সাধারণত ল্যান্ডলাইনে আজকাল আর তেমন ফোন আসে না। তবুও সুবিনয় কানেকশনটা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন, আছে যখন থাক এই ভেবে। আজকের কলটা যদিও ল্যান্ড লাইনেই এল। ওপাশ থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর জানতে চাইলেন, ‘আমি কি সুবিনয় বসুর সঙ্গে কথা বলছি?’ সুবিনয় উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, বলছি। আপনি?’ কণ্ঠস্বর যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক, অবশেষে তোমাকে পাওয়া গেল! কারও সঙ্গে তো তোমার কোনও যোগাযোগই নেই। ভাগ্যিস বিপুলের একটা পুরনো ডায়েরিতে এই নম্বরটা ছিল। তাই পেলাম। আমি প্রণব বলছি। প্রণব চাকলাদার। কবিগুরু বিদ্যালয়ের নব্বইয়ের হায়ার সেকেন্ডারির ব্যাচ। সুবর্ণপুর। চিনতে পারছ?’
সত্যি কথা বলতে স্কুল আর জায়গার নাম সুবিনয়ের চেনা হলেও যে তাঁকে ফোন করেছে এই মুহূর্তে তার মুখটা মনে করতে পারলেন না তিনি। মাঝে তেত্রিশ বছরের ব্যবধান। তবুও ভদ্রতাবশত তিনি বললেন, ‘চিনব না কেন? আমিও তো ওই ব্যাচেরই। কেমন আছ?’
‘ভালোই আছি।’ জানালেন তিনি।
সুবিনয় কিছুটা ইতস্তত করে আবারও বললেন, ‘তা এতদিন পর হঠাৎ?’
তাঁর একদা সহপাঠী বললেন, ‘একটি ব্যাপারে আমন্ত্রণ জানাতে ফোন করলাম। আগামী রবিবার একটা রিইউনিয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের নব্বইয়ের ব্যাচের সবাইকে নিয়ে। অর্ঘ্যকে তোমার মনে আছে? যে জার্মানিতে থাকে। ও এক মাসের জন্য এখানে এসেছে। মূলত ওর উদ্যোগেই এই আয়োজন। ওর দেওয়া ডোনেশনে স্কুলে একটা লাইব্রেরি রুম হয়েছে। সেটারও উদ্বোধন হবে ওই দিন। তুমি হয়তো বিখ্যাত সাহিত্যিক পরিচয় গুপ্তের নাম শুনে থাকবে। যাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস নিয়ে সিনেমা-সিরিয়াল হয়। অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। তাঁরও আসার কথা ওই লাইব্রেরি উদ্বোধনের জন্য। লাইব্রেরি উদ্বোধন, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়া সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার হবে। তাই তোমার নিমন্ত্রণ রইল।’ একটানা কথাগুলো বলে থামল সে।
এ আমন্ত্রণ ইতিপূর্বে আরও একজনের কাছ থেকে পেয়েছেন সুবিনয়। খানিক চুপ থেকে তিনি জানতে চাইলেন, ‘ওখানে গিয়ে আমাকে কী করতে হবে?’
এ প্রশ্ন শুনে ওপাশের জন ভাবলেন হয়তো বা সুবিনয় জানতে চাইলেন যে তাকে রিইউনিয়নের জন্য কোনও টাকা-পয়সা দিতে হবে কি না। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সুবিনয়কে আশ্বস্ত করতে বলে উঠলেন, ‘না না টাকা পয়সার কোনও ব্যাপার নেই। অনুষ্ঠানের লায়ন শেয়ারটা অর্ঘ্যই দিচ্ছে। বাকি খুচরো খরচ আমরা কয়েকজন মিলে সামলে নেব। ওসব নিয়ে তুমি একদম ভেব না। ওই দিন বেলা এগারোটায় স্কুলে চলে এস। তারপর অনুষ্ঠান দেখে, লাঞ্চ সেরে, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি ফিরবে।’
‘টাকা পয়সা দিতে হবে না’ এ কথাটা যেন বেশ জোর দিয়েই বললেন প্রণব। হয়তো বা তিনি বা তাঁদের অন্য সহপাঠীরা শেষ যেভাবে সুবিনয়কে দেখেছেন তা মনে রেখে। কোম্পানি লক আউট হওয়াতে সুবিনয়ের বাবার তখন কোনও কাজ নেই। বাজারে তাঁর বিস্তর দেনা। সংসার চালানো দায়। কলেজে ভর্তি হয়েও সেদিন পড়া ছেড়ে দোকানে খাতা লেখার কাজ নিয়েছিলেন সুবিনয়। তাঁদের সেদিনের দুরবস্থার কথা হয়তো আজও স্মরণে আছে প্রণবদের। তারপর একদিন সুবর্ণপুরের পাট চুকিয়ে কলকাতার একটি বস্তিতে সপরিবারে উঠে এসেছিলেন তাঁরা। মাঝে কেটে গেছে আরও তেত্রিশ বছর। সুবিনয় বা তাঁর সহপাঠীরা, কোনও পক্ষই আর অপরপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। সুবিনয় রাখেননি হয়তো বা কিছুটা অভিমান বা ক্ষোভে। কারণ তাঁদের সেই প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের দিনগুলিতে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল একদা বাল্যবন্ধু, সহপাঠীরা। আর অপরপক্ষ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি, পাছে দুঃস্থ বন্ধুকে অর্থ সাহায্য করতে হয় সে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে। তাছাড়া অবশ্য দূরত্বও যোগাযোগহীনতার একটি অন্যতম কারণ। কলকাতা থেকে মফস্সল শহর সুবর্ণপুরের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। এত বছর পর সেই সুবর্ণপুর থেকেই আমন্ত্রণ এল।
সুবিনয় বললেন, ‘ভালো লাগল আমন্ত্রণ পেয়ে। দেখি কী করি!’
প্রণব বললেন, ‘দেখি নয়। আসতেই হবে। অর্ঘ্য চাইছে সবাই উপস্থিত থাকুক। জানো তো দেশে-বিদেশে ওর অনেক বড় বড় কানেকশন। তোমার কোনও কাজে লেগেও যেতে পারে। চলে এস। রবিবার দেখা হচ্ছে। এবার রাখছি।’ একথা বলে সুবিনয়কে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলেন তাঁর তেত্রিশ বছরের পুরনো সহপাঠী।
দুই
সুবিনয় প্রথমে ভেবেছিলেন এ আমন্ত্রণে তিনি সাড়া দেবেন না। এত বছর যাঁরা দুঃস্থ বন্ধুর কোনও খোঁজখবর রাখেননি তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে কী লাভ। কিন্তু তারপরই সেই চাপা অভিমান কাটিয়ে তাঁর মনে ভেসে উঠেছিল স্কুলটাকে কেন্দ্র করে শৈশব, কৈশোরের সুন্দর অমলিন স্মৃতিগুলো। তাঁর আরও মনে হল, তাঁর সহপাঠীরাও এখন তাঁরই মতো প্রৌঢ়। শুধুমাত্র বয়স নয়, হয়তো তাদের মনেরও পরিবর্তন হয়েছে এত বছরে। বন্ধু-সহপাঠীর কোনও বিপদ হলে হয়তো আজ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন তাঁরা। বেলা যে পড়ে এল। আজ আর বুকে অভিমান জমিয়ে রেখে লাভ কী? একবার গিয়ে দেখেই আসা যাক সবাই কেমন আছে। তাই শেষ পর্যন্ত সুবর্ণপুর যাওয়ার জন্য কলকাতা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন তিনি।
তেত্রিশ বছর পর আবারও এ শহরের বুকে পা রাখলেন সুবিনয়। অনেক বদলে গেছে চারপাশ। ফাঁকা জমি প্রায় নেই আর। বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি মাথা তুলেছে ইতস্তত। ট্রেন থেকে নেমে স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে এক সময় বাল্যকালের তপোবন কবিগুরু বালক বিদ্যালয়ের সামনে রিকশ থেকে নামলেন তিনি। পরনে তাঁর সাধারণ পোশাক। পাজামা পাঞ্জাবি, আর চপ্পল। স্কুল গেটের সামনে একটা তোরণ বানানো হয়েছে ফুল দিয়ে। গেটের সামনেই দু’জন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। গলা শুনে সেদিন চিনতে না পারলেও প্রণবকে আজ দেখেই চিনতে পারলেন সুবিনয়। তাঁর পাশের জনকেও চিনলেন। অক্ষয়। সেও এই স্কুলেরই নব্বইয়ের ব্যাচের। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে তাঁদের দু’জনেরই পরনে বেশি দামি পোশাক। অথবা এমনই দামি পোশাক পরেন তাঁরা। প্রণবও চিনলেন তাঁকে। এগিয়ে এসে বললেন, ‘ওঃ। কত বছর পর দেখা তোমার সঙ্গে। একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে। যাও যাও ভিতরে যাও। স্টাফরুম খোলা হয়েছে। অর্ঘ্য সেখানেই আছে। আরও বেশ কয়েকজনও আছে সেখানে। আগে সেখানে গিয়ে একবার দেখা করে এস। এরপর আবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিছুক্ষণের ভিতরই প্রধান অতিথি পরিচয় গুপ্তও চলে আসবেন।’ এ কথা বলে সদ্য আসা একটি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন প্রণব। তা দেখে সুবিনয় অনুমান করলেন প্রণবকেই আজ এই অনুষ্ঠানের অনেক কিছু সামলাতে হচ্ছে।
স্কুলের ভিতর পা রাখলেন সুবিনয়। মফস্সলে ছোট সরকারি স্কুলটি আজও প্রায় একইরকম আছে। তবে ছোট মাঠটার একপাশে একটা নতুন বিল্ডিং হয়েছে। তার সামনে একটা ছোট মঞ্চও আছে। সেখানে একটা ব্যানারে লেখা ‘স্বাগতম সাহিত্যিক পরিচয় গুপ্ত।’ বারান্দায় উঠে শিক্ষকদের বসার ঘর বা স্টাফরুমে প্রবেশ করে সুবিনয় দেখতে পেলেন একটা সোফায় বসে আছে অর্ঘ্য। তাঁকে ঘিরে অন্য আরও বেশ কয়েকজন সহপাঠী। বিনয়, সুভাষ, কার্তিক আর মলয়। কিছু সুবেশি মহিলাও আছেন সেখানে। তাঁদের পরিবারের লোকজন। অর্ঘ্য কিছু বলছিলেন আর তাঁর কথা মন দিয়ে শুনছিলেন সবাই। সুবিনয় ঘরে ঢোকায় মৃদু ছন্দপতন হল যেন। কথা থেমে গেল। বিনয় তাঁকে চিনতে পেরে বললেন, ‘আরে সুবিনয় যে। তুই এসেছিস। খুব ভালো লাগল তোকে দেখে।’ এ কথা শুনে সোফায় বসা স্যুট-টাই পরা অর্ঘ্য রিমলেস চশমার ভিতর দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুবিনয়! আমি তো তোমাকে রাস্তায় দেখলে চিনতেই পারতাম না। মাথার চুল তো প্রায় সবই সাদা হয়ে গেছে দেখছি। তা তুমি কী কর এখন?’
সুবিনয় মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ‘তেমন কিছু নয়।’
অর্ঘ্য বললেন, ‘দুপুরের লাঞ্চের প্যাকেটের জন্য কুপন আছে। পাশের ঘর থেকে নিয়ে নিও কিন্তু।’ এই বলে তিনি আর সুবিনয়ের সঙ্গে কথা না বলে ঘরে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে বলতে লাগলেন, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ও দেশে আমি যেখানে থাকি সেখানে কোনও গরিব নেই...।’
সুবিনয়কে সেখানে কেউ বসতে বলল না। তাঁর সহপাঠীদের ভাবখানা এমন, যেন তাঁরা সুবিনয়কে বলছেন তুমি এখানে থাকতেও পার আবার নাও থাকতে পার। আসলে সবাই অর্ঘ্যকে নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই নিতান্ত অপাঙ্ক্তেয়র মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হল না সুবিনয়ের। তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
তিন
তারপর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন স্কুলের ভিতরে। কতই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মাঠে, ওই সার সার বন্ধ ঘরগুলির ভিতর। তাঁর একবার ইচ্ছে হল ক্লাসরুমগুলির ভিতর ঢুকে দেখেন। কিন্তু সেগুলি সব তালাবন্ধ। তাই ইচ্ছেপূরণ হল না। খোঁজ নিয়ে জানলেন এদিন কোনও ছাত্র উপস্থিত থাকবে না। আজকের অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুমাত্র আমন্ত্রিতদের ভিতর। কিছুক্ষণ ইতিউতি ঘুরে স্মৃতি রোমন্থন করার পর সুবিনয় আবারও এসে দাঁড়ালেন গেটের কাছটিতে। প্রণব দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অর্ঘ্যর সঙ্গে দেখা করে এলে নিশ্চয়ই? আমি তো এ জায়গা থেকে নড়তেই পারছি না। পরিচয়বাবু চলে আসবেন যে কোনও সময়।’
একথা বলার পর কিছুটা স্বগোক্তির স্বরে বললেন, ‘মাইকে একবার অ্যানাউন্স করে দিতে হবে। ওঁর সঙ্গে সেলফি তোলা নট অ্যালাউড।’
‘নট অ্যালাউড কেন?’ পাশে দাঁড়ানো অক্ষয় কথাটা জিজ্ঞাসা করতেই প্রণব তাকে মৃদু ধমকের সঙ্গে বললেন, ‘কেন তুই সেদিন বলিসনি উনি নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না। ছবি তোলেন না তাই কোথাও। বইমেলা বা কোনও সভা সমিতিতে যান না। এমনকী ‘পরিচয় গুপ্ত’ নামটাও তাঁর ছদ্মনাম। নেহাতই তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে কোনও একটা চ্যানেলে অর্ঘ্য যোগাযোগ করেছে। সেই প্রকাশক ভদ্রলোকই তাঁকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছেন এখানে আসার জন্য। অর্ঘ্যর সঙ্গেই তিনি হয়তো শুধুমাত্র ছবি তুলবেন।’
সময় এগিয়ে চলে। অর্ঘ্য তাঁর বন্ধু ও বন্ধুপত্নীদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে মাঠে এসে দাঁড়ালেন। আরও অনেকে সে স্থানে প্রবেশ করছে। তাদের কেউ কেউ সুবিনয়ের চেনা মনে হলেও অনেকেই অচেনা। এই তেত্রিশ বছরে অনেকেরই শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় যার মাথায় কোঁকড়া চুল ছিল, আজ তার মাথা জোড়া টাক। সেদিনের ছিপছিপে কোনও তরুণ আজ বিপুলাকার। তাঁরাও কেউ চিনতে পারছেন তাঁকে, কেউ পারছেন না। যাঁরা পারছেন তাঁরা এগিয়ে এসে দু-একটা কথাও বলছেন তাঁর সঙ্গে। চারপাশ দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার খেয়াল করলেন সুবিনয়। তাঁর সেদিনের সহপাঠীরা আজ দুটি দলে বিভক্ত। একদল যাঁরা আজ সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁরা অর্ঘ্যর সান্নিধ্য উপভোগ করছেন। আর অন্য দলটি কেমন যেন বিবর্ণ পোশাকে মলিন হয়ে আছেন। রবাহুত হয়েও অনাহুতর মতোই ইতিউতি দাঁড়িয়ে আছেন প্রথম দলের সঙ্গে সম্ভ্রমের দূরত্ব বজায় রেখে। অভিজাত বন্ধুরা যেন তাঁদের দেখতেই পাচ্ছেন না। তাঁরা ব্যস্ত অর্ঘ্য বন্দনায় আর বিখ্যাত লেখকের প্রতীক্ষায়।
হঠাৎই এক শীর্ণ চেহারার লোক একটি বছর বারো-তেরোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। তাদের অতি সাধারণ পোশাক দেখে সুবিনয় অনুমান করলেন তারা দ্বিতীয় শ্রেণির অভ্যাগত। লোকটা সুবিনয়ের উদ্দেশে বলল, ‘আরে তুই সুবিনয় না? কত বছর পর তোর সঙ্গে দেখা হল।’ এই বলে সে তার হাত দুটি জড়িয়ে ধরল। সুবিনয়ও চিনতে পারলেন তাকে। হরেন! তাঁর ঠিক পিছনের বেঞ্চেই বসত একসময়। হরেন এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কলকাতায় থাকিস তাই না? একা এসেছিস নাকি সপরিবারে?’
সুবিনয় জবাব দিলেন, ‘একারই নিমন্ত্রণ। একাই এসেছি।’
হরেন বলল, ‘আমারও তাই। যাইহোক তুই চিনতে পারলি। অনেকে তো দেখছি চিনতেই পারছে না। বড় বড় ব্যাপার সব। ভেবেছিলাম আসব না। কিন্তু ছেলেটার জন্য আসতে হল। লেখক পরিচয় গুপ্তকে দেখবে বলে এসেছে। ওঁর লেখার বড় ভক্ত ও। একটা বইও সঙ্গে এনেছে। যদি উনি তাতে একটি সই করে দেন।’ এরপর ছেলের উদ্দেশে সে বলে, ‘কাকুকে প্রণাম কর।’ সঙ্গে আনা বইটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ঝুঁকে সুবিনয়কে প্রণাম করল ছেলেটা। সুবিনয় তাকে বললেন, ‘কী নাম তোমার? তুমি বুঝি বই পড়তে খুব ভালোবাসো? কী কী বই পড়েছ?’
সে উত্তর দিল, ‘আমার নাম আকাঙ্ক্ষা।’ এরপর সে গড়গড় করে পরিচয় গুপ্তর লেখা বেশ কয়েকটি বই-এর নাম বলে দিল। হরেন এবার সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘ভাই তোরা দু’জন কথা বল। আমি এখন আসি। এখানে মোড়ের মাথায় আমার একটা চায়ের দোকান আছে। সেটা ফেলে এসেছি। রবিবারের বাজার। এখন না গেলে লোকসান হয়ে যাবে অনেক।’ সুবিনয় বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যাও। আমরা দু’জন গল্প করি।’
ঘড়ির কাঁটা এগয়। দুপুরের চড়া রোদ থেকে বাঁচতে ছেলেটিকে নিয়ে বারান্দায় উঠে আসেন তিনি। কাছে পিঠে অনেক লোকজন এদিকে-ওদিকে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠিকই, কিন্তু তাঁরা যেন কেউ খেয়ালই করছেন না তাঁদের। তাঁরা সবাই অপেক্ষা করছেন বিখ্যাত সাহিত্যিকের আগমনের আর অর্ঘ্যর সান্নিধ্যের। এসব দেখে সুবিনয় অনুভব করলেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবও যেন বৃদ্ধি পেয়েছে। সবাই ব্যস্ত লাভ ক্ষতির অঙ্ক কষতে। পুনর্মিলন উৎসবে মিলনের পরিবর্তে বিচ্ছেদ, বিভাজনটাই যেন প্রবলভাবে ধরা দিচ্ছে তাঁর চোখে। এত বছর পর একত্রিত হয়েও কার সঙ্গে কথা বললে বা যোগাযোগ রাখলে ভবিষ্যতে লাভের সম্ভাবনা আছে সে হিসেব করেই সঙ্গী নির্বাচন করে কথা বলছেন সকলে। সুবিনয় আবারও ভাবলেন এখানে না এলে তিনি বুঝতেই পারতেন না তাঁর একদা সহপাঠীদের মনস্তত্ত্ব। ব্যাপারটা পরে কাজে লাগবে তাঁর। বারান্দার একপাশে রাখা একটি বেঞ্চে বসে এক সময় তিনি ছেলেটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?’
আকাঙ্ক্ষা নামের ছেলেটি উত্তর দেয় ‘লেখক হতে চাই’।
জবাব শুনে সুবিনয় বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন, ‘কেন, লেখক হতে চাও কেন?’
আকাঙ্ক্ষা বলল, ‘শুনেছি, লেখকরা নাকি বড়লোক-গরিব লোক ভেদাভেদ করেন না। সবাই সমান তাদের চোখে। তাইতো তাঁরা গরিবের মনের কথাও লিখতে পারেন অনায়াসে। যেমন পরিচয় গুপ্ত লেখেন।’ সুবিনয় আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু লেখক হয়ে কী হবে? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হলে তো অনেক টাকা হবে।’ এবার একটু চুপ থেকে আকাঙ্ক্ষা বলল, ‘তা হয়তো হবে। কিন্তু পরিচয় গুপ্ত’র মতো লেখক হলে হয়তো আমিও আমার লেখার মাধ্যমে গরিব-বড়লোকের পার্থক্য মুছে দিতে পারব।’ সুবিনয় এবার বেশ অবাক হলেন তার কথা শুনে। ছোট ছেলেটির চোখেও কি তবে ধরা পড়ে গেছে তাদের চারপাশের এই বিভাজন? সত্যিই কি লেখকরা পারেন এই বিভাজন দূর করতে? অর্থ আর ক্ষমতার জোর সর্বস্ব পৃথিবীতে একজন লেখকের ক্ষমতাই বা কতটুকু? ভাবতে লাগলেন তিনি। সময় এগিয়ে চলে।
এক সময় মাইকে ঘোষণা হয়, ‘প্রধান অতিথির বিশেষ কারণবশত আসতে বিলম্ব হচ্ছে। আমাদের দুপুরের খাবার রেডি। আপনারা একে একে এসে সেটি গ্রহণ করুন। তারপর সাহিত্যিক এলেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করব আমরা।’
ঘোষণা শুনে পরিচয় গুপ্তর বইটি সুবিনয়ের হাতে দিয়ে আকাঙ্ক্ষা বলল, ‘তুমি বইটা নিয়ে একটু বস কাকু, আমি আসছি।’ এই বলে সে চলে গেল। বইটা খুললেন সুবিনয়। সেখানে লেখকের কোনও ছবি বা পরিচয়পত্র নেই। শুধু ‘পরিচয় গুপ্ত’ নামে একটি ফ্লেক্সিমিলি সই ছাপানো আছে উপহার লেখার পাতায়।
চার
কিছুক্ষণ পর একটি বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে ফিরে এল আকাঙ্ক্ষা। সেটা সে সুবিনয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও, এটা তুমি খাও। অনেক দূর থেকে এসেছ, তোমার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?’ সুবিনয় বললেন, ‘তোমার প্যাকেট কই? তুমি খাবে না?’
আকাঙ্ক্ষা বলল, ‘আমার কাছে তো একটাই কুপন ছিল। এখানে এসে বাবার সঙ্গে যখন খাবারের কুপন নিতে গেছিলাম তখন ওরা বাবাকে বলল তোমার তো ফ্যামিলি নিমন্ত্রিত নয়, একারই নিমন্ত্রণ। তাই একটাই কুপন। সেটা দিয়েই প্যাকেটটা পেলাম। তবে অনেকেরই বাড়ির লোক এসেছে দেখলাম। তারা কুপন পেয়ে খাবারও নিচ্ছে।’
সুবিনয় তাও বললেন, ‘তুমি আমাকে প্যাকেটটা দিচ্ছ, তুমি খাবে না?’
সে বলল, ‘ও নিয়ে তুমি ভেব না। মা আজ ল্যাটা মাছ দিয়ে ভাত রেঁধেছে। আমি বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেব।’ তার এ কথা শোনার পর ও সুবিনয় প্যাকেটটা না নেওয়ায়, সে সুবিনয়কে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘আর আমি তো বিরিয়ানি খেতে আসিনি। এসেছি পরিচয় গুপ্তকে দেখতে। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে একটি সই দেবেন। গরিব বলে আমাকে ফেরাবেন না, তাই না?’ আকাঙ্ক্ষার কথাগুলো শোনার পর কিছুক্ষণ তার দিকে বিস্মিতভাবে চেয়ে রইলেন সুবিনয়। তাঁর মনে হল চারপাশের এই বিরিয়ানির গন্ধ মাখা পৃথিবীতে এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। এই আকাঙ্ক্ষার মতো ছেলেরাই হয়তো ভবিষ্যতের পৃথিবীকে ভেদাভেদমুক্ত, স্বার্থমুক্ত করবে একদিন। সুবিনয় পকেট থেকে কলম বের করে বইটা খুলে উপহারের পাতায় পর পর দুটো সই করলেন। নিজের মোবাইল নম্বরটাও লিখে দিলেন তার সঙ্গে। তারপর সেটা ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাবাকে বল আমায় ফোন করতে। একদিন তোমাদের বাড়িতে ল্যাটা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে আসব।’
বাচ্চা ছেলেটা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বিস্ফারিত চোখে সে চেয়ে আছে বইয়ের পাতায়। সুবিনয়ের স্বাক্ষর দুটির দিকে। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগালেন তিনি। চারপাশের স্বার্থপর মানুষগুলোর কাছে ধরা পড়ে যান পাছে, এই ভেবে দ্রুত স্কুল গেট দিয়ে বাড়ির পথে এগিয়ে চললেন সুবিনয় বসু ওরফে পরিচয় গুপ্ত।
অলঙ্করণ : সুব্রত মাজী