বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
রঙ্গভূমি
 

কমলকুমারের গল্পের দুঃসাহসিক মঞ্চায়ন 

কমলকুমার মজুমদারকে ‘দুঃসাহসী লেখক’ বলে অভিহীত করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর বাক্যগঠন, শব্দ, ক্রিয়াপদ, কমা, পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার সবই ছিল চলতি রীতির থেকে আলাদা। এমনকী আলাদা ছিল তাঁর ভাষাও। সাধুভাষার ব্যবহার, অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার তাঁর লেখাকে করে তুলেছিল অন্য সবার থেকে আলাদা, ফলে হয়তো দুরূহও। তো, সেই লেখকের গল্পকে অন্য মাধ্যমে তুলে আনার কথা চিন্তা করাটাও অবশ্যই দুঃসাহসিক কাজ। ফিল্মে এই ধরনের দুঃসাহসিক কাজ দু-তিনজন করেছেন, কিন্তু মঞ্চে সম্ভবত একজনই এই দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সমীর বিশ্বাস; এবং সেই দুঃসাহসিক কাজটি তিনি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই করতে পেরেছেন। কমলকুমার মজুমদারের লেখা ছোট গল্প ‘মতিলাল পাদরী’ অবলম্বনে মাঙ্গলিকের প্রযোজনায় ‘মতিলাল পাদরী’ দেখে সেরকমই মালুম হল। নাট্যটির পরিচালনা ও প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সমীর বিশ্বাস। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পর সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতার মধ্যেই এই নাট্যটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল আর বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে নাট্যটির দ্বিতীয় পর্যায়ের মঞ্চায়ন শুরু। প্রথম পর্যায়ে এই নাটকটি দেখেছেন কমলকুমারের স্ত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক নবেন্দু ঘোষ, মৃণাল সেনসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি।
মানুষের জীবনে ধর্মই শেষ কথা বলে না। ধর্মের থেকেও মূল্যবান হল মানবিকতা। কমলকুমারের এই গল্পের মধ্যে সেই বার্তাই সুপ্ত। আর তাই এই মুহূর্তে সেই কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। স্বাভাবিক কারণেই মাঙ্গলিক নাটকটির পুনর্মঞ্চায়ন করতে উদ্যোগী হয়েছে।
‘মতিলালের চাইবার কিছুই ছিল না, শান্তি নয় কিছু নয়। বিচারের ভীতি তাঁর কোনক্রমেই ছিল না। শুধুমাত্র একটি আশা, পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান। পুরো ক্রিশ্চান বলতে অর্থাৎ কথাটার মধ্যে বহু পুরাতন প্রেমের অনুভব ছিল, অনুতাপ নয়।’ কমলকুমারের লেখনী অনুযায়ী এই ছিল মতিলাল পাদরী। আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলের এক কনভার্টেড ক্রিশ্চান পাদ্রি মতিলাল। তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান হওয়া, আর কিছু নয়। কিন্তু এক ঝড়জলের রাতে তাঁর গির্জাঘরে এসে হাজির হল অনাহূত এক মানুষ। তারপর যা ঘটল তার কোনওকিছুর জন্যই মতিলাল একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ঘটনার গতিপ্রকৃতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল মতিলালকে। পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান হওয়া তার আর হল না। ধর্ম নয়, মানবিকতাই জয়ী হল। পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান হওয়ার বদলে মতিলাল হয়ে উঠল মানবিক। ধর্ম নিয়ে চতুর্দিকে যা হচ্ছে সেই পরিস্থিতিতে এই নাট্য আজ বড্ড প্রাসঙ্গিক। ধন্যবাদ সমীর বিশ্বাস ও মাঙ্গলিককে।
কমলকুমারের লেখনী থেকে মতিলালকে হুবহু তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন সমীরবাবু। তাঁর স্বরক্ষেপন, শারীরিক অভিনয়, অভিব্যক্তি সমস্ত দিয়ে তিনি শান্ত সমাহিত এক আদিবাসী পাদ্রিকে উপস্থাপিত করেছেন মঞ্চে। যে সকলের মঙ্গল কামনা করে। কুষ্ঠরোগীর সেবা করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু দিনের শেষে তার একটাই চাওয়া, আর তা হল বাইবেলের অনুজ্ঞা মতো পূর্ণাঙ্গ ক্রিশ্চান হয়ে ওঠা।
নাট্যের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র হল ভামর। এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন শতাব্দী বোস। শতাব্দী চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ, কিন্তু তাঁর অভিনয়কে অভিনয় বলে মনে হয়েছে। স্বাভাবিকতার অভাব রয়েছে। স্বরক্ষেপনের ক্ষেত্রেও তাঁকে আরও কুশলী হতে হবে। ভালো লাগে বীনা হাঁড়ির ভূমিকায় দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে, পতাকীর ভূমিকায় অসীম বোসকে, বদনের ভূমিকায় দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়কে। বাকিরাও যথাযোগ্য সঙ্গত করেছেন। বাবলু সরকারের আলোক পরিকল্পনা ও ক্ষেপণ অত্যন্ত সরল ও মসৃণ। নাট্যটির সঙ্গে সর্বদা যথাযথ সঙ্গত করে গিয়েছে। লন্ঠনের মৃদু আলোয় গির্জার পবিত্র গাম্ভীর্য্য থেকে শুরু করে জঙ্গলে রাতের আঁধারের মায়াময়তা জীবন্ত হয়ে উঠেছে বাবলুর আলোয়। মুরারী রায় চৌধুরীর আবহ ভাবনাও বেশ। তবে সুশান্ত অধিকারীর শব্দ প্রক্ষেপণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। পাখির দলের কলকাকলী কখনও আচমকা একেবারে থেমে যায় কি? পাখির দল উড়ে পালিয়ে গেলে তাদের ডাক ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যায়। সেই কাঙ্খিত এফেক্টটা পাওয়া গেল না।
সুদীপ্ত গুপ্তের মঞ্চ ভাবনা মন্দ নয়। মঞ্চের একদম পিছনে দৈর্ঘ্য বরাবর লম্বা রোস্ট্রাম। অ্যাক্টরস লেফ্ট ঘেঁষে সেখান থেকে নেমে এসেছে একটি র‌্যাম্প। তার পাশেই ডাউন স্টেজে উইংস ঘেঁষে ছোট চৌকো অপর একটি রোস্ট্রামকে ব্যবহার করা হয়েছে পাদ্রির ঘর হিসেবে। কাপড় দিয়ে তৈরি গাছপালার সাজেশন। কিন্তু ক্রুশ সহ গির্জার দরজাটি বারবার শিফট না করে গোটা নাট্যজুড়েই স্থির রাখা যেত না কি? যাকে বলে স্ট্যাটিক সেট। সে ক্ষেত্রে অন্যত্র রাখতে হতো অবশ্য। বারেবারে শিফট করতে গিয়ে সামান্য হলেও তাল কেটেছে। দরজার ফ্রেমটি অভিনয় চলাকালীন দৃষ্টিকটূভাবে নড়ছিলও। যদিও সমগ্র নাট্যটি উপভোগ করতে গিয়ে এসব কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না শেষ অবধি। আলো, মঞ্চ, আবহ ও অভিনয় মিলেমিশে পাহাড়ি পরিবেশকে মঞ্চে তুলে আনে সার্থকভাবে। গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছেন শেখর সমাদ্দার। তিনি কমলকুমারকে যথাসাধ্য অনুসরণ করেছেন। কোথাও ছন্দ কাটে না।
নাট্যের শেষ দৃশ্যে যখন সমস্বরে সব চরিত্র বলে ওঠে, ধার্মিক নয় মানবিক হও কমলকুমারের গল্পের মঞ্চায়ন সার্থক হয়ে ওঠে।
স্বস্তিনাথ শাস্ত্রী 

14th     March,   2020
 
 
কলকাতা
 
রাজ্য
 
দেশ
 
বিদেশ
 
খেলা
 
বিনোদন
 
আজকের দিনে
 
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এখনকার দর
দিন পঞ্জিকা
 
শরীর ও স্বাস্থ্য
 
বিশেষ নিবন্ধ
 
সিনেমা
 
প্রচ্ছদ নিবন্ধ