সাপ্তাহিক বর্তমান

একটি তারার মৃত্যু
সুমন মহান্তি

নামী বেসরকারি হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি আছে মোহন। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, ঘন ঘন হেঁচকি ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে দু’দিন আগে এখানে ভর্তি হয়েছে সে। লিভার সিরোসিস হয়েছে ছ’মাস আগে, তবু মোটের ওপর ভালোই ছিল। আজ ঘন ঘন বমির দমকে মোহন নেতিয়ে পড়ল। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল সব বমির সঙ্গে বেরিয়ে আসতেই মোহনের নাকে রাইলস টিউব লাগানো হল।  ডানহাতের শিরায় স্যালাইনের সুচ ঢোকানো, ফুলে উঠেছে হাত। ওই অবস্থাতেই সে ডান হাত দিয়ে গালে হাত বোলাল।
কেয়া ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে, ‘দাড়ি কাটাতে চাও?’
মোহন মাথা অল্প নাড়ে।
কেয়া হেসে বলে, ‘আচ্ছা। অবস্থা একটু ভালো হোক। আমি বলে-কয়ে বন্দোবস্ত করে দেব।’
মোহন চোখ বন্ধ করে দেয়। তার মনে হচ্ছে, এবার সে কোমাতে চলে যাবে। কোমায় যাওয়া রোগীর কি দাড়ি কাটা যায়?  কেঁপে উঠল তার শরীর। লিরিকস, গান, রেকর্ডিং স্টুডিয়ো, প্লে-ব্যাক, স্টেজ শো, রিয়েলিটি শো, রয়্যালটি ইত্যাদি শব্দ তার মাথার মধ্যে ক্রমাগত হাতুড়ি পিটিয়ে চলছিল। মোহন শুনতে পেল, কোনও এক টিভি চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠান চলছে। মোহন মণ্ডলের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে। ঘোষিকা ললিত কণ্ঠে বলছেন— আমরা জানি যে বিখ্যাত গায়ক মোহন মণ্ডল তিন বছর আগে এই দিনটিতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। গানে আর কথায় এই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে তাঁকে আমরা স্মরণ করব আজ।

হচ্ছেটা কী এসব? হাসপাতালের বেডে নাকে রাইলস-টিউব, হাতে স্যালাইন, চার-পাঁচটা ইঞ্জেকশন নিয়ে আমি কোমার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছি। এদিকে আমার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হচ্ছে টিভি-তে? 
টিভি চ্যানেলে সরাসরি ফোন করে জানতে চাইলাম, ‘এসব হচ্ছেটা কী?’
‘আপনি কে বলছেন?’
‘মোহন মণ্ডল।’ 
‘কোন মোহন মণ্ডল?’
‘টিভিতে অনুষ্ঠান চলছে আমাকে নিয়ে আর বলছেন কোন মোহন মণ্ডল? জীবন্ত মানুষকে নিয়ে ছ্যাঁচড়ামো হচ্ছে?’ 
‘আপনি কোথাও ভুল করছেন। বিশিষ্ট গায়ক মোহন মণ্ডল তিন বছর আগে মারা গিয়েছেন।’
‘মারা গিয়েছেন? এ কেমন রসিকতা আপনাদের? জানেন, এখন আমি হাসপাতালে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি? মোহন মণ্ডল তিন বছর আগে মারা গিয়েছেন! এতবড় মিথ্যাটা পেলেন কোথায়? কে বলল আপনাদের?’
ওপাশ থেকে শীতল, নিস্পৃহ গলায় উত্তর আসে, ‘কোনও মিথ্যে নেই এর মধ্যে। গায়ক মোহন মণ্ডল লিভার সিরোসিসে মারা গিয়েছেন আগেই। খুব করুণ মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। শত বারণ উপেক্ষা করে তিনি গলা অবধি মদ্যপান করে ফুটপাতে পড়েছিলেন। ওই অবস্থাতেই তিনি মারা যান। আমরা তাঁর সম্মানের কথা মাথায় রেখে পাবলিককে তা জানাইনি। বলেছি, ঘুমের মধ্যেই তাঁর ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যায়। বুঝেছেন?’
‘এ হতেই পারে না’, মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ করি।
চোখ খুলে কেয়াকে দেখতে পেলাম। বেডের পাশে টুলে বসে আছে। একজন ডক্টর এসেছেন, খুঁটিয়ে সমস্ত কিছু দেখে বললেন, ‘সিস্টার, অক্সিজেন চালু করে দিন।’
ডক্টর চলে গেলে কেয়া গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,  ‘এখন কেমন লাগছে?’
আনুনাসিক স্বর বেরল গলা দিয়ে, ‘রাঁইঁলস টিঁউঁব।’
‘কিছু পেটে থাকছে না। বমি হয়ে যাচ্ছে। রাইলস-টিউব না থাকলে পেটে কিছু যাবে কীভাবে?’
‘অঁ।’ 

গলার স্বর যেন আমাকে একটানা ব্যঙ্গ করে যাচ্ছিল। আহা, এই সুমধুর কণ্ঠ নিয়ে কত গর্ব ছিল! আমার নাম-যশ-অর্থ সমস্ত কিছুই দিয়েছে এই গলা। গানের ব্যাকরণ তেমন জানতাম না, প্রথাগত গানের শিক্ষাও ছিল না। তবু এই সুকণ্ঠ আমাকে একটা জায়গা অবধি নিয়ে আসতে পেরেছিল। তারপর গানের তালিম নিয়ে তাল-লয়-ছন্দ ইত্যাদির ব্যাকরণ শিখেছি। প্রথম যেদিন টিভির একটি চ্যানেলের জন্য গান রেকর্ড করি, প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ হাত ধরে ঝাঁকিয়েছিলেন, ‘আপনার গলায় কী একটা আছে। সেটা যে কী তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। আপনি অনেক দূর যাবেন।’
উনিশ বছর বয়সে প্রথম কোনও বড় অনুষ্ঠানে গাই। শাসকদলের এক গণসংগঠনে নাম লিখিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম গ্রুপে গণসঙ্গীত গাইতাম। এক সভায় প্রচণ্ড ভিড়, মিটিং তখনও শুরু হয়নি, মাঠে লোক পিলপিল করছে। বিপ্লবদা আমাকে ঠেলে মঞ্চে তুলে দিল, ‘কিছু একটা গা। ভিড় শান্ত হোক।’
দোতারাটা আমার সঙ্গেই থাকত সবসময়। মঞ্চে উঠে দোতারা বাজিয়ে একটার পর একটা লোকগীতি গাইতে শুরু করলাম। দেখলাম ভিড় কোলাহল থামিয়ে আমার গান শুনছে, বিরক্ত হচ্ছে না, তিনটি গান গাইবার পরে আরও একটি গান করার দাবি তুলল জনতা। চারটে গান শুনিয়ে মঞ্চ থেকে নামার সময় প্রবল হাততালি জুটল। 
উত্থান শুরু হল। দলের বড় বড় সমাবেশে গান গাইবার ডাক আসতে লাগল। কোরাসে গলা মেলানো ছেড়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানে লোকগীতি এককভাবে গাইছি। কলকাতার যুব ছাত্র সমাবেশ হল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রাণ উজাড় করে গাইলাম। মাসখানেক পরেই টিভি-তে গান গাওয়ার সুযোগ এসে গেল। আমার গানের সঙ্গে ‘মাটির মূর্ছনা’ আছে, ‘গ্রামজীবনের সহজ সুর’ আছে, ‘প্রান্তিক মানুষের ঘ্রাণ’ পাওয়া যায় । এমন অনেক প্রশংসা আর বাহবা জুটছিল বিভিন্ন কাগজে-চ্যানেলে। তখন ক্যাসেটের যুগ ছিল। প্রথম ক্যাসেট প্ল্যাটিনাম ডিস্ক-এর সাফল্য পেল, দ্বিতীয় ক্যাসেট গোল্ডেন ডিস্ক। রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকে, গ্রামগঞ্জ থেকে অনুষ্ঠানের ডাক আসতে আরম্ভ হল। বাবা লোকগীতি গাইতেন, গ্রামেগঞ্জের মেলায়, ওর বেশি এগতে পারেননি। তাঁর ধারা পেয়েছিলাম। গলায় সহজেই লোকগীতি খেলা করত, দরদ আর প্রাণ দিয়ে গাইতাম, গানের শিক্ষা সেভাবে ছিল না।
বাবার গান শহর অবধি পৌঁছয়নি, তাই অবহেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। বাবার স্বকীয়তার কাছে আমি আসলে কিছুই নই। শহুরে শিক্ষিত লোকজনের কাছে লোকগীতি হল একটা ফ্যাশন, মাটির কাছাকাছি থাকতে চাওয়ার একরকম দেখনদারি। বাবার গাওয়া গানগুলিকে আধুনিক পালিশ দিলাম, জ্যাজ-সিন্থেসাইজার-ড্রাম-গিটার ইত্যাদি যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র মিশিয়ে পরিবেশন করা শুরু করলাম। পাবলিক ছন্দ চায়, নাচের তাল খোঁজে, তাদের মর্জিমাফিক গানগুলো ভেঙেচুরে গাইতে লাগলাম। প্লে-ব্যাকের সুযোগ এল। দুটো সিনেমায় মোট তিনটি গান, তিনটিই সুপারহিট, লোকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজতে লাগল। আরও উঁচুতে উঠে গেলাম। নতুন খেলা শিখলাম— ‘ফিউশন’। ওয়েস্টার্ন মিউজিক আর লোকগীতির ফিউশন করে গাইলাম, পাবলিক ‘ফিউশন’ খেল, আমার স্টেজ-প্রোগ্রামের এবং প্লে-ব্যাকের রেট বাড়ল। ক্যাসেট অচল হয়ে বাজারে এসেছে সিডি। প্রথম সিডি বেরল, তেমন চলল না। নাহ, লোকগীতির স্টক ফুরিয়ে যাচ্ছে, কত আর নতুন লোকগীতি তৈরি হবে, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ওই ঘরানার গীতিকার নেই বললেই চলে। গান শিখতে শুরু করলাম, একেবারে প্রথাগত শিক্ষা বলতে যা বোঝায়, তা মন দিয়ে এক বছর শিখলাম। পথ বদলানোর আগে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
 বিবাহিত জীবন বারো বছর পেরিয়েছে, একমাত্র ছেলে ধ্রুব দশে পা দিয়েছে। কেয়া বর্ধমানের মেয়ে, কলকাতার এক কলেজে পড়ায়, একটি অনুষ্ঠানে আলাপ, আলাপের সূত্র ধরে প্রেম এবং বিয়ে। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত আবাসনে হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, সচ্ছল নাগরিক জীবন, ভেন্টিলেটর দিয়েও গ্রামজীবনের ধুলোমাটি  ঢোকার উপায় নেই। দুখানা ক্যাসেট এবং প্লে-ব্যাক গানের সাফল্যের পরেই জীবনে সুরা এসেছে। পরিমিত পান করি, তবে প্রোগ্রামে স্টেজে ওঠার আগে বেশ কয়েক পেগ না চড়ালে মুড আসে না। আশপাশে অসংখ্য বন্ধু, তাদের সঙ্গে ফুর্তি করি, মদ্যপান চলে, গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। কেয়া দরজা খুলে দেয়। আশ্চর্য নারী, তা নিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করে না, তিরস্কার-ঝগড়া কিছুই হয় না। সকালে  শান্তভাবে শুধু বলে, ‘যা করছ কর। গানটা যেন বেঁচে থাকে।’ 
 
প্লে-ব্যাকের জগতে কোনও সুযোগ মিলল না। যুগের হাওয়া বুঝে বাংলা গানের ব্যান্ড খুললাম। নাম দিলাম ‘সহজানা’। উদ্দাম, বেপরোয়া একটা ইমেজ বানানোর চেষ্টা করলাম। হালকা ক্লাসিক্যাল, মাঝেমধ্যে দু-তিন লাইন ফোক-সং ফ্লেভার, ওয়েস্টার্ন রকের আদলে তিন-চার লাইন, তার সঙ্গে গিটার, হেভি মেটাল আর জ্যাজ। ঠিকঠাক মাত্রায় মেশানো এই ককটেল বাজারে জমে গেল। ব্যান্ডের সুনাম আর চাহিদা বাড়ল। কলেজ-ইউনিভার্সিটি-ক্লাবের প্রোগ্রামে ডাক আসতে শুরু হল আবার, ডেট দিতে হিমশিম খাই। কমবয়সি ছেলেমেয়েরা উদ্দামতা চায়, বাঁধনছাড়া কিছু চায়, গাঁজায় টান মেরে তাদের চাহিদা মেটাই প্রোগ্রামে।
বেশ একটা সিস্টেম-বিরোধী, প্রতিবাদী ইমেজ তৈরি হয়ে গেল আমার ব্যান্ডের। গাঁজা, চরস, মদ তো ছিলই, এবার নারীতে আসক্তি বাড়ল। প্রোগ্রাম করতে কোথাও দূরে গেলেই প্রায়ই রাতের সঙ্গিনী জুটে যেত। কেয়া বোধহয় কিছু বুঝেছিল। সে আমার সঙ্গে এক বিছানায় শোওয়া বন্ধ করে দিল। মুখে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। 
বেশ চলছিল আমার ব্যান্ড। ধূমকেতুর মতো বাজারে উঠে এল ‘দোতারা’ ব্যান্ড। মূলত লোকগীতি বেসড গান, সঙ্গে কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত আর অতুলপ্রসাদের গান। এতেই বাজার মাত করে দিল ‘দোতারা’। আমাদের চাহিদা তুঙ্গে উঠেছিল, পড়তেও বেশি সময় লাগল না। আমারই অস্ত্রে নতুন ব্যান্ড আমাকে ঘায়েল করে দিল। একসময় আমার গানের প্রশংসায় যা বলা হতো, ঠিক তেমন বিশেষণ পেতে লাগল ‘দোতারা’। বলা হল যে এই নতুন ব্যান্ডের মধ্যে মাটির সোঁদাগন্ধ আছে, সুস্থ সংস্কৃতি ফিরিয়ে এনেছে এই ব্যান্ড। ব্যান্ডের নামে চিরায়ত বাংলা গানের আদ্যশ্রাদ্ধ করা, উচ্ছন্নে যাবার অন্ধকার সুড়ঙ্গ দেখানো, হিপি কালচারের আমদানি করা ব্যান্ড নয় এটা। তির যে আমাদের ব্যান্ড-কে লক্ষ্য করে ছোড়া তা বুঝতে দেরি হল না।
সেই সমালোচকের সঙ্গে এক পার্টিতে দেখা হল। পাঁচ পেগে টালমাটাল আমি, দেখামাত্রই খিস্তি দিয়ে কথা শুরু করলাম।
‘সোহম রায়গুপ্ত! বিশিষ্ট সমালোচক। তা আমার পেছনে লেগেছেন কেন?’
সোহম রাগলেন না। শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনি এখন প্রকৃতিস্থ নেই। তাই কিছু মনে করছি না। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। মদ, গাঁজা, চরস টেনে টেনে আপনার গলায় কিছু নেই। গলা দিয়ে বিকৃত স্বর বেরয়। চড়া বাদ্যযন্ত্র আর কোরাসে ওটা চাপা পড়ে যায়। আপনার ইউএসপি ছিল সুন্দর মিষ্টি গলা আর আবেগ। নিজে একটা মৌলিক গান গেয়ে দেখাতে পারবেন? চ্যালেঞ্জটা নিয়ে আমাকে ভুল প্রমাণিত করতে পারলে খুব খুশি হব।’

ক্যাসেটের পর সিডির চল হয়েছিল, সিডি অচল হয়ে এল ইউটিউব। প্লে-ব্যাকে সুযোগ পাব না, অ্যালবাম করার যুগ আর নেই। মরিয়া হয়ে একটা গান রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করে দিলাম।
ভেবেছিলাম প্রশংসায় ভরে যাবে কমেন্ট বক্স। খুব পরিচিত কয়েকজন বাহবা দিলেও কটূক্তিই বেশি। কেউ লিখেছে— এই কি সেই মোহন মণ্ডল? মনে হয় না। যার গলার জাদুতে আচ্ছন্ন হতাম একসময় সে এই মোহন নয়।
কেউ লিখল— এর চেয়ে বাথরুম সং শোনা ভালো।
—গলা না ফাটা কাঁসরের শব্দ?
—সুর নেই। গলা বসে গেছে।
—ওনাকে ওই উৎকট আওয়াজেই মানায়। সোলো সং গাইবার মুরোদ নেই বলে ব্যান্ড খুলেছেন।
—নিজেই তো গানের ব্যান্ড বাজিয়ে দিয়েছেন অনেক আগে।
—নেশাভাঙ করে গান হয় না। ওটার জন্য সাধনা লাগে।
সোহম ঠিকই বলেছিলেন। আমার বেসুরো গলা পাবলিকের কাছে ধরা পড়ে গেছে। লোকসঙ্গীতই গেয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও যেন কিছু একটার খুব অভাব। চর্চাটাই তো নেই, এ-গান সে-গান খুবলে জোড়াতালি দিয়ে চটুল রিদম বানাতে ব্যস্ত ছিলাম। ব্যান্ড ভেঙে গেল, দুটি ছেলে নিজেরা অন্য নামের ব্যান্ড খুলল। যে দুজন তরুণী ছিল আকর্ষণ, তাদের একজন বিয়ের পর স্পেনে চলে গেছে, আর একজন হেনস্তার অভিযোগে ব্ল্যাকমেল করে লাখ দশ নিয়ে ব্যান্ড ছেড়ে দিল।
এবার নিয়মিত রাতে ঠিক সময় ঘরে ফেরা শুরু হল। অবশ্য বাইরে বেশি আর থাকিই না, হাতে কাজ নেই, প্রোগ্রামের ডাক আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কেয়ার কাছে রাতে গেলে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, ‘এখন সব দরজা বন্ধ হতেই মনে পড়েছে?  আমার প্রয়োজন অনেক আগেই ফুরিয়েছে।’
নিজেকে কেমন যেন নগ্ন মনে হচ্ছিল। তবু ম্লানমুখে বললাম, ‘তা হতে পারে না। আবার সব ফেরানো যায়।’
নাইট-ল্যাম্পের আলোতে কেয়াকে দূরতম কোনও প্রবাসের নারী মনে হচ্ছিল। চোয়াল কঠিন করে বলল, ‘যে মোহনকে আমি ভালোবাসতাম সে তিন বছর আগেই মারা গিয়েছে। অনেক দোষ মেনে নিয়েও ভেবেছিলাম তার গানটা অন্তত বেঁচে থাকবে। ধৈর্য রেখে সেই প্রতীক্ষাতেই ছিলাম। এখন গান মরে গেছে, সে-ও আর বেঁচে নেই।’
আমারও বেঁচে থাকার আর কোনও  ইচ্ছে ছিল না। গান গাইতে পারি না, অত্যাচারে গলা নষ্ট হয়ে গেছে। কী লাভ আর এভাবে বেঁচে থেকে? ধ্রুব আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে, চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট ঘৃণা দেখি তার। নাগপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, ফোর্থ ইয়ার চলছে। লজ্জায় তার সঙ্গেও সহজভাবে কথা বলতে পারি না। বড় হয়েছে, আমার উদ্দাম বিশৃঙ্খল জীবনযাত্রার খবর নিশ্চয়ই সে জানে। গাঁজা, চরস, সিগারেট সমস্ত রকম নেশা ছেড়ে দিলাম। শুধু মদ ছাড়তে পারলাম না, হতাশা আর নিঃসঙ্গতার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়াল ওটা। লিভার সিরোসিস ধরা পড়ল। টের পেলাম যে শূন্য থেকে শুরু করে ঘুরেফিরে সেই শূন্যেই ফিরে গিয়েছি শেষমেশ। এক রাতে মুঠো মুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার চেষ্টা করলাম। তবু মরলাম না। নার্সিংহোমে চোখ খুলে দেখলাম কেয়া পাশে বসে আছে। 
কেয়া শারীরিকভাবে ফিরে না এলেও অনেক দিন আর রাতের ক্লান্ত অপেক্ষার পরে ফিরে এসেছিল। আত্মহত্যার প্রয়াস অবশ্য খবর হয়নি, গোপনই ছিল। আমার ব্যাপারে মিডিয়া এমনিতেই আর আগ্রহ দেখাত না। 
মদ্যপান একেবারে কমিয়ে দিয়েছিলাম। মাঝেসাঝে পরিমিত মাত্রায় খেতাম, সিন্থেসাইজার নিয়ে বসতাম। হঠাৎ এক নামী পরিচালকের ফোন পেলাম। তিনি তাঁর নতুন সিনেমার জন্য আমার গলায় একটি গান রাখতে চান।  রেকর্ডিং হয়ে গিয়েছে, সুরকার খুশি, গানটা নাকি তাঁর মনের মতো গাইতে পেরেছি।
সিনেমা রিলিজ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে যে বেঁচে থাকতেই হবে। দেখতে দেখতে আমি পৌঁছে গেলাম এক শীর্ণ খালের ধারে, বকেরা উড়ে বেড়াচ্ছে, চারপাশে ঘন সবুজ ঘাস, একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে আগুনরঙা হয়ে আছে। নিঝুম দুপুর ফুরিয়ে বিকেল নামছে, মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে নাকে, হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে হলুদ ক্ষয়াটে পাতারা।  গাছের নীচে বসে গোরু চরাতে আসা একটি কিশোর আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। তাকে বলি, ‘একটা গান গাইব। তুমি বাঁশি বাজাবে গানের সঙ্গে?’
রাখাল কিশোরটি হেসে আমার দিকে তাকাতেই চমকে উঠি। এ যে অবিকল আমার মুখ। নিষ্পাপ, সরল মুখখানি পরম বিস্ময়ে চেয়ে আছে।  মাথা দুলিয়ে বলছে, ‘গান? কবে ফুরিয়ে গেছে সমস্ত গান। তোমার গান আর আছে?’
‘তাহলে?’
‘চুপচাপ বাঁশি শুনে যাও। শান্ত হয়ে বসো। সারাজীবন তো নিজেকে ভালোবেসেই কাটালে। গানকে তেমনভাবে ভালোবাসতে পারলে কই?’ কিশোরকণ্ঠ এক গম্ভীর পুরুষকণ্ঠে বদলে গেল নিমেষে।
‘আমাকে ভালো করে দাও। একটিবার আবার আগের মতো গান গাইতে চাই। বাতাসে উড়তে উড়তে সে সুর পৌঁছে যাবে আমার ভিটায়। তুলসী মঞ্চের কাছে সন্ধ্যা নামবে, প্রদীপ জ্বলে উঠবে, বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলবে, এসেছিস টোকন? দোতারা হাতে ধুলো মেখে পথে পথে গান গেয়ে বেড়াতে চাই একবার। তুমি মুরলীধর, সব জানো, একবার অন্তত ফিরে যেতে দাও।’ 
‘তা হতে পারে না। ইহজগতে তোমার ভূমিকা শেষ। তোমার গলা আর কোথাও পৌঁছবে না, নিজেকে শেষ করে দিয়েছ তিলে তিলে। আর ফেরা যায় না।’
‘বিশ্বাস কর, এবার এই নষ্টজীবন ভুলে বাঁচার মতো বাঁচব। এই দুর্বল গলা দিয়েই সুন্দরের জয়গান করব, তার পাশটিতে বসে থাকব। আমি শ্রোতা চাই না, আলো ঝলমল মঞ্চ চাই না, শুধু প্রাণভরে কেয়া আর ধ্রুবকে গান শোনাতে চাই।’
সেই কিশোর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘মুক্তি কি এতই সহজ? তার চেয়ে এই জীবন থেকেই বরাবরের মতো মুক্তি দিলে কেমন হয়?’  

মোহন জেগে উঠে চোখ মেলে তাকাল। সে তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? ওপারে যাওয়ার আগে নাকি বিভ্রম হয়, কতকিছু দেখতে পায় মানুষ শেষ মুহূর্তে। তার কি সময় হয়ে এল তাহলে? মোহন আঙুল বাড়িয়ে কেয়ার হাত খুঁজতে লাগল। তার খুব ভয় করছে। এখনও যে সে বড় আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছে। জীবনের শেষ রেকর্ড করা গান কেমন সাড়া ফেলে তা সে দেখতে চায়। ওই গানটায় যে সে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উজাড় করে দিয়েছে!
কেয়া হাসল, ‘অনেকক্ষণ ঘুমোলে। ঘুমের মধ্যে ঠোঁট নড়ছিল। স্বপ্ন দেখছিলে?’
‘উঁ,’ স্খলিত গলায় এর বেশি কিছু বলতে পারল না মোহন।
‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’
মোহনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। রাইলস-টিউব খুলে দিয়ে গেল নার্স। মোহন অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। 
‘বললে না? কার সঙ্গে কথা বলছিলে ঘুমের ঘোরে?’
‘শ্যাম।’
‘শ্যাম?’ কেয়া অবাক হয়ে তাকাল।
‘হ্যাঁ গো, শ্যামসুন্দর এসেছিলেন। তাঁর কাছে সুন্দরের ভিক্ষা চাইলাম। দিলেন না,’ ক্ষীণ কাঁপা গলায় বলল মোহন।
‘কী বলছ তুমি?’ উদভ্রান্ত কেয়া চিৎকার করে ওঠে।
মোহনের দু’চোখ জুড়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আদিগন্ত শ্যামল অন্ধকার, ঘন বৃষ্টিতে নদীর দু’ধারের সবুজ অন্ধকার হয়ে যায়। যেভাবে ছেলেবেলায় ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ গান গাইত, সেভাবেই কোনও অতল জলের আহ্বানে ঠোঁট বেয়ে সুর ভেসে আসে। প্রাণের গভীর থেকে শ্বাসনালী বেয়ে উঠে আসছে সহজ স্বর।
মোহন বুঝতে পারল না, সে কোথায় যাচ্ছে। কোনও এক চিরন্তন ঘুমের দেশ তাকে ডাকছে। সে যেন বক হয়ে সাদা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে দূরে। উড়তে উড়তে কাশফুলে ভরা চরে নেমে এসে সে কেয়াকে খুঁজছিল।
কেয়া দেখল,  মোহন আস্তে আস্তে আঙুলের বন্ধন ছেড়ে দিচ্ছে।
সে কাঁদল না। মোহনের ঠান্ডা কপালে হাত বুলিয়ে দিল।
অলঙ্করণ : সুব্রত মাজী
16d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

ধর্মকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণে মানসিক তৃপ্তি ও সামাজিক সুনাম। পেশাদার শিল্পীদের শুভ সময়।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৫ টাকা৮৪.৮৯ টাকা
পাউন্ড১০৮.২৫ টাকা১১১.৮০ টাকা
ইউরো৯০.৭১ টাকা৯৩.৮৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা