অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই আজ বেরিয়ে পড়েছিল চিরঞ্জিত। টাওয়ার-বাইশের লাউঞ্জে ঢুকে সিকিউরিটির সেলাম পেরতেই প্রশস্ত লবির একটা জানালার নীচে চোখ পড়ে গেল ওর। সুদৃশ্য মাটির প্লেটে বাহারি একটা বনসাই রাখা। একটু থেমে কাছাকাছি এসে অনেকক্ষণ ধরে গাছটাকে পর্যবেক্ষণ করল ও। কাণ্ড-উপকাণ্ড-ঝুরিদের বিস্তারে ছোট্ট একটা বটগাছের অবয়ব। কচি-কচি সবুজ পাতায় খর্বাকৃতি এ মহীরুহ সত্যি শোভা বাড়িয়ে তুলেছে লাউঞ্জটির। খানিকটা ঔৎসুক্য নিয়ে বনসাইটিকে স্পর্শ করতেই পেছন থেকে নাইট-শিফটের বাঙালি গার্ড প্রলয় বলল, ‘স্যর, টুয়েলভ-ডি-র মিসেস ভট্টাচার্যের বাড়িতে ছিল এটা। দশদিন আগে মারা গেছেন উনি। আমিই ফ্ল্যাট থেকে এনে এখানে রেখেছি বনসাইটি। ’
‘কেন বাড়িতে কেউ ছিল না ওনার?’ একটু বিস্ময় নিয়ে প্রশ্নটা করল চিরঞ্জিত।
‘না, মাসিমা একাই থাকতেন। তিন শিফটে আয়া ছিল। এছাড়া এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় অরূপদা এসে মাঝেমধ্যে দেখভাল করে যেতেন।’
‘কেন ওনার স্বামী বা ছেলেমেয়ে কেউ—’ একটু বিমর্ষ ভঙ্গিতে কথাটা বলল চিরঞ্জিত।
‘স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। এক ছেলে-এক মেয়ে। দু’জনেই বিদেশে থাকে। শেষ দিকে ক্যান্সার— আমরাও যতটুকু পেরেছি সাহায্য করেছি —’ একটু আবেগ যেন বেরিয়ে এল প্রলয়ের কণ্ঠ থেকে।
‘কিন্তু এই বনসাইটা?’ আবার প্রসঙ্গে ফিরে এল চিরঞ্জিত।
‘ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে রাখা ছিল এটা। কেন জানি না, বনসাইটা যেন প্রাণ ছিল মাসিমার।’ স্মৃতি হাতড়ে প্রলয় বলে চলল, ‘স্যর জানেন, রুগ্ন শরীর নিয়ে সকাল-বিকেল ওটায় জল দিতেন মাসিমা। আমাদের দিয়ে সার-টারও আনাতেন। বিড়-বিড় করে কীসব যেন বলতেনও গাছটাকে। বয়স হয়েছিল তো, একটু খ্যাপাটে হয়ে গিয়েছিলেন—আর কী।’
‘কিন্তু এই বনসাইটা এখানে এল কী করে?’ একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়েই কথাটা বলল চিরঞ্জিত।
‘ভোররাতের দিকে মাসিমা মারা যান।’ প্রলয় একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘ছেলে-মেয়ে কেউই তো আসতে পারেনি। তাই অরূপদাই মুখাগ্নি করেছিল। ফ্ল্যাটের চাবিও এখন দাদারই কাছে। ফ্ল্যাটটা নাকি ওরা বিক্রি করে দেবে বলেছে। অরূপদাই মাঝে-মাঝে পার্টি-ফার্টি নিয়ে আসে। একদিন উনিই আমাকে বনসাইটা নিয়ে যেতে বলল। জল-টল না পেয়ে শুকিয়ে আসছিল গাছটা। আমিই তার পর থেকে জলটল দিয়ে— ‘আপনি নেবেন স্যর এটা?’
‘না-না, অন্যের জিনিস’ প্রলয়ের কথায় একটু থতমত খেয়ে গেল চিরঞ্জিত।
‘আপনার তো পছন্দ হয়েছে জিনিসটা। ইচ্ছে করলে নিয়ে যেতে পারেন। আপনার ফ্ল্যাটে মানাবে ভালো। আমার এখানে আর কতদিন পোস্টিং থাকবে! তার পর কে এর পরিচর্যা করবে—’
‘কিন্তু?’
‘স্যর, মাসিমার ছেলে-মেয়েরা এসবের খোঁজ করবে না। শুনেছি পরের মাসে ওরা এসে ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে চলে যাবে—’
‘ঠিক আছে’ একটু হঠকারী সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলে চিরঞ্জিত বলল, ‘তুমি এটাকে আমার ফ্ল্যাটে দিয়ে এস। যদি কেউ খোঁজ করে আমাকে জানিও। আমি ফেরত দিয়ে দেব—’
‘ও কে স্যর’ বলে লিফটের বোতামটা টিপল প্রলয়। ধীর গতিতে চিরঞ্জিত ওপরে উঠতে শুরু করল।
দুই
ষোলোতলার এই ব্যালকনিটা খুব প্রিয় চিরঞ্জিতের। আট বাই ছ-ফুট ক্যান্টিলিভার প্রোজেক্টেড এই বারান্দায় বসলে নিজেকে স্বর্গপুরীর বাসিন্দা বলে মনে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে কিংবা রাত্রে শোওয়ার আগে চিরঞ্জিত কিছুক্ষণ এখানে এসে বসে। কোনও কোনওদিন ঋতমা থাকে। দূর থেকে দেখা যায় হেব্বাল লেক, মান্যতা টেকপার্ক। নিয়ন আলোয় সজ্জিত ঝলমলে রাস্তা ধরে পারাপার করে কত গাড়ি, কত মানুষ। বেঙ্গালুরু রাত্রে ঘুমায় না।
বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে, গরম জলে টি-ব্যাগটা ডুবিয়ে আজও খোলা বারান্দায় এসে বসল চিরঞ্জিত। মনটা আজ কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। একটা কাঠের টুল নিয়ে বনসাইটাকে বারান্দার এককোণে রাখল চিরঞ্জিত। ওর অবয়বটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল চারপাশটা কেমন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। ক্ষুদ্রতার একটা গণ্ডি ক্রমশ বেঁধে ফেলছে চিরঞ্জিতকে। হঠকারী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলায় নিজের ওপরই নিজের যেন রাগ হল আজ। একজন সদ্যমৃতা মহিলার সাধের একটা জিনিস বাড়িতে আনার কথা বললে ঋতমা নিশ্চয়ই খুশি হবে না। একটা অজানা অনুভব বারবার ধাক্কা দিচ্ছে তাকে, উদাসীন একটা অতীত ভেতর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যদিও কোনও কারণ নেই তবুও...
অয়ন ছিল চিরঞ্জিতের ছোটবেলার বন্ধু। কৃষ্ণনগর হাইস্কুলে দু’জনে একসঙ্গে পড়েছে, একসঙ্গে সাইকেল চড়া শিখেছে, একসঙ্গে একটার পর একটা ক্লাসের গণ্ডি পার হয়েছে—একসঙ্গে ওরা কাটিয়েছে জীবনের প্রায় দশটা বছর। এরপর দু’জনের জীবন দু-দিকে বাঁক নিয়েছে। শৈশবের স্মৃতিরা প্রায় মুছেই গেছে চিরঞ্জিতের মানসপট থেকে। কিন্তু আজ, সন্ধ্যায় নেওয়া ব্যতিক্রমী একটা সিদ্ধান্ত, শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত একটা অতীত হয়ে ধরা দিয়েছে চিরঞ্জিতের সামনে।
একটা ছোট্ট নার্সারি ছিল অয়নের বাবার। ফুল-ফল-সব্জির বীজ, চারা কিংবা বড় গাছ পাওয়া যেত ওখানে। ঝুরো মাটিতে বীজ ছড়ানো, ঝারি করে জল দেওয়া, পাখপাখালি বা পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে গাছপালা বাঁচিয়ে রাখা প্রভৃতি নানা কাজে বাবাকে সাহায্য করত অয়ন। বলত, জানিস পৃথিবী থেকে মানুষ চলে যায়, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু গাছেরা থেকে যায়। তুই যদি কোনও চারা পুঁতে কিছুদিন তার যত্ন করিস, বহু বছর পরেও দেখবি ও বিরাট গাছ হয়ে নতমস্তকে তোকে প্রণাম করবে। চিরঞ্জিত শুনত, কিন্তু এসব কথায় কোনও উত্তর দিত না।
খুব ছোটবেলায় চিরঞ্জিতের বাবা মারা গিয়েছিলেন। মার মুখে শুনেছে বাবারও নাকি খুব গাছের নেশা ছিল। মা বলত, ওই যে স্থলপদ্ম গাছটা দেখছিস, ওটা তোর বাবা নিজের হাতে পুঁতেছিলেন। ওর অফিসের এক বড়বাবুর বাড়ি থেকে একটা ডাল এনে তাকে সার-টার দিয়ে কত কষ্ট করে যে গাছটাকে বড় করে তুলেছিলেন। আর ওই কাঁঠাল গাছটার ছায়ায় বসে তোর বাবা কবিতা লিখতেন জানিস। এত কঠিন-কঠিন শব্দ, ছাইপাশ কিছুই বুঝতাম না। প্রতি রবিবার ওই কাঁঠালতলায় বেঞ্চি পেতে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কাব্য আলোচনা করতেন। আমাকে মাঝে-মাঝে চা করে দিতে হতো। আর যেদিন ছন্দ-টন্দ মিলতে চাইত না, সেদিন যদি তোর বাবাকে দেখতিস। সারাক্ষণ খিটির-খিটির, খাওয়া-দাওয়া ভুলে ওই লাউমাচাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বই-কবিতা-আড্ডা-এইসব নিয়ে বেশ সুখেই ছিল মানুষটা।
ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে যখন অতীত ও বর্তমানকে একটা সরলরেখায় ফেলে দিয়েছে চিরঞ্জিত, তখনই ঋতমা ফিরে এল। অফিস থেকে দিন সাতেক ছুটি নিয়েছে ঋতমা। এই ক’দিন মা-ছেলেতে মিলে মার্কেটিং করছে প্রচুর। বেশ কিছু জামাকাপড়, সাংসারিক নানা টুকিটাকি জিনিস লিস্ট করে কিনে এনেছে দুজনায়। ভাত, ডাল, চাউমিন, ডিমের ডালনা, মাছ, মাংস প্রভৃতি রান্না মা ও কাজের মাসির কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে শিখে নিয়েছে অভীক। রেসিপিটা কিংবা ভিডিও ক্লিপিংসগুলো মোবাইলে স্টোর করেছে। চিরঞ্জিত উদাসীন চিত্তে মা-ছেলের কাণ্ডকারখানা দেখে ফোড়ন কেটেছে মাঝে-মাঝে।
অন্ধকার পৃথিবী, তারা ভর্তি আকাশ আর উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত রাস্তা। মাথার ওপর দিয়ে সোঁ করে একটা শব্দ হতেই চিরঞ্জিত আকাশের দিকে তাকাল। ডানাতে দুটো আলো জ্বেলে অন্ধকারের বুকের ভেতর দিয়ে উড়ে গেল একটা প্লেন। খুব চেনা, পরিচিত এই গমনপথটার দিকেও আজ অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল চিরঞ্জিত। দু’দিন পরেই অভীক এমন করেই উড়ে যাবে দূরে, আরও অনেক দূরে।
‘চা খাবে?’ ঋতমার কথায় তন্ময়তা ভাঙল চিরঞ্জিতের। ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে ঢুকতেই বনসাইয়ের দিকে চোখ পড়ে গেল ওর। ‘এটা আবার কোথা থেকে আনলে? খুব সুন্দর তো!’ ঋতমা কাছে গিয়ে জিনিসটাকে একটু অনুপুঙ্খভাবে দেখে কথাটা বলল।
‘একজন সিকিউরিটির কাছ থেকে পেয়েছি।’ একটু ঘুরিয়ে চিরঞ্জিত বলল, ‘একজন ফ্ল্যাট লিভ করার সময় এটা দিয়ে গিয়েছিল ওকে।’
‘মানে, অন্যের ফেলে দেওয়া জিনিস?’
ঋতমার বক্রোক্তিটাকে হজম করেও চিরঞ্জিত আর কথা বাড়াল না ওই বিষয়ে। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, ‘তোমরা দুজন যা শুরু করেছ, তাতে ওদেশের কাস্টমস আটকে দেবে জিনিসপত্র।’
‘তুমি তো সংসারের ব্যাপারে দিন-দিন কেমন নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছ। এই যে ছেলেটা কয়েক বছরের জন্য বিদেশে যাচ্ছে—’
‘তোমার ছেলে যথেষ্ট ম্যাচিওরড। আমি যেটুকু করার করেছি। ওর তো আমার সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে না—’
গতকাল ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মেল এসেছে। ওরা অভীকের স্কলারশিপের অ্যামাউন্ট বাড়িয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ঋতমা একটু গর্বের সঙ্গেই বলল, ‘ছেলে বলছে এখানেই পার্ট-টাইম জব করে বাকি টাকাটা জোগাড় করার চেষ্টা করবে। মানে আমাদের বারডেনটা—’
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল চিরঞ্জিতের ভেতর থেকে। গত দিন পনেরো হল গুরগাঁও থেকে বেঙ্গালুরুতে ফিরেছে অভীক। এর মধ্যে কতক্ষণই বা ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে চিরঞ্জিতের! সারাক্ষণ কোলে ল্যাপটপ, অন-লাইনে বার্তা বিনিময়, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথাবার্তা। চিরঞ্জিত দু-একদিন ওর ঘরে গিয়ে, বিছানায় বসে, হালকা কথাবার্তা বলে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অভীকের শীতল ব্যবহার কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েক যোজন দূরে সরিয়ে দিয়েছে ওকে।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একাকী মনে হয় চিরঞ্জিতের। সে ও ঋতমা দুজনে স্বামী-স্ত্রী, আইনত দম্পতি, কিন্তু তাদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন বলে আদতে কিছু আছে কি? দিন, মাস, বছর একসঙ্গে থাকতে থাকতে একে অপরের অভ্যেস হয়ে ওঠা। একেই তো প্রেম বলে। মায়া, টান আরও কত কী! যেটা সে প্রত্যক্ষ করেছিল মায়ের মধ্যে। বাবার মৃত্যুর পরেও মায়ের প্রতিটি মুহূর্ত আবর্তিত হতো বাবাকে ঘিরে। এই যে না থাকার মধ্যে থাকা। গভীর-গোপন উপস্থিতি। অথচ এতগুলো বছর কেটে গেল ঋতমা-চিরঞ্জিতের কিংবা অভীকের সম্পর্কটা যেন শৈশবেই আটকে থাকল। কেরিয়ারের দৌড়, ব্যস্ততা, সম্পর্কের বীজগুলোকে যেন ঠিকমতো অঙ্কুরিত হতেই দিল না।
ঋতমা রান্নাঘরে যেতেই চিরঞ্জিত আবার হারিয়ে গেল সেই কৈশোর জীবনে। পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিল না অয়ন। তবে চিরঞ্জিতের মেধা বা ভালো রেজাল্ট ওদের বন্ধুত্বের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। ছোট্ট নার্সারির পাশাপাশি অয়নের বাবা এলআইসি-র এজেন্ট ছিলেন। ওর মা একটা পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছিল, অয়ন শোকে কয়েকদিন পাথর হয়ে গিয়েছিল।
মা মারা যাওয়ার পর দিন কয়েকের জন্য কৃষ্ণনগরে গিয়েছিল চিরঞ্জিত পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য। তখন অয়নই একদিন খাতির-যত্ন করে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল চিরঞ্জিতকে। বাবা মারা যাওয়ার পর ও-ই নার্সারিটা চালাত। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ওর ছোট্ট সংসারটা দেখে খুব খুশি হয়েছিল চিরঞ্জিত। অভাবের মধ্যেও যে সুখের ঘর বাঁধা সম্ভব ওদের আতিথ্য, হাসি, প্রাঞ্জলতা দেখে বুঝতে পেরেছিল চিরঞ্জিত। জীবন বড় আশ্চর্য! আজ তার ছেলের বিদেশ পাড়ি দেওয়াটা যেন টাইমমেশিন হয়ে বারবার অতীতে নিয়ে যাচ্ছে চিরঞ্জিতকে।
পোর্সিলিনের কাপের টুং-টাং আওয়াজ হল। ঋতমা আসছে।
‘শোনো না, আজ কিন্তু ডিনারটা তিনজন একসঙ্গে করব। কতদিন তিনজনে একসঙ্গে গল্প করতে-করতে খাইনি বল তো—’
চিরঞ্জিত মুখ ঘোরাল। ঘড়িতে আটটা বাজে। ঋতমা বনসাইটার দিকে আবার তাকিয়ে বলল, ‘আসল মালিক এসে দু’দিন পরে আবার এই সুন্দর গাছটা ফেরত চাইবে না তো?’
‘চাইলেও দেব না আর।’ মুচকি হেসে বলল চিরঞ্জিত। মৃদু হাওয়ায় ছোট-ছোট পাতাগুলো এদিক-ওদিক নড়ছে। যেন প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে গাছটা। মোবাইলে মেসেজ ঢুকছে অনবরত। চিরঞ্জিত আনলক করে দেখল বেশিরভাগ অভিনন্দন ও শুভেচ্ছাবার্তা। সারা বিশ্বে মাত্র দশজন রিসার্চ-স্কলার মহাকাশদূষণ সংক্রান্ত এই গবেষণা করার জন্য ইউএসএ থেকে ডাক পেয়েছে। ছেলের কৃতিত্বের এই খবরটাই পরিচিতদের গ্রুপে শেয়ার করেছিল চিরঞ্জিত। চিরঞ্জিত আবার দ্রুত বর্তমান জীবনে ঢুকে পড়তে আরম্ভ করল।
‘শোনো, তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়তে হবে আজ। কাল সকাল ছটায় ফ্লাইট। অভীকের তো কুম্ভকর্ণের ঘুম—’ একটু চিন্তিত স্বরে বলল চিরঞ্জিত।
‘উঃ, তুমি ছেলেটার এখনও দোষত্রুটি ধরে যাচ্ছ।’ একটু উষ্মা নিয়ে বলল ঋতমা, ‘দেশে থাকলে তবুও তো বছরে দু-চারবার আসত। এই যে একবার পাখি উড়ে গেল...’
মুহূর্তে রাতের আকাশে যেন একটা উল্কাপতনের রেখা দেখতে পেল চিরঞ্জিত।
তিন
আজ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল চিরঞ্জিত। ধু-ধু প্রান্তরের মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে আছে সে। কোথায় গন্তব্য সে জানে না। দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি ও প্রখর রৌদ্র থেকে বাঁচতে একটা বটগাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। দূর থেকে দেখতে পেল একটা ছায়ামূর্তি তার দিকে এগিয়ে আসছে। একটু কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারল ওটা অয়ন। বড় গম্ভীর ওর মুখ। খুব সেন্টিমেন্টাল ছিল ও, অল্পতেই দুঃখ পেত। অয়ন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একটু যেন অনুকম্পা ওর চোখেমুখে। আস্তে-আস্তে বলল, ‘সাবধানে থাকিস, পৌঁছে জানাস একবার।’ কিন্তু কোথায় পৌঁছবে চিরঞ্জিত? কোন দিক ধরে যেতে হবে তাকে?
কিছু একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল চিরঞ্জিতের। হতবুদ্ধি হয়ে বিছানায় উঠে বসল ও। একটু পরেই ঋতমা ঘরে ঢুকল। ভোররাত্রে উঠে ও রান্নাঘরে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিল। একটু বিধ্বস্ত চিরঞ্জিতকে দেখে ও বলল, ‘অভীক বিদেশে যাওয়ার পর থেকে কী হয়েছে বল তো তোমার? প্রেশারের ওষুধটা খাচ্ছ তো নিয়মিত?’
‘না কিছু না’ বিছানা থেকে ধীরে-ধীরে নামল চিরঞ্জিত। ‘আমি তো মাত্র চারদিনের জন্য আমেদাবাদ যাচ্ছি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কাটিয়ে দিতে। কিন্তু এম ডি এমন করে ধরলেন...’
ভোরবেলা রাস্তা প্রায় ফাঁকা। চিরঞ্জিত ড্রাইভ করছে। হিমেল হাওয়ার স্পর্শ পাওয়ার জন্য গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে রেখেছিল ঋতমা। স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসে কুয়াশামাখা বেঙ্গালুরু পেরতে-পেরতে শরৎকালের একটা সকালের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল চিরঞ্জিতের। ওদের বাড়ির পাঁচিলের গা ঘেঁষে একটা বিরাট শিউলি গাছ ছিল। ঝাঁকড়া গাছটার নীচটা ফুলে-ফুলে ভরে থাকত সকালবেলায়। অন্যান্যদের মতো অয়নের জেঠতুতো বোন শম্পাও ফুল কুড়োতে আসত। উঁচু ডালে ও হাত পেত না বলে মাঝেমাঝে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত অয়ন। ডালগুলো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ওকে টেনে গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে দিত। শম্পার চুল, কাঁধ, শাড়ির কুঁচিতে কুঁচিতে সাদা ফুলেরা শোভা ছড়াতে শুরু করত। তখন শ্বেতপরির মতো লাগত ওকে। ওর হাসি, চাপল্য কিংবা কথাবার্তার মধ্যেই বুঝতে পারত চিরঞ্জিত যে শম্পার মনের ভেতর উথালিপাথালি চলছে কোথাও। অয়নদের শরিকি বাড়িতে গেলে কয়েকবার অঙ্ক বোঝার অছিলায় শম্পা ওর কাছে আসত। চিরঞ্জিত যতটা পারত বুঝিয়ে দিত ওকে।
খানিকটা দূরত্ব রেখেই বন্ধুর বোনের সঙ্গে মিশত চিরঞ্জিত। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। স্নাতক স্তরে সাড়া-জাগানো ফল করেছিল চিরঞ্জিত। অন্যদিকে শম্পা উচ্চমাধ্যমিকে দুটো পেপার ব্যাক পেয়েছিল। ওর সায়েন্স নেওয়াটাই ভুল ছিল, পরে মনে হয়েছিল চিরঞ্জিতের । লজ্জায় আর ফুল তুলতে আসত না শম্পা। বাবার বদলির চাকরি সূত্রে ওরা হালিশহরে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে একদিন হঠাৎ-ই দুপুরে চিরঞ্জিতকে রায়দিঘির মাঠে ডেকে একটা কাঞ্চন ফুলের চারা ধরিয়ে বলেছিল, ‘চিরুদা, এই গাছটা এখানেই লাগিয়ে দাও কোথাও, তোমার সঙ্গে আমার তো আর দেখা হবে না। যখন তুমি অনেক দূরে চলে যাবে, অনেক-অনেক উন্নতি করবে, তখন ফুলে-ভরা গাছটার মধ্য দিয়ে আমি মনে রাখব তোমাকে।’
কেমপিগাওদা বিমানবন্দরের টারমিন্যাল বিল্ডিংটা দৃশ্যমান হচ্ছিল ধীরে ধীরে। চিরঞ্জিত টোলট্যাক্সের জন্য গাড়িটা থামিয়ে ঋতমাকে বলল, ‘আস্তে আস্তে, হুট-হাট এই অফিস ট্যুরগুলোকে একটু কমানোর চেষ্টা কর। দুজনেরই তো বয়স হচ্ছে। তাছাড়া ছেলে তো আর কাছাকাছি নেই...’
মৃদু হাসল ঋতমা। লাগেজগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘ফাঁকা লাগে, অভীকের ঘরটার দিকে তাকালে কেমন যেন কান্না পেয়ে যায় আজকাল।’
চিরঞ্জিত কিছু বলল না। ঋতমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সাবধানে থেক, পৌঁছে একবার জানিও।’
চার
একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছিল চিরঞ্জিত। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু। অফিস থেকে চা-খেয়ে একটু নিউজ চ্যানেলটা চালিয়েছে, এমন সময়ই ইন্টারকমে ফোনটা এল। সিকিউরিটি ডেস্ক থেকে প্রলয়ের গলা। একটু নরম স্বরে ও বলল, ‘স্যর, সেদিন যে বনসাইটা আপনি নিয়ে গেলেন, ওই ফ্ল্যাটের মালকিনের ছেলে-বউ এসেছে। ওরা একবার গাছটাকে দেখতে চায়।’
‘দেখতে চায় না নিয়ে যেতে চায়’ একটু রুষ্ট হয়েই বলল চিরঞ্জিত।
‘না-না স্যার। বনসাইটা আপনার কাছে আছে শুনে খুব খুশি হয়েছে ওরা। বলছে-গাছটার সঙ্গে নাকি অনেক স্মৃতি—’
‘ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও—’ ধীরভাবে বলল চিরঞ্জিত।
কিছুক্ষণের মধ্যে ডোরবেল বেজে উঠল। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন ব্যানার্জি দম্পতি। এইভাবে আসার জন্য বারবার দুঃখপ্রকাশ করতে লাগলেন। চিরঞ্জিতও প্রতিনমস্কার জানিয়ে অভ্যর্থনা করল দু’জনকে। ড্রইংরুমে বসিয়ে কোল্ডড্রিংকসে গলা ভেজাতে ভেজাতে গল্পগুজব হল কিছুক্ষণ। এরপর ব্যালকনিতে গিয়ে বনসাইটার পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে রাঘব ব্যানার্জি বললেন, ‘জানেন আমাদের বাড়ি ছিল বারুইপুরে। আমার বাবার খুব গাছের শখ ছিল। আমি যেদিন জন্মাই সেদিন বাবা বাড়ির পাশে একটা বটগাছের চারা পুঁতেছিল। আমি বড় হচ্ছি— গাছটাও বড় হচ্ছে। শেষমেশ দেখা গেল গাছটার শেকড় আমাদের দালানের মধ্যে ঢুকে গেছে। দুটো ঘরের মেঝেতে বড় ফাটল দেখা দিল—’
‘তারপর—’ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল চিরঞ্জিত।
‘আসলে বটগাছটাকে ঘিরে মায়ের মধ্যে একটা সন্তানস্নেহ কাজ করত।’ রাঘববাবু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘আমার কল্যাণের জন্য ওই গাছে সুতো টুতো বাঁধত মা। ঘট বেঁধে মানত টানত করত। তা শরিকি বাড়ির সবার চাপে শেষ পর্যন্ত গাছটা কেটে দেওয়া হবে বলে স্থির হল। তখন বাবা মা-র দুঃখ লাঘবের জন্য ওই বটের বনসাইটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।
মৃদু হাওয়া দিচ্ছিল। ব্যানার্জিবাবু আবার বলে চললেন, ‘মা খুব খুশি হয়েছিলেন। বলতেন—মানুষ, গাছ সবাই তো একসময় নাগালের বাইরে চলে যায়। কিন্তু এই বনসাই, কাছের মানুষ হয়েও সারাজীবন থেকে যাবে আমার সঙ্গে।’ কোল্ডড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে রাঘববাবু আবার বলে চললেন, ‘উনিশ বছর বয়সেই আমি উচ্চশিক্ষার জন্য হায়দরাবাদে চলে যাই। ওখান থেকে মাস্টার্স করে বিদেশে। মা, কেন জানি না, ওই বনসাইটার মধ্যেই আমাকে খুঁজে পেত। ওই বনসাইটাকে আমার নাম ধরে ডাকত।...’
‘ঠিক আছে চল। ঘরে গিয়ে বসি।’ আবেগে গলা রুদ্ধ হয়ে আসছিল রাঘববাবুর। মিসেস ব্যানার্জির কথায় বাস্তবে ফিরে এলেন উনি। ড্রইংরুমে ফিরে চিরঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে আমার। পরশু অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাব। দুই মেয়েই ওখানে সেটেলড্। দেশে হয়তো আর ফেরা হবে না। এই বনসাইটাকে একটু যত্নে রাখবেন প্লিজ...’
আরও খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর বিদায় নিলেন ব্যানার্জি দম্পতি। ধীরপদে ব্যালকনিতে গিয়ে চিরঞ্জিত গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পাতলা মাটির স্তরে স্তরে বিস্তার ঘটিয়েছে শিকড়গুলি। কাণ্ড-উপকাণ্ড বেয়ে নেমে আসা ঝুরিরা যেন সময়কে আকড়ে ধরতে চাইছে। সবুজ কচি পাতাগুলোয় ধ্বনিত হচ্ছে নতুনের আহ্বান।
কী মনে হল, বনসাইটার আরও কাছাকাছি এগিয়ে গেল চিরঞ্জিত। ওর ডালে, পাতায়, ঝুরিতে হাত বুলতে লাগল বারবার। কোনও এক অদৃশ্য বন্ধন যেন রচিত হল দু’জনের অন্তরালে। জ্যোৎস্না, বাতাস সাক্ষী থাকল এই ভাববিনিময়ের মধ্যে। অস্ফুট স্বরে চিরঞ্জিত ডাকতে থাকল ‘অভীক’.... ‘অভীক’...
অলঙ্করণ : সুব্রত মাজী