জন্য তৈরি করেন এই দুর্গ। মাধো সিং ছিলেন সম্রাট আকবরের নবরত্নের অন্যতম মান সিং-এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। মাধো সিং-এর এক পৌত্র আজব সিং ভানগড়ের সন্নিকটে আজবগড় কেল্লার নির্মাণ করেন। কিন্তু পারিবারিক বৈরিতার জন্য আজবগড় ও ভানগড়ের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। স্থানীয় লোককাহিনি মতে আজব সিং-এর সৈন্যের হাতে ভানগড়ের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। তিনি চত্বরের মন্দিরগুলিকে অক্ষত রেখে বাকি সবকিছু ধ্বংস করে দেন। যুদ্ধের গ্রাসে প্রাণ যায় বহু মানুষের এবং বাকিরা বাসা শূন্য করে পালিয়ে যায়। এর কয়েক দশক পর কিছু মানুষ ফিরে আসে। কিন্তু ১৭৮৩-র অনাবৃষ্টি জনিত দুর্ভিক্ষ কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয়। আজ তাই ভানগড় জনমানবহীন। শুনতে আজব লাগলেও, সংলগ্ন আজবগড় আজও বর্ধিষ্ণু। আমার গাড়ি দিল্লি বিমানবন্দর থেকে গ্রামীণ পথে আজবগড় হয়েই ভানগড় পৌঁছেছিল।
এই ইতিহাস কিন্তু বিস্তারিতভাবে দলিলবদ্ধ নয়। ১৮৭৮ সালে সাহেবদের প্রকাশিত পত্রিকা ‘গেজেটিয়ার অব আলোয়ার’-এ এই ইতিহাসের আভাস রয়েছে মাত্র। তবু এই গল্পে অতিপ্রাকৃতের কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু ভানগড়ের ইতিহাস সম্বন্ধে বাকি যে দুটি লোকগাথা রয়েছে সেগুলিতে অলৌকিক উপাদান রয়েছে। সেই গল্পে ইতিহাস, কল্পনা, খেয়াল সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সত্য-মিথ্যা বিচার করা দুরূহ হয়ে পড়ে।   
  ‘সত্যি মিথ্যে জানি না, অফিসার। শুনেছি টেবিলের ওপর ওই যে বড় সাইজের স্ফটিক-গোলকটি দেখছেন, সেটি ওঁরা ভবিষ্যৎ দর্শনে ব্যবহার করতেন। ক্রিস্টাল-গেজিং। ওই কাঠের পাটাতনটি, যার ওপর কালো কালিতে ইংরেজি বর্ণমালা লেখা রয়েছে এবং তলায় ০ থেকে ৯ অবধি সংখ্যা, সেটি উইজি বোর্ড। ওঁরা প্রেতচর্চা করতেন। ‘ওঁরা’ বলতে লেডি গার্নেট-অর্ম এবং ওঁর সঙ্গিনী মিস ইভা মাউন্টস্টিফেন।’ গর্ডন জানালেন।
দারোগা চোখ কপালে তুললেন। ডাক্তার মৃদু হাসলেন। ‘ভূত নিয়ে চর্চা করতে করতে নিজেই ভূতপূর্ব হয়ে গেলেন! ক্ষমা করবেন, আমি জানি এটা জোক করার সময় নয়। কিন্তু শিক্ষিত লোকের মুখে এসব ভূত-টুত শুনলে আমার হাসি পায়। আমার মাথায় একটাও চুল সাদা নয়। কিন্তু ভাববেন না আমি মৃত্যু দেখিনি।’
চুলের প্রসঙ্গ উত্থাপনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন দারোগা। তাই শ্লেষটা ফেরত দিলেন, ‘মৃত্যু তো দেখবেনই। সেই জন্যই তো আপনাদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘দে আর প্রাকটিসিং মেডিসিন।’ প্র্যাকটিসই চলতে থাকে, আসল ম্যাচ খেলা হয় না। যাই হোক, মিঃ গর্ডন তো বললেন উনি যা শুনেছেন, তাই বলছেন।’ 
এবার মিঃ গর্ডনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিস মাউন্টস্টিফেনের ঘরে একবার চলুন। ওঁর সঙ্গে কথা বলি।’
‘গতকাল কোনও এক জরুরি কাজে উনি হঠাৎ লখনউ চলে যান।’ এরপর কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলেন, ‘উনি এই ঘরেই থাকেন।’
‘দুজন মহিলা একসঙ্গে থাকতেন হোটেলের একই কামরায়?’ দারোগা প্রশ্নের সুরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগে এমন ঘটনায় ভ্রূ কুঁচকানো স্বাভাবিক।
‘ইঙ্গিতে সীমাবদ্ধ থাকুন। এই প্রসঙ্গে কোনও আলোচনায় আমি ঢুকব না।’, গর্ডন সাফ জানিয়ে দিলেন।
গল্পদুটির প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভানগড় সম্পর্কে প্রেত-গবেষকদের উৎসাহ বাড়ে এই গল্পে।
প্রথম গল্পে ভানগড় কেল্লা সংলগ্ন এক টিলায় ছিল তপস্বী বালানাথের আশ্রম। তখনও কেল্লা তৈরি হয়নি। দুর্গ নির্মাণের পূর্বে তাঁর অনুমতি চাওয়া হয়। উনি একটি শর্তে অনুমতি দিয়েছিলেন, কেল্লার ছায়া যেন কোনও মতে তাঁর আশ্রমে এসে না পড়ে। কিন্তু রাজার অহং-এর উচ্চতা পায় কেল্লা; দুর্গের ছায়া আশ্রমে গিয়ে পড়ে এবং বালানাথ অত্যন্ত রুষ্ট হন। ওঁর অভিশাপে কেল্লার ছাদ তো বটেই, ভানগড় বসতির প্রতিটি বাড়ির ছাদ ধসে পড়ে। এক রাতেই নিহত হয় ভানগড় নিবাসী। 
দ্বিতীয় গল্পের কেন্দ্রে ভানগড়ের কোনও এক রাজকন্যা রত্নাবতী। তাঁর সৌন্দর্যে মোহিত হয় সিঙ্ঘিয়া নামের এক তন্ত্রসাধক। কিন্তু সিঙ্ঘিয়া জানত, তার সামাজিক মর্যাদায় রাজকন্যার পাণিগ্রহণ সম্ভব নয়। একজন নারী নিজে কী চাইছে, সেই প্রশ্নে না ঢুকে সে ছলচাতুরির মধ্যে উত্তর খুঁজে নেয়। রাজকন্যার জন্য বাজার থেকে সুগন্ধি কিনতে ব্যস্ত এক দাসীকে ধাওয়া করে। সুযোগমতো বোতলের সুগন্ধিকে মন্ত্রপূত করে। সেই সুগন্ধি ব্যবহারে রাজকন্যা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসবেন, এই ছিল দুরভিসন্ধি। কিন্তু একটি বিষয় সম্পর্কে সে অবগত ছিল না। এবং সেখানেই তার অসাধু উদ্দেশ্য আত্মঘাতী হয়ে যায়।
ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা নয়, সেটা লেডি গার্নেট-অর্মের ময়না তদন্তের রিপোর্টে ধরা পড়ে। হোয়াটসঅ্যাপ যুগের বহু আগেই গুজব ব্যাপারটা খরগোশ আর সত্য বচন কচ্ছপ। যতক্ষণে সত্যতা জামাপ্যান্ট পরে তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণে দুনিয়ার অর্ধেক ঘোরা হয়ে গেছে গুজব বাবাজির। তাই রাজধানী ক্যালকাটার যে অভিজাত বৃত্তে দুই মহিলার ওঠাবসা, সেখানে নানান জনশ্রুতি জন্ম নেয়। কিছু তথ্যও সামনে চলে আসে। ইউনাইটেড প্রভিন্সের এক ব্রিটিশ অফিসারের সঙ্গে লেডি গার্নেট-অর্মের বিবাহ স্থির হয়। কিন্তু বিবাহের পূর্বেই অফিসার মারা যান। বাগদত্তার সঙ্গে মরণোত্তর সংযোগ স্থাপনের জন্যই মিস মাউন্টস্টিফেনের কাছে তাঁর প্রেতচর্চায় হাতেখড়ি এবং ধীরে ধীরে নাকি লেডি গার্নেট-অর্মের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা জন্মায়। স্যাভয় হোটেলের কামরায় তাঁর ধারণা হয়, তিনি স্ফটিক-গোলকে নিজের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন। বিষদে সেই দৃশ্য তিনি লিপিবদ্ধও করেন তাঁর দিনলিপির পাতায়। সমস্ত তথ্য যখন আত্মহননের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে তদন্তের সিদ্ধান্তকে, তখনই ময়না তদন্তের রিপোর্ট সামনে আসে। লেডি গার্নেট-অর্মের দেহে অতিরিক্ত পরিমাণে প্রুসিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। বেডসাইড টেবিলে যে ওষুধের শিশি দেখে দারোগা সাহেবের সন্দেহ হয়েছিল, সেই শিশিতেই প্রুসিক অ্যাসিড ছিল। প্রশ্ন ওঠে, বোতলে কে রেখেছিল প্রুসিক অ্যাসিড? আত্মহত্যা করতে চাইলে সোজা প্রুসিক অ্যাসিডের বোতল থেকেই একজন বিষপান করবে। তাছাড়া প্রুসিক অ্যাসিড সহজলভ্য নয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তিনি পেলেন কোথায়? তৃতীয় প্রশ্ন আমার। যে বোতলে থাকার কথা সোডিয়াম বাইকার্বোনেট ভিত্তিক নিরীহ অম্লনাশক ওষুধ, সেই বোতলই যে ঘাতক হয়ে উঠবে, সেই ভবিষ্যৎ কি স্ফটিক-গোলকে টের পেয়েছিলেন লেডি গার্নেট-অর্ম?
টের পেয়েছিলেন রাজকন্যা রত্নাবতী। সুগন্ধির বোতল স্পর্শ করেই সিঙ্ঘিয়ার দুরভিসন্ধি টের পেয়েছিলেন। সিঙ্ঘিয়া জানত না রত্নাবতী নিজে তন্ত্রসাধক। রত্নাবতী জানলা দিয়ে সুগন্ধির বোতল ছুড়ে ফেলেন। বোতল গিয়ে পড়ে এক বিশাল পাথরের ওপর। মন্ত্রপূত সুগন্ধি পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রাণের সঙ্গে কামনা। সিঙ্ঘিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রাস্তার ঢাল বেয়ে তার দিকে গড়িয়ে যায় পাথর। শেষে পাথরেই পিষ্ট হয়ে মারা যায় সিঙ্ঘিয়া। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে অভিশাপ দিয়ে যায় ভানগড়কে— ভানগড়ের সকল নিবাসী শীঘ্রই মারা যাবে কিন্তু পুনর্বার মানবজন্ম হবে না। তাদের আত্মা ইহলোক পরলোকের মধ্যবর্তী এক নিদারুণ কষ্টের অস্তিত্বে আটকে থাকবে।
গল্পের বড় মাহাত্ম্য অবিশ্বাসের পাথর খইয়ে সে নদীর মতো নিজের পথ করে নেয়। যেখানে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রবেশ নিষেধ, সেই হৃদয় নামক বস্তুটিতেও পৌঁছে যায় গল্প। তাই ভানগড়ে ক’জন সত্যিকারের ভূত দেখেছে, তার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে গল্পগুলো। রাতের অন্ধকারে আশপাশের মানুষজন যে আর্তনাদ শুনতে পায়, সেগুলো সারিস্কা জঙ্গলের জীবজন্তুদের কি না সেই নিয়েই বা কজন ভেবেছে? আমি যখন কেল্লা-চত্বরের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়েছিলাম, টিং টিং করে ঘণ্টার শব্দ পাই। মন্দিরের দিক থেকে আসছে না। কেল্লার দিক থেকে আসছে না। ভিতরে এত পর্যটক। তাদের কেউ ঘণ্টা হাতে ঘুরছে বলে দেখিনি। এবং কেনই বা সেভাবে হাঁটতে যাবে? তাহলে এই শব্দ আসছে কোথা থেকে? হঠাৎ দেখলাম বহু দূরে টিলার গায়ে ছাগল চরাচ্ছে এক রাখাল বালক। কিন্তু শৈলপদমূলে দাঁড়িয়ে আমি সেই ছাগলদের ঘণ্টাধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ঠিক যেমন করে কুশীলবদের সংলাপ পৌঁছে যেত গ্রিক অ্যাম্ফিথিয়েটারের সবচেয়ে উপরের আসনে বসা দর্শকটির কাছে এবং সেই দর্শকের করতালি পৌঁছে যেত অভিনেতার হৃদয়ে, ঠিক সেইভাবে। তিনদিকে উপগিরি দ্বারা পরিবেষ্টিত ভানগড় কেল্লাও প্রকৃতি আর স্থাপত্যের খামখেয়ালি মিশ্রণে তৈরি এক অ্যাম্ফিথিয়েটার। তাই নিশাচর বন্যপ্রাণীর ডাক প্রতিধ্বনি তুলবে সেটা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে আমার। 
কিন্তু কেল্লার অলিন্দে হাঁটতে হাঁটতে যে অদ্ভুত কোনও অনুভূতি হয়নি সেটা বলব না। সবচেয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় দ্বিতলের এক দরদালান ঘিরে। আমি নীচ থেকে এক মহিলাকে দেখতে পাই দ্বিতলের সেই অলিন্দে এক বৃহৎ খিলানাকৃতি জানলায় দাঁড়িয়ে। অন্যান্য মহিলাদের তুলনায় তাঁর পোশাক আলাদা। রাজস্থানি চোলি ঘাগরার ওপর খুব উজ্জ্বল রঙের শাল এবং গহনার আধিক্যই তাঁকে ভিড়ের মধ্যে ব্যতিক্রমী করেছে। কিন্তু যখন সিঁড়ি বেয়ে সেই দালানে পৌঁছই, মহিলাকে সেখানে দেখতে পাইনি। ওপরে ওঠার সিঁড়ি কিন্তু একটিই। তিনি নীচে নামলে আমার পাশ দিয়েই নামতেন। দ্বিতলে তাঁকে দেখতে না পেয়ে আমি দ্রুত ত্রিতলের ছাদে উঠি। সেখানেও তিনি নেই। এর পরের মিনিট দশেক আমি কেল্লা এবং কেল্লার চত্বরে বেশ কিছু জায়গায় তাঁর খোঁজ করি। তাঁকে আর দেখতে পাইনি। আমি কিন্তু রাজকন্যা রত্নাবতীর গল্পটি শুনি এর বহু মাস পরে।
আমার আরও কিছু অভিজ্ঞতা হয় দ্বিতলের সেই দরদালানে। খিলানাকৃতি বৃহৎ জানলাগুলির জন্য দরদালানের পথ জুড়ে আলো আঁধারির ডোরা কাটা। সেই পথে পা রাখতেই অব্যক্ত এক অস্বস্তি শুরু হয় মনে। যেন মন্দের কোনও রাজ্যে এলাম। এখানে আমার উপস্থিতি পছন্দ করা হচ্ছে না। কে করছে না সেটা বলে মুশকিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম এ শুধু আমার অনুভূতি নয়। অনেকেই এই অনুভূতির শিকার এবং তাদের অনেকে ধরেই নিয়েছে কেল্লার এই অংশে এমন কোনও মন্দ শক্তির বাস, যার কাছে বশ্যতা শিকার করলে অন্যায় বাসনা চরিতার্থ হতে পারে। সেই ধারণার প্রমাণ পেলাম একটি পরিত্যক্ত ঘরে। পাথরের দেওয়ালে কালিঝুলি। তার ওপর উজ্জ্বল গেরুয়া রঙের তিলক। তিলকের নীচে ধুপধুনোর অবশিষ্টাংশ। তার মাঝে কেউ একজন একটি বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র রেখে গেছে। নিমন্ত্রণপত্রে পাত্র কিংবা পাত্রীর (সঠিক মনে নেই আজ) নামটি কালির আঁচড়ে কাটা। অর্থাৎ অশুভ শক্তির কাছে বিবাহপণ্ডের প্রার্থনা সেরে গেছে কোনও এক অপগণ্ড! 
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর বিস্মিত হয়ে দেখলাম প্রকৃতির মেজাজেও কেমন যেন পরিবর্তন। ঝকঝকে রোদের জায়গায় কুয়াশার ঝিম নামছে। বেলা একটার পক্ষে এমন আবহ অসম্ভব না হলেও, বিরল। নিস্তেজ রোদ গায়ে আবার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেল্লা সংলগ্ন জঙ্গলটি নজরে এল। এবার দ্বিতীয়বার ধাক্কা খাওয়ার পালা। জঙ্গলের মাঝে এক বৃক্ষহীন ক্ষুদ্র ময়দানে গ্রামবাসীদের ভিড়। ক্যামেরায় জুম করে দেখলাম এক মহিলাকে ঘিরে বহু পুরুষ এবং কিছু মহিলার সভা বসেছে। স্থানীয় মানুষের কাছে জানতে পারলাম সেটি খাপ পঞ্চায়েতের বিচারসভা। কেন্দ্রের মহিলা ডাকিনী সন্দেহে ধৃত। আদালত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এমন এক প্রাঙ্গণ, যার সঙ্গে অতি-প্রাকৃতের সংযোগ রয়েছে। হা হতোস্মি!
কেল্লার সিঁড়ি বেয়ে নেমে, ফেরার পথ ধরলাম। আরও বেশ কিছু দৃশ্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রস্তর-বৃত্ত। যাঁরা অলৌকিক নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা জানেন, আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ড অঞ্চলের কেল্টিক বিশ্বাসে এমন প্রস্তর-বৃত্তের ব্যবহার। বৃত্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলে দাঁড়িয়ে মানুষ অন্য ডাইমেনশনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করে। এমন কাজ কেউ দিনের আলোয় সর্বসমক্ষে করবে না। অর্থাৎ সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অনেকেই রাতের অন্ধকারে এই চত্বরকে তাদের তন্ত্র-মন্ত্রের পীঠ হিসেবে ব্যবহার করছে।  
ভানগড়ে আমার পূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গেলে, গোটা একটা প্রবন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা অলৌকিক নিয়ে চর্চায় স্ব-প্রচারের চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ অন্য ডাইমেনশনের গোপনীয়তা রক্ষার অলিখিত চুক্তিকে সম্মান জানানো। ভূতের সন্ধানে ভানগড়ে যেতে চাইলে, ভিক্টর হুগোর একটা কথা মাথায় রাখা ভালো— মৃতের দর্শন কিন্তু চোখ দিয়ে হয় না, অনুভূতি দিয়ে হয়। আর এটা বলা মুশকিল, তারা আমাদের জগতে হানা দেয়, না আমরা তাদের জগতে! জীবনে অলৌকিকের উপস্থিতি হলিউডি সিনেমা বা র‌্যামসে ভাতৃদ্বয়ের হাস্যকর ভূতগুলির মতো নয়। আরও সূক্ষ্ম, আরও মানসিক এবং প্রশিক্ষণ ও বিশ্বাস সাপেক্ষ।
ন্যায়বিচার বিশ্বাস সাপেক্ষ নয়, প্রমাণ সাপেক্ষ। প্রশিক্ষিত গোয়েন্দার দল প্রমাণাভাবে দারোগার এক বিশ্বাসকেই সামনে রেখে এগতে থাকেন। কিন্তু আদালতে তাঁদের তদন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে। 
‘ইয়োর অনার, সোডিয়াম বাইকার্বের শিশি লেডি গার্নেট-অর্ম ব্যতীত একমাত্র মিস মাউন্টস্টিফেনের নাগালে ছিল।’
‘কিন্তু শিশির গায়ে তো শুধু মৃতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট।’
‘মিস মাউন্টস্টিফেন আগের দিন হুট করে কেন লখনউয়ের উদ্দেশে রওনা হন!’
‘লুধিয়ানা গেলে আপনার সন্দেহ কম হতো জানলে উনি হয়তো সেখানেই যেতেন।’ জজ সাহেব কিছুটা রসিকতা করলেন।
‘মিস মাউন্টস্টিফেন লখনউ থেকে সাইকিক উপায়ে তাঁর বান্ধবীকে বাধ্য করেছেন শিশিতে প্রুসিক অ্যাসিড ঢালতে। এটা এক ধরনের রিমোট কন্ট্রোলিং।’
‘আর ইউ ড্রাঙ্ক ওর হোয়াট?’
‘আমরা যদি অলৌকিক চিন্তাধারাকে প্রশ্রয় দিতে চাই, ‘মার্ডার বাই সাজেশন’ কি অসম্ভব? বান্ধবীর সুইসাইড বাসনার কথা শুনে উনি উপায় সাজেস্ট করতেই পারেন।’
‘সম্ভব। কিন্তু লিখিত কিছু দেখান। ঘরের মধ্যে আড়ি পেতে তো আর আপনি কিছু শোনেননি।’ 
‘প্রুসিক অ্যাসিড ফার্মেসি থেকে জোগাড় করা দুরূহ। কিন্তু যদি একজন ডাক্তার বন্ধু হয়...’
‘প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ডঃ রেডিংটনের সঙ্গে লেডি গার্নেট-অর্মেরও বন্ধুত্ব ছিল।’
‘বন্ধু কখনও কি আত্মহননে সাহায্য করবে, ইয়োর অনার? বরং মিস মাউন্টস্টিফেনের সঙ্গে চক্রান্ত করে, সঠিক সময়, খুব সাবধানে সোডিয়াম বাইকার্বের শিশিতে বিষ রেখে দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।’
‘মোটিভ?’
‘সেটা তো আমাদের সকলের জানা!’
কিন্তু মেজর চার্লস বার্টন জানতেন না। এরকম একটা ঘটনা যে ঘটে যাবে, সেটা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। সময়টা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। সশস্ত্র আন্দোলনের বছর। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। বিপ্লব কিন্তু কোনও মহানায়কের বাগানে বসন্ত উৎসবের জলসা নয়, লিও টলস্টয়ের ‘ঈশ্বরের রাজত্ব তোমার মধ্যে’ প্রবন্ধ নয়, রদ্যাঁর ভাস্কর্য নয়, চারুলতার সূচিকর্ম নয়, যামিনী রায়ের সাঁওতাল জননী নয়; নরমভাবে, ধীরে ধীরে, সাবধানে, সহানুভূতির সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে, বিনীত, সরল এবং নম্রভাবে বিপ্লব অগ্রসর হয় না। বিপ্লব আসে ঝঞ্ঝার মতো। সহিংসভাবে এক শ্রেণির মানুষ আর এক শ্রেণির মানুষের শাসনকে উৎখাত করে। ভারতের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যতিক্রম ছিল ভাবার কোনও কারণ নেই। 
বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির মেজর বার্টন ছিলেন কোটা রাজ্যের (বর্তমানে রাজস্থানের অন্তর্গত) রেসিডেন্ট। প্রায় এক দশক কোটার ব্রিটিশ রেসিডেন্সিতে সপরিবার বসবাস করেছেন মেজর। ১৮৫৭ সালের মে মাসে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের নিমাচ্ অঞ্চলের ব্রিটিশ জেনারেল তাঁর কাছে জরুরি তলব পাঠান। নেটিভ সৈনিকরা সেখানকার ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে, এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শতাধিক মাইল দূরের নিমাচ্ রক্ষার জন্য কোটার মহারাও রাম সিং-এর সৈন্য নিয়ে রওনা হয়ে যান মেজর বার্টন। সঙ্গে স্ত্রী, চার পুত্র এবং কিশোরী কন্যা। কিন্তু নিমাচে থাকাকালীন সেপাই অভ্যুত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হন, কারণ ততদিনে বারাকপুর আর মিরাটের স্ফুলিঙ্গ সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আগুনের ছড়াতে কারও অনুমতির লাগে না। বিদ্রোহী সেপাইরা নিমাচ্ ত্যাগের পূর্বে ক্যান্টনমেন্ট ধ্বংস করে দেয়। ব্রিটিশ অফিসাররা কাছের এক কেল্লায় পালিয়ে বাঁচেন। কেল্লায় বসবাসকালে মহারাও ওঁকে চিঠি মারফত রেসিডেন্সি প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ জানান। সেই অস্থির দিনগুলোয় জীবনের অনিশ্চিয়তা ছাড়া কিছুই নিশ্চিত না থাকায়, মনে পূর্বাশঙ্কা নিয়েই রেসিডেন্সিতে ফেরেন মেজর বার্টন। এখানেও সেই ‘কেন জানি না মনে হল’র দুর্ভেদ্য রহস্য।
‘আমি জানি না। রহস্য না বাড়িয়ে আপনিই বলুন।’ মুচকি হেসে বললেন এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের জজসাহেব উইলিয়াম জন বারকিট।
সরকারি উকিল জানালেন, ‘মিস মাউন্টস্টিফেন কিন্তু নিম্ন আদালতে তাঁর বান্ধবীর শেষ উইলের সত্যতা প্রমাণের জন্য অ্যাপিল করেছেন। উইল অনুযায়ী বান্ধবীর বিশা
12d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা