সাপ্তাহিক বর্তমান

আলমাটিতে কয়েকদিন
প্রবীর ঘোষাল

বিমান আলমাটি অবতরণের আগেই সকলের চোখে বিস্ময়! রাত সাড়ে আটটায় উড়ানে দিল্লি থেকে উড়েছি। ঘণ্টা দেড়েক যাওয়ার পরই হঠাৎ আমাদের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘বাইরেটা একবার চেয়ে দেখ!’ 
বিমানসেবিকা ব্যাপারটা নজর করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমানের সব আলো নিভিয়ে দিলেন। অন্ধকারে যাত্রীরা প্রায় সকলেই জানালায় চোখ লাগিয়ে নৈসর্গিক এক দৃশ্যের সাক্ষী হলেন। 
বরফে ঢাকা হিন্দুকুশ পর্বতমালা। পরেরদিন বুদ্ধপূর্ণিমা। ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ছটায় এ যেন কল্পনার স্বর্গলোক! স্কুলে হিন্দুকুশ পর্বতমালার কথা পড়েছিলাম, আর এখন চাক্ষুষ করছি। আফগানিস্তান আর তাজাকিস্তানের আকাশপথে এই দৃশ্য আমরা দেখেছি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে। অনেক দেশ-বিদেশ ঘুরেছি, কিন্তু বিশাল বরফের স্বর্গরাজ্য এমন চাঁদের আলোয় দেখার সৌভাগ্য আগে কখনও হয়নি। ভাষাতে সেই দিনের দৃশ্য বর্ণনা করা সম্ভব নয়, এক কথায় বাকরুদ্ধ! 
আমাদের বিমান যখন আলমাটি বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল তখন মধ্যরাত। দিল্লি থেকে সোয়া তিন ঘণ্টার জার্নি। রাতের খাবার আমরা সঙ্গে নিয়েই বিমানে উঠেছিলাম। ক্যাটারারকে দিয়ে অত্যন্ত মুখরোচক পাতলা পরোটা, সঙ্গে ড্রাই আলুর দম আর ঢ্যাঁড়স ভাজা বানিয়ে এনেছিল। সঙ্গে সুস্বাদু সন্দেশ। সকলেরই পেট ভর্তি। বিমানবন্দরে নেমে খিদের ব্যাপার নেই। অবশ্য খিদে পেলে খুব মুশকিল হতো। কারণ, আলমাটি এয়ারপোর্ট একেবারেই ছোট। দোকানপাটের বালাই নেই। ইমিগ্রেশনে দাঁড়াতেই কাজ হয়ে গেল। কাজাখস্তানে ঢুকতে ভারতীয়দের ভিসা লাগে না। পাসপোর্ট থাকলেই হবে। 
লাগেজের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। কনভেয়ার বেল্ট ঘুরেই চলেছে। আমাদের গাইড সদ্য গোঁফ গজানো তরুণ ডিওর এসে গিয়েছে। বিমান থেকে সদ্য নামা যাত্রীরা অধিকাংশই ভারতীয় এবং পর্যটক। তাদের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে, এদের মধ্যে উত্তর-দক্ষিণ বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ আছে। আমাদের দেশের অসহ্য গরম থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে তারা ঠান্ডার দেশে পাড়ি দিয়েছে। আলমাটিতে নেমে থেকেই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। বাইরে বেরিয়ে বোঝা গেল, কাজাখস্তানে এটা গরমের মরশুম হলেও, আবহাওয়া বেশ মনোরম। হালকা শীতবস্ত্র গায়ে থাকলেই চলবে। 
বিমানবন্দরের ভেতরের মতোই বাইরেটাও ম্যাড়ম্যাড়ে। সাজানো-গোছানো নয়। বিমানবন্দরের নাম লেখা রাশিয়ান ভাষায়। বোঝা যায়, পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লেও, আলমাটির পর্যটন কেন্দ্রিক পরিকাঠামো এখনও সেই মতো তৈরি হয়নি। আমাদের বেঙ্গলি ব্রিগেড ১৯ জনের। একজন অবশ্য নেহাতই শিশু। ট্রাভেল এজেন্সি আমাদের জন্য ৩৫ আসনের ভলভো জাতীয় সুপার ডিলাক্স বাসের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু লাগেজ নিয়ে বাসের কাছে পৌঁছতে সবাইকে বেশ পরিশ্রম করতে হল। কারণ, বাসের মতো বড় গাড়িকে বিমানবন্দরের গেটের কাছে আসতে দেওয়া হয় না। ফলে, মালপত্তর নিজেদের টেনে নিয়ে যেতে হল বাস পর্যন্ত। 
ইউরোপের পুরনো শহরগুলোর মতোই চওড়া রাস্তা। তবে গভীর রাত বলেই গাড়ি ঘোড়া কম। কিছু পাব-রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ির পার্কিং দেখে বোঝা গেল, সেসব জায়গা রাতেও জমজমাট। রাতের আলমাটি দেখতে দেখতেই আধ ঘণ্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আটতলার ফোর স্টার হোটেল। রিসেপশনে একজন বসে আছেন। যেভাবে আপ্যায়ন করলেন সেই যুবক মনে হল, আমাদের আসার অপেক্ষাতেই ছিলেন। চটপট ঘরের চাবি হাতে এসে গেল। সবার চোখে ঘুম ঘুরপাক খাচ্ছে। কালহরণ না করে যে যার রুমে চলে গেলাম। রাত তখন প্রায় তিনটে। সবার ঘর ডিলাক্স টাইপ। ডবল বেডের খাট রুমের মতোই বেশ বড়। টেবিল, টিভি, সোফা সবই মজুত আছে। মিনি ফ্রিজে রাখা আছে বিয়ার, কোলড্রিংস, স্ন্যাকসের প্যাকেট। বাথরুমও সাজানো গোছানো। 
বিছানায় শুয়েই ঘুমের দেশে। ঘণ্টা পাঁচেক ঘুমিয়ে সকাল আটটার পরে উঠলাম। জানলার পর্দা সরিয়েই স্ত্রী বলে উঠল, ‘ফ্যান্টাস্টিক! বাইরে চেয়ে দেখ!’ বড় বড় বহুতলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বরফের পাহাড়। কোন্নগরে ৪২ ডিগ্রি গরম থেকে ঠান্ডার শহরে এসে বরফের দৃশ্য মনটাকে সাত সকালেই বেশ তরতাজা করে দিল। রোজের অভ্যাস মতো ট্র্যাকস্যুট পরে প্রাতঃভ্রমণের জন্য বাইরে বেরলাম। রাস্তার মতোই চওড়া ফুটপাত। চারদিকে প্রচুর গাছপালা। মর্নিং ওয়াকারদের পাশাপাশি কিছু মানুষ যে অফিস গোয়ার্স সেটাও টের পাওয়া গেল। 
আধঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে ফিরে এলাম। স্নান সেরে সবাই ব্রেকফাস্টের টেবিলে ন’টার মধ্যেই হাজির। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট। সবটাই বুফে। সাধারণত বিদেশের হোটেলে যে ধরনের খাবার ব্রেকফাস্টে থাকে, সেই রকমই ব্যবস্থা। সসেজের রকমারি, বেকারির নানা পদ। খুবই সুস্বাদু কেক পেস্ট্রির মেনু। ড্রাই ফ্রুটসে কাজাখস্তানের নাম বিশ্বব্যাপী। আখরোট থেকে হরেক কিসিমের ড্রাই ফ্রুটসের সম্ভার। তবে, ওদেশে গেলে যত পারবেন আপেল খাবেন। কারণ, ওদের আপেলের খ্যাতিও প্রচুর। জুসি আপেল নামের ফলটি কাজাখস্তানের গাছেই নাকি একমাত্র ফলে। কয়েকদিনের সফরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আপেলের বাগান দেখেছি। 
আরও একটা কৌতূহলের বিষয়ে জানানো দরকার। সেটা হল, আলমাটির নাম মাহাত্ম্য। এই নামটির অর্থ হল, আপেলের পিতা। আলমাটি আগে ছিল কাজাখস্তানের রাজধানী। মধ্য এশিয়ার এই দেশটি দীর্ঘদিন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গ ছিল। ১৯৯১ সালে রাশিয়ান কমিউনিস্ট সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। স্বাধীন দেশ হয় কাজাখস্তান। তখন থেকে রাজধানী আস্থানা। তবে গুরুত্বের বিচারে দেশের দ্বিতীয় শহর এই আলমাটি। বাণিজ্য থেকে সংস্কৃতি পর্যন্ত সবেতেই কাজাখস্তানের গুরুত্বপূর্ণ এই শহর। জনবহুলও বটে। দেশের জনসংখ্যা কুড়ি লাখের মতো। তার মধ্যে ২ লাখের বসবাস আলমাটিতে। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম হলেও, কাজাখস্তান কিন্তু ইসলামিক দেশ নয়। 
প্রায় হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত শহরটি শীত প্রধান হলেও, গরমও পড়ে। এমনকী ৩৪-৩৬ ডিগ্রি পর্যন্ত কোনও কোনও সময়ে তাপমাত্রা চড়ে যায়। তাই হোটেলের ঘরে রুম হিটারের পাশাপাশি এসি এবং ফ্যানের ব্যবস্থাও আছে। পর্যটকদের মাস হিসেবে মনোরম হল এপ্রিল-জুন। তারপর গরম এবং বর্ষা। আর বরফে ঢাকা দেশটিকে দেখতে হলে আসতে হবে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি। তখন কিন্তু মাইনাস ডিগ্রিতে চলে যায় তাপমাত্রা। আলমাটি শহরেও প্রবল তুষারপাত হয়। রাস্তাঘাট-গাড়ি-বাড়ি সে সময় বরফে ঢেকে থাকে। গরমেই ভারতীয়রা শৈল শহরের মজা নিতে বেশি ভিড় করেন আলমাটিতে। আমরা বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটগুলিতে গিয়ে বিশেষ বিদেশি দেখিনি, সবাই ভারতীয়। বিদেশীরা আসে শীতকালে। 
ব্রেকফাস্ট সেরে তো আমাদের বেরতে হবে। কী কী খাবার রয়েছে, আগেই কিছুটা বলেছি। আমাদের অনেকে কেক-পেস্ট্রি, সসেজের পাশাপাশি ওটস, কর্নফ্লেক্সও নিয়েছে। আমার চোখ গেল ভাতের ট্রে’তে। ভেতো বাঙালি তো! একটু ফ্যান লাগা গরম ভাত, আহা! তার গায়েই সাজানো রয়েছে চাইনিজ একটা তরকারি। নানা রকমের শাক সব্জির সঙ্গে ছোট ছোট মুরগির মাংসের টুকরো। চমৎকার লাগল তরকারি দিয়ে কয়েক গাল ভাত খেতে। 
ভাতের বিশারদ আমাদের মধ্যে উজ্জ্বল। ওর শিশু পুত্র বান্টি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য। তিন বছরে পা দেবে। তার জন্য কিচেনে আলু সেদ্ধ অর্ডার দিয়ে ভাতের সঙ্গে মেখে বান্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে ওর মা নূপুর। ডিম সেদ্ধও আছে। এই উজ্জ্বলই আমাদের সঙ্গে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে গিয়েছিল। হোটেলের ব্রেকফাস্ট টেবিলে আলু-ডিম সেদ্ধ তরিবত করে মেখে ভাতের সঙ্গে যখন আমাদের প্লেটে পরিবেশন করছিল তখন বিদেশিরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল আর ভাবছিল, এটা আবার কী খাবার! 
সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যেই আমাদের বড় বাস এসে হাজির। হোটেলের সামনেই চওড়া রাস্তা। পার্কিংয়ের অসুবিধা নেই। গাইড ডিওর সবাইকে তাগাদা দিচ্ছে। ছ’ফুটের উপর লম্বা, টকটকে ফর্সা গায়ের রং। সর্বদা মুখে তার হাসি লেগেই আছে। আদতে ডিওর উজবেক হলেও, জন্ম কর্ম কাজাখস্তানেই। লেখাপড়ায় দারুণ দড়। স্কুলের পরীক্ষায় ভালো মার্কস পাওয়ায়, সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। ওদের দেশে শিক্ষার প্রসারে সরকার এইরকম ব্যবস্থা করেছে। আমরা জানি ইংরেজিতে ডিয়ারের অর্থ প্রিয়জন। ওদের ভাষায় ডিওর। 
সকাল দশটার পর বাস ছাড়ল। সুন্দর সাজানো শহর। রাস্তাঘাট পরিষ্কার। চারদিকে প্রচুর গাছপালা। ফুলও ফুটে রয়েছে অনেক জায়গায়। বলে রাখি, এপ্রিল-মে মাসে টিউলিপ ফুলে ভরে যায় আলমাটি শহর। যত্রতত্র দেখা যায় নেদারল্যান্ডসের অরিজিনাল এই ফুল। তবে, কাশ্মীরের মতো টিউলিপ গার্ডেন নেই। শহর দেখে মুগ্ধ অমলদার মন্তব্য, ‘আসলে দেশটায় তো লোকজন কম, তাই সবকিছু এত সাজানো ও সুন্দর।’ ইউরোপের অন্যান্য শহরের মতোই আলমাটিতেও গাড়ি চলে রাস্তার ডানদিক ধরে। ড্রাইভারের আসন বাঁদিকে। আমাদের ঠিক উল্টো। রাস্তায় কোনও পুলিস নেই। সব গাড়ি সিগন্যাল মেনে চলে। পথচারীদের রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থাও সিগন্যালের মাধ্যমে, নির্দিষ্ট স্থানে। শহরের আইনশৃঙ্খলার নজরদারি করা হয় সিসিটিভির মাধ্যমে। 
শহর দর্শনে বেরিয়ে আমরা প্রথমেই দাঁড়ালাম ইতিহাসের দোরগোড়ায়, জেনকভ ক্যাথিড্রালের সামনে। গির্জাটির ঐতিহ্য বিশ্ববন্দিত। উচ্চতা এবং নির্মাণেও বৈচিত্র্যের দাবিদার। তুর্কিস্তান এবং তাসখন্দের বিশপরা এই গির্জাটি তৈরির উদ্যোগ নেন। এপি জেনকভ সহ আরও কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার মিলে ১৯৬০ সালে গির্জাটি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। পৃথিবীর আটটি উচ্চতম গির্জার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার জেনকভের নামের গির্জাটির অবস্থান শীর্ষ বলে দাবি করা হয়। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই গির্জায় কোনও পেরেকের ব্যবহার নেই। প্রবাদ আছে, যেহেতু যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, তাই বিশপরা চাননি, জেনকভ গির্জার গায়ে কোনও পেরেক পোঁতা হোক। ১৯১০ সালে আলমাটি শহরে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই দৈবদুর্বিপাকে শহরের প্রায় সব বড় বড় অট্টালিকা ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও এক অলৌকিক ক্ষমতায় অক্ষত ছিল গির্জাটি। চারদিকে বিশাল বিশাল গাছ। বিরাট চত্বর। গির্জার সামনে কয়েক হাজার পায়রার উপস্থিতি পর্যটকদের আকর্ষণের বিষয়। তাদের খাবার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্য ছড়ালেই পায়রার দল গায়ে উঠে পড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে বন্দি হচ্ছে, পায়রাদের সঙ্গে নানা পোজে পর্যটকদের ছবি। দু’হাত মেলে ধরে তার উপর একদল পায়রা বসিয়ে পটাপট সব ছবি মোবাইলে তুলে ফেলল। 
ভূমিকম্পের মতোই জেনকভ গির্জার আরও একবার ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়েছিল। সেটা কমিউনিস্ট সরকারের আমলে। মস্কোর নির্দেশে, যাবতীয় ধর্মীয় কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল গির্জার দরজা। সেই সময়ে ভয়াবহ ডাকাতিও হয়েছিল জেনকভ ক্যাথিড্রালে। ১৯২৭ সাল থেকে সেখানে চলেছিল যাবতীয় অরাজকতা। কাজাখস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে গির্জাটি হৃতগৌরব ফিরে পায়। 
গির্জার চত্বরটি প্রাকৃতিক দিক থেকে অতি মনোরম। বিশাল একটা পার্ক। বড় বড় গাছের পাশাপাশি, নানা রঙের ফুলের বাগান। রেস্ত খরচ করলে ঘোড়ার গাড়ি কিংবা ঘোড়ায় চেপে চত্বরটি ঘুরে ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। আমরা পায়ে হেঁটেই ঘুরতে লাগলাম। একটু গিয়েই শহিদ স্মৃতিতে গড়া চমৎকার একটা জায়গায় পৌঁছলাম। বড় বড় শহিদের মূর্তি। হাতে তাদের বন্দুক। একটা ঘেরা জায়গায় জ্বলছে প্রজ্জ্বলিত বাতি। গাইড ডিওর ইতিহাসের পাতা উল্টে বলতে লাগল, ‘বলশেভিকদের রাশিয়া উদ্ধারের স্মৃতিরক্ষার স্থাপত্য শিল্প এটি।’
গির্জার মতোই বাসে চেপে কিছুটা গিয়েই শহরের নামকরা মসজিদ। আলমাটির কেন্দ্রীয় মসজিদটি আকারে বিশাল। শিলান্যাস হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। মসজিদের নির্মাণ শেষ হয় ১৯৯৯ সালে। ভেতরে ৬ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে। আগেই বলেছি, কাজাখস্তান ইসলামিক দেশ নয়। পথেঘাটে বোরখা পরা মহিলা বলতে গেলে দেখাই যায় না। আমরা মসজিদের ছবি তুলে বাসে উঠে পড়লাম। 
এসে দাঁড়ালাম অবয় অপেরা হাউসের সামনে। প্রথমে ছিল মিউজিক স্টুডিও। ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৪ সালে প্রথম একটি মিউজিক্যাল কমেডি অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক বছরের মধ্যে হাউসে রাশিয়ান ব্যালে এবং নাটক পুরোদমে চালু হয়। পরবর্তীকালে গোটা দেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে অবয় অপেরা হাউসের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কাজাখস্তানের সংস্কৃতিও অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাদৃত ছিল। হাউসের সামনে ফোয়ারা। ফুলের বাগান। আর ফুটপাতে সারি সারি টু-হুইলার সেল্ফ ব্যালান্সিং স্কুটিগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে যার মতো কয়েন ফেলে চালু করে চালিয়ে চলে যাচ্ছে কিংবা চালিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য আলমাটি শহরের সর্বত্রই এই টু-হুইলার চেপে ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনিতে শহরের যাত্রী পরিবহনে ট্রামের মতো ইলেকট্রিক বাসগুলি চোখে পড়ছে, আছে মেট্রোরেলও।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর দু’টো বেজে গেছে। পেট চুঁই চুঁই করছে, এবার তাই সকলের গন্তব্য মধ্যাহ্নভোজনে। প্যাকেজে আমাদের ইন্ডিয়ান লাঞ্চ বলা ছিল। মিনিট দশেকের মধ্যেই নামকরা একটি রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলাম। আলমাটি শহরটা খুবই ছোট। মনে হচ্ছে, সদ্য চেনা এলাকাতেই আমরা ঘোরাঘুরি করছি। এই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টটি শহরের এক প্রান্তে, বেশ নিরিবিলি। খাবার টেবিলেও ভিড় নেই। আমাদের ১৯ জনের আলাদা বুফের ব্যবস্থা। ভাত, ডাল, রুটি, সব্জি আর চিকেন। সঙ্গে পায়েস। 
আলমাটি আবার ভোজনরসিকদেরও পছন্দের জায়গা। হরেক কিসিমের রেস্টুরেন্ট। মাংসের মেনুতেই খেলা বেশি। স্বাদেও রয়েছে বৈচিত্র্য। বিফ, ল্যাম্ব, চিকেন, পর্ক থেকে শুরু করে ঘোড়ার মাংসের নানা পদ। কাজাকিস্তানে হর্স ফার্ম অনেক দেখেছি। ওদের দেশে এই জন্তুর মাংস খুবই বিখ্যাত। কিন্তু আমাদের মধ্যে মহিলারা ঘোড়ার মাংস নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কের মধ্যে ছিল। পারমিতা পেশায় শিক্ষিকা। থাই-চাইনিজ-মোগলাই তার পছন্দের মেনু হলেও, ঘোড়ার মাংস নৈব নৈব চ। আমার স্ত্রী তো ভয়ে মাংসই খেতে চাইছিল না। বেচারি সোনাই আর তিতলি তো বটেই আমাদের জুনিয়র ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন মিমো কাজাক খাবার চেখে দেখতে ভীষণ উৎসুক। অবশ্য আমাদের দলে বুবুনের মতো সর্বভুক মানুষও ছিল। যে কোনও মাংসই অম্লান বদনে খেয়ে নিতে পারে। 
ভোজনপর্ব সেরে আমরা হাজির ‘কোক-টোবে’-র কেবল কার প্ল্যাটফর্মে। আলমাটি শহরের অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। খুব বেশিদিন নয়, ২০০৬ সালে চালু হওয়া আলমাটি শহরের মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় কোকটোবের অবস্থান। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১০০ ফুটের মতো। আগেই বলেছি, কাজাখস্তানের সবচেয়ে জনবহুল শহর হল আলমাটি। রোপওয়ে অর্থাৎ কেবল কারের কেবিনে বসে ওপরে ওঠার এবং নামার সময়ে ছবির মতো শহরটা দেখা যায়। পর্যটকরা মন ভরে দেখেন আর ছবি তোলেন। আমরাও তাই করছিলাম। ছ’জন করে এক একটি কেবল কারে বসতে পারে। 
কোকটোবেতে পৌঁছবার আগে থেকেই একটা বিশাল টাওয়ার চোখে পড়ে। পার্ক বানানোর অনেক আগেই এই টাওয়ার লাগায় আলমাটির প্রশাসন। টাওয়ারের কাজ ছিল রেডিও স্টেশনের সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা। তারপর তার সঙ্গে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের সম্পর্ক যুক্ত হয়। এরই পাশাপাশি পাহাড়ের চূড়ায় তৈরি হয় অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। নানা রাইড থেকে রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, সাজানো বাগানের মতো অনেক কিছুই আছে। পর্যটকরা কয়েক ঘণ্টা অনায়াসে কোকটোবেতে সময় কাটাতে পারেন। আমরাও কাটালাম। আমাদের বেঙ্গলি ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন চঞ্চল মিত্র ওরফে শম্ভুদার মোবাইলে বোধহয় হাজার খানেক ছবি জমা হল। ছবি তোলার জন্য একেবারে আইডিয়াল এই পার্ক।
সেখান থেকে কেবল কারে চেপে নেমে চলে গেলাম গ্রিন বাজারে। আলমাটি কেন, গোটা কাজাখস্তানেই এইরকম খ্যাতি কোনও মার্কেটের নেই। কিন্তু এটা ঝাঁ চকচকে শপিং মল নয়। অনেকটা কলকাতার নিউ মার্কেটের মতো। বেশ প্রাচীন ধাঁচের। ফলমূল, জামা-কাপড় থেকে মাছ-মাংস সব কিছু পাওয়া যায়। তবে গ্রিন বাজারের পর্যটকদের কাছে কদর বেশি ড্রাই ফ্রুটসের। থরে থরে সাজানো আছে আখরোট থেকে শুরু করে নানা ড্রাই ফ্রুটস। দরদাম চলে হরদম। ফিক্সড প্রাইস বলে কিছু নেই। মাংসের বাজারে গেলে তো মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ঘোড়ার মাথা, ভেড়ার ঠ্যাং, শুয়োরের জিভ, গোরুর শরীরের নানা অংশ, মুরগির মাংস ঢেলে বিকচ্ছে। সামুদ্রিক মাছেও মজে আছে বাজার। 
কাজাখস্তানের কারেন্সি নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আমাদের দেশের এক টাকার দাম ওদের সাড়ে পাঁচ টাকা। যার অনুপ্রেরণায় এই সফরে যাওয়া সেই রিণ্টু আমার ভ্রাতৃসম বন্ধু। পেশার তাগিদে ২০১৭ সাল থেকে আলমাটি যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই কানের কাছে বলত, ‘তোমরা ভ্রমণপিপাসু লোকজন, একবার আলমাটি ঘুরে এস। ভীষণ ভালো লাগবে।’ দুটি বিষয়ে রিণ্টু কিঞ্চিৎ সজাগ করেছিল। সেটা হল, ওখানে যে টাকা ভাঙাবে, তার কানাকড়িও ফেরত এনো না। কারণ, কাজাখস্তানের কারেন্সি কোনও দেশেই চলে না। আর ভাষার সমস্যা। ইংরেজি জানা লোকজন খুব কম। তবে, কাজাকরা খুবই নম্র-ভদ্র। পর্যটকদের সঙ্গে ইশারার বিনিময়ে কাজ ম্যানেজ নেয়  করে। 
কাজাখের কারেন্সিকে ‘টেঙ্গি’ বলে। শহরের সর্বত্র মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার আছে। যেকোনও কারেন্সি কাউন্টারে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে ভাঙিয়ে নেওয়া যায়। পর্যটকদের কাছে আলমাটির আকর্ষণের একটা মস্ত বড় কারণ হল, দেশটা সস্তার। অন্তত আমাদের দেশের তুলনায় তো বটেই। নামী হোটেল-রেস্টুরেন্টও আছে। সেখানে তো ফেল কড়ি, মাখ তেল। আগেভাগে বিমানের টিকিট এবং হোটেল বুকিং করলে পাঁচদিনের বেড়ানোর মাথাপিছু ৬৫-৭০ হাজার টাকায় আরামসে আলমাটি ঘুরে আসা যায়। নিজে বুক না করলে প্যাকেজেও সবকিছু ধরে এই টাকাই কম বেশি পড়বে। 
বাজারে যদি ঢোকেন আর মহিলারা যদি সঙ্গে থাকে, তাহলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যাবে, বোঝাই যায় না! তবে শহরে শুধু গ্রিন বাজার নয়, অনেক শপিং মলও আছে। সেখানে ব্র্যান্ডেড মালপত্রও পাওয়া যায়। দাম কিছুটা বেশি। ক্রেতাদের সব মার্কেটেই বিক্রেতা হিসাবে চোখ টানছে সুন্দর-সুন্দরীরা। রাশিয়ার এই অংশের মানুষজনের মধ্যে ইউরোপিয়ানদের পাশাপাশি মঙ্গোলিয়ানদের সঙ্গে স্বাস্থ্যে সাদৃশ্য আছে। মনে রাখতে হবে দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানও। এক সময়ের সোভিয়েতে যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাজ হলেও, দেশটি কিন্তু মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত। পাশেই চীন এবং কিরঘিস্তান। ভারত আর আফগানিস্তানও অবস্থান করছে আলমাটির অদূরেই। সুতরাং মিশ্র প্রভাব এই সব দেশের সঙ্গে ওদেশের মানুষের থাকাটাই স্বাভাবিক। 
ফিরে এলাম হোটেলে। সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হল। ঠান্ডাটা একটু বাড়ল। রাতে বাইরের রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের শিবির দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বিদেশে পড়াশোনা করা মিমো তো মোবাইল হাতে ধরে আলমাটির কোথায় কোন কোন রেস্টুরেন্ট আছে, কী কী খাবার পাওয়া যায়, গড়গড় করে বলে গেল। উত্তম আর ওর স্ত্রী চেষ্টা করল, দু’পক্ষের মিটমাট করতে, কিন্তু শেষরক্ষে হল না। একদল বাইরে গেল ডিনার করতে। আমরা রইলাম হোটেলেই। ওরাই প্যাক করে চিকেন রুটি নিয়ে এল। 
আজ সকালে খুব তাড়া। দূরে যাব। রাতেই হোটেলে বলা আছে, ব্রেকফাস্টের প্যাকেট সঙ্গে নেব। সাতটার মধ্যে সকলে রেডি। সবচেয়ে চনমনে আমাদের শিশু সদস্য। ছটফটে ছেলেকে সামলাতে ওর মা-বাবা হিমশিম খাচ্ছে। বাস রওনা হল। লম্বা জার্নি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হল চোখ জুড়ানো এক দৃশ্য। ককেশাস পর্বতমালা। বিমান থেকে চাঁদের আলোয় দেখেছিলাম হিন্দুকুশ পর্বত। এখন দিনের আলোয় যা দেখছি তাতেও চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সবুজ পর্বতমালার চূড়া ঢেকে রয়েছে বরফে। বাস থেকে ডানদিকে তাকিয়ে সকলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি। সকলের চোখ দিগন্ত বিস্তৃত বরফের পাহাড়ে। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে আমাদের সঙ্গে চলেছে ককেশাস। পর্বতের এই পর্ব শেষ হল, বাস অন্যপথে ঘোরার পর। কাজাখস্তানের প্রকৃতি যে কত সুন্দর, এই দৃশ্যের পর আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। শীতকালে গোটা অঞ্চল বরফের চাদরে মোড়া থাকে।
দেড় ঘণ্টা চলার পর টি-ব্রেক। বাস যেখানে দাঁড়াল, জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। একটা কফি শপ রয়েছে। চা-কফির সঙ্গে স্ন্যাকসও পাওয়া যাচ্ছে। প্যাকেটের ব্রেকফাস্ট বাসে খাওয়া হয়ে গেলেও, একটু যেন খিদে খিদে পাচ্ছে। শুভাশিস আর ওর স্ত্রী তো বড় সাইজের পাউরুটির অর্ডার দিল। দারুণ টেস্ট। সঙ্গে কফি। চা-ও পাওয়া যাচ্ছে। স্ন্যাক্সে ভেজ, ননভেজ স্যান্ডউইচের পাশাপাশি রান্না খাবারও দেওয়া হচ্ছে। বুবুন তো কিচেনের সামনে নিয়ে গিয়ে আমাদের দেখাল, ঘোড়ার মাংসের নানা পদ অর্ধেকটা রান্না করে সাজিয়ে রাখা আছে। 
আরও দেড় ঘণ্টা চলার পর আমরা পৌঁছলাম কোলসাই লেকের সামনে। আলমাটি থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরত্ব। আসার পথে ককেশাস পর্বতমালার সঙ্গে কাজাখস্তানের গ্রামাঞ্চল দর্শন করতে করতে এসেছি। সুইজারল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ডে চাষবাস যেমন গোছানো, এখানে তা একদমই নয়। বেশিরভাগ জমি অনাবাদি হিসাবেই, অনাদরে পড়ে আছে। আপেলের সঙ্গে অন্যান্য ফলমূলের বাগান বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়েছে। ভেড়ার পাল নিয়ে রাখাল বালকদের অনেক জায়গাতেই দেখেছি। হর্স ফার্মও রয়েছে। দল বেঁধে ঘোড়া চরছে। পাহাড়ের কোলে কোথাও কোথাও মরুভূমির উপস্থিতিও টের পেয়েছি। 
কোলসাই লেকের দৃশ্য নয়নাভিরাম। নীল জলের মধ্যে গাছপালাও রয়েছে। কাজাখস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে এইরকম হ্রদ অর্থাৎ লেক রয়েছে অনেক। আর এইসব লেক তৈরি হয়েছে ভূমিকম্পের ফলে। ওই যে বললাম লেকের জলের তলায় গাছপালা, সেটাই প্রমাণ করে ভূমিকম্পই প্রকৃতির এই রূপ তৈরি করেছে। মনে রাখতে হবে, কাজাখস্তান হল ‘ল্যান্ড লকড কান্ট্রি’ অর্থাৎ স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। যে দেশের কোনও জলসীমা নেই। যার অর্থ, ও দেশের লাগোয়া কোনও সমুদ্র কিংবা নদী সীমা নেই। পৃথিবীতে এই রকম রাষ্ট্রের সংখ্যা ৪৪। 
কোলসাই লেক দেখে ছবি তুলে, আমরা তাঁবুর রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। ড্রাই খিচুড়ির মতো একটা খাবার। সঙ্গে স্যালাড। বেশ সুস্বাদু আহার। সেখানে আবার উটের দুধও বিক্রি হচ্ছে। মধ্যাহ্নভোজ সেরে ক্যানিয়ন লেক দেখতে গেলাম বাসে চেপে। ৯৬ মাইল জুড়ে লেকটির বিস্তার। পাহাড়ের খাদে ক্যানিয়নেরও দুর্লভ দৃশ্য। শহরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সময় হাতে নিয়ে জর্জিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার সারতে গেলাম। নিমোর অর্ডারে সোনাই এবং তিতলি মাংসের নানা পদের অর্ডার দিলেও, আমাদের মেনুতে চিকেনের সঙ্গে পাউরুটি সকলে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। অমলদা বলল, ‘শম্ভু তো দেখছি এদেশে এসে পুরোপুরি নিরামিষভোজী হয়ে গিয়েছে। ঘোড়ার মাংসের ভয়েই কী?’ খাবার টেবিলে সকলে হেসে উঠল। 
এই ক’দিন বরফ দেখেছি দূর থেকে, আজ আমাদের পর্বত অভিযান অন্যরকম। হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেলা দশটা নাগাদ রওনা। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই সুন্দর সাজানো রাস্তা। মিনিট ২০ যেতেই দেখলাম বেশ কয়েকটি সুপার লাক্সারি হোটেল এবং রিসর্ট। গাইড ডিওর জানাল, ‘পয়সাওয়ালা লোকেরা শহরের বাইরে নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করে। তাছাড়া, যখন খুব বরফ পড়ে তখন এইসব এলাকা সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যকেও হার মানায়।’
কথাটা যে অসত্য নয়, খানিকটা আঁচ পেলাম গন্তব্যে পৌঁছে। কাছেই বাস থামল। ফাঁকা জায়গা। চারদিকে পাহাড়। হাওয়া বেশ ঠান্ডা। আসলে পাহাড়ের মাথায় তো বরফ ভর্তি। আর আমরা রয়েছি অনেকটা উঁচুতেই। রোপওয়ে চড়ে উঠতে হবে উপরে। পৌঁছে যাব বরফের দেশে। কিন্তু আমাদের ভাগ্য খারাপ। স্যামবুলাকের রোপওয়ে লাইন মেরামতি চলছে, কেবল কার ওঠানামা বন্ধ। স্বভাবতই আমরা কিছুটা মুষড়ে পড়লাম। 
ডিওর বলল, ‘ঘাবড়াবেন না, চলুন অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।’ আবার বাসে উঠে ঘণ্টাখানেকের জার্নি। পৌঁছে গেলাম এক-বুলাক নামের আর এক পাহাড়ি অঞ্চলে। বাস থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে রোপওয়ে ডেস্টিনেশন। ছ’জন করে যাত্রীকে কেবল কার উপরে নিয়ে যাচ্ছে। একটা স্তর পেরিয়ে অন্য কেবল কারে দুজনের আসন। তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যে ধরনের উন্নত মানের কেবল কারে চেপেছি, আলমাটির অভিজ্ঞতা ততটা ভালো নয়। বিদেশে রোপওয়ে স্টেশনে যেমন থাকে কফি শপ, টয়লেট এসব এখানে তেমন নেই। 
কিন্তু রোপওয়েতে উঠতে উঠতে যে দৃশ্য চারদিকে দেখেছি তা এক কথায় সৌন্দর্যের অন্য এক রূপময়তা। নয়নাভিরাম। বরফের পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। ঢালে অপূর্ব সবুজের সমারোহ। কোথাও কোথাও পাহাড়ের গায়ে কার্পেটের মতো ঘাস। চূড়ায় পৌঁছে ঠান্ডা হাওয়ার ঠেলায় প্রায় সকলেই কাঁপছে। আসলে আমার মতো দু’একজন ছাড়া জাঁকালো শীতবস্ত্র অন্যেরা কেউ আনেইনি। তারা সব ফ্যাশনের গরম পোশাক পরেছে। তাই খুব বেশিক্ষণ বরফের হাওয়া খাওয়া হল না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফেরার বেল বেজে গেল। 
আলমাটি থেকে বরফের মধ্যে ঢুকে পড়ার দুটি স্পট রয়েছে। যেখানে আমরা গিয়েও ফিরে এলাম, সেই স্যামবুলাকে রোপওয়ের তিনটি স্তর। ভাড়া জনপ্রতি ১৪ মার্কিন ডলার। আর একবুলাকে কেবল কার নিয়ে যাচ্ছে দুটি স্তরে। ভাড়া কম, ৮ মার্কিন ডলার। রাস্তার দু’ধারে সবুজের মেলা আর পাহাড় দেখতে দেখতে ফিরে এলাম শহরে। 
আজ কিন্তু সূয্যিমামা সকাল থেকে মেঘের আড়ালে মুখ ঢেকেছে। আমরা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারলাম। শহরে একটু ঘোরাঘুরির পর, কয়েকজন মার্কেটিং করতে চলে গেল। আমরা হোটেলে আড্ডা জমালাম। একজন ইংরেজি জানা ওয়েটার অনেক গল্প বলছিলেন। ওর মুখেই কাজাখস্তানের কমিউনিস্ট আমলের নানা কীর্তি কাহিনি শুনছিলাম। আলমাটি অঞ্চলে কমিউনিস্ট শাসক জোসেফ স্ট্যালিনের নির্দেশে, ট্রটস্কিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। ১৯২৮ সালের ৩১ জানুয়ারি সস্ত্রীক স্ট্রটস্কি নির্বাসনের জীবন কাটাতে ওই অঞ্চলে চলে আসেন। 
সফর শেষে ফেরার পর্বে যে দুর্ভোগ এবং সুখভোগের মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেটা না বললে আলমাটির উপাখ্যান অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ‘রেমেল ঝড়’ নিয়ে বাংলায় দুর্যোগের আশঙ্কার নানা আগাম খবর আমাদের কানে আসছিল। অবশেষে খবর এল, আগামীকাল সকাল থেকে পরশু সকাল পর্যন্ত দমদমে সমস্ত বিমান অবতরণ বন্ধ থাকবে। আলমাটির আনন্দ মাটি হয়ে যেতে বসল। আমরা বললাম, ‘এখন ঠাকুরকে ডাকা ছাড়া আর উপায় কী?’ 
আমাদের দুবাই হয়ে কলকাতার ফ্লাইট। ফ্লাই দুবাই গভীর রাতে জানিয়ে দিল, দুবাই থেকে কলকাতার ফ্লাইট রি-সিডিউল হয়েছে। পরশু যাবে ফ্লাইট। কাল ভোরেই তো আমাদের দুবাই পৌঁছে যাওয়ার কথা। তাহলে একদিন কোথায় থাকা হবে? 
রাখে হরি মারে কে! ঠাকুরের নাম জপতেই বোধহয় কাজ হয়েছে। সকাল সাতটার পর আলমাটি থেকে ৪ ঘণ্টা জার্নি করে এসে দুবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। সকলের মনে উদ্বেগ কাজ করছে। সোজা ফ্লাইট কোম্পানির ডেস্কে গিয়ে আমাদের অসহায় অবস্থার কথা জানালাম। ওরা আমাদের অপেক্ষা করতে বললেন। আমি আর আমার স্ত্রী আগেও চারবার দুবাই এসেছি। আর একটি পরিবার ছাড়া কেউ আগে দুবাই দেখেনি। তারা তো বিমানবন্দরের সাজসজ্জা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষার পর সুসংবাদ শোনাল ফ্লাই দুবাইয়ের সার্ভিস ডেস্ক। একদিনের জন্য দুবাই এয়ারপোর্টে যে বিলাসবহুল ইন্টারন্যাশনাল হোটেল আছে, সেখানেই সকলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সব পরিবারের জন্য একটি করে ডিলাক্স ডবল বেডের রুম। থাকার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। এ খবর শুনে সকলের মন রিমেলের আতঙ্ক সরিয়ে আনন্দে মেতে উঠল। যারা দুবাই দেখেনি তারা তো সারাদিন শহর দেখা, সন্ধ্যায় বুর্জ খালিফার লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, দুবাই মল ঘোরার মতো সব দর্শনই সেরে ফেলল। আমরা বেজায় আনন্দে ফ্রিতে একটা দিন দুবাইয়ে কাটিয়ে নিরাপদে কলকাতায় ফিরে এলাম।
ছবি: লেখক
12d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা