রাজনীতি বিষয়টার সঙ্গে বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত যোগাযোগ। কখনও মনে হয়, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সঙ্গে এর মিলমিশ সবচেয়ে বেশি। যেমন ক্রিয়া, তার ঠিক সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া। কোনও রাজনীতিক দল নির্বাচনের আগে কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং কীভাবে সে ব্যাপারে মানুষকে কনভিন্স করতে পারছে, ঠিক তার উপর নির্ভর করে ভোটযন্ত্রের প্রভাব প্রতিপত্তি। আবার কখনও মনে হয়, এ এক নিখুঁত পারমুটেশনের অঙ্ক। ঘুঁটি সাজিয়ে চলা নিরন্তর... খেলতে জানলে কোনও একটা তো ক্লিক করবে! ঝুঁকি? অবশ্যই আছে। ঠিকমতো অঙ্কটা কষতে না পারলে বেচাল হবেই হবে। ফেলুদার থিওরি ধার করলে অবশ্য রাজনীতিও একরকম জিওমেট্রি। এখানে অবশ্য স্ট্রেট লাইনে চলাফেরার ব্যাপার নেই। সবটাই সাপের মতো এঁকেবেঁকে। উল্টোদিকের দলের স্ট্র্যাটেজিকে ডজ করে এগিয়ে যাওয়া। যত দিন যাচ্ছে, রাজনীতির বিজ্ঞান ততই কঠিন হচ্ছে। প্রযুক্তি বেড়েছে। সঙ্গে মিডিয়ার আনাগোনা। আজ থেকে ৩০ বছর আগে প্রচারে আসাটা যত না কঠিন ছিল, আজ ব্যাপারটা ততই সহজ। গায়ে কত দামি পোশাক চাপাচ্ছেন, হাতে কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরছেন, কী মোবাইল ব্যবহার করছেন... সবটাই দেখছে মিডিয়া। আর প্রচার করছে। শাসক-বিরোধীর লড়াইটাও এখন আর তাৎক্ষণিক নয়। বিস্তর হোম ওয়ার্ক প্রয়োজন। অতীত-বর্তমান ঘেঁটে বের করে আনতে হবে দুর্বল জায়গা। তারপর আঘাত করতে হবে সেখানে। এও এক অক্লান্ত প্রক্রিয়া। থামলে চলবে না। দু’টো ইনিংস শাসনকালের শেষে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর দেখা দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদি জমানাতেও হয়েছে। বহু ফ্লপ নীতি, সংস্কারের অজুহাতে মানুষকে জলে ঠেলে দেওয়া, উগ্র ধর্মীয় রাজনীতি... প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই তৃতীয় ইনিংসের পরীক্ষায় নামার আগে মোদি সরকারের চ্যালেঞ্জও প্রচুর। কিন্তু সেই তালিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী? একটি ফর্মুলা—বিজেপির বিরুদ্ধে এক হতে হবে সব বিরোধীকে। তাহলেই ফেলে দেওয়া যাবে সরকার। মোক্ষম অঙ্ক। জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক, এসব তত্ত্বকথার প্রাসঙ্গিকতাই আর নেই নতুন ভারতে। বিজেপিকে হটাতে হলে লড়াই হোক একসঙ্গে। মহাজোট? দরকার নেই। কিন্তু একটা সমঝোতা হলে ক্ষতি কী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বছর দুয়েক ধরে বলে চলেছেন, ‘যে দল যেখানে শক্তিশালী, সে প্রার্থী দিক ওই কেন্দ্রে। অন্য বিজেপি-বিরোধী দল যেন সেখানে লড়াই করতে না নামে।’ খুব সহজ, কিন্তু কার্যকরী অঙ্ক। কিন্তু সমস্যাটাও যে এখানেই। কেন? কোনও বিরোধী দলই স্বার্থ ছেড়ে বেরতে পারছে না। সবারই অন্তরের প্রশ্ন, আমি কী পাব? আমার লাভ কতটা? আমি কি প্রধানমন্ত্রী হতে পারব? বাংলায় একটা কথা আছে, গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! আমাদের দেশের বিরোধীদের অবস্থা হয়েছে কতকটা সেইরকম। সবাই কতটা সুখী হতে চায় প্রশ্ন থাকতে পারে, সবাই রাজা যে হতে চায়, সে ব্যাপারে সংশয় নেই।
রাজা হতে চান নরেন্দ্র মোদিও। আরও একবার। তৃতীয়বার। বিজেপিতেও দুটো গোষ্ঠী রয়েছে। এক পক্ষ মোদিপন্থী, অন্যপক্ষ নয়। মোদিপক্ষই অবশ্য সংখ্যায় বেশি। অন্যপক্ষ যেমন দলের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী, তাঁরা তেমন নয়। মোদির ভক্তরা ব্যক্তিপুজোয় আস্থাবান। একটা সময় কাঁটাঝোপের মতো দলের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলেন বাজপেয়িপন্থী নেতানেত্রীরা। তাঁদের প্রায় সবাইকে ক্ষমতার অলিন্দের বাইরে পোস্টিং দিয়ে দিয়েছেন মোদিজি। আরএসএস তাঁর প্রকাশ্য সমর্থক। ফলে দল নিয়ে খুব মাথাব্যথা তাঁর নেই। হঠাৎ করে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পানকৌড়ির মতো কেউ মাথাচাড়া দেবে—সেই ভয় বিজেপিতে নেই। বরং অঙ্কটা কষতে হবে বিরোধী মঞ্চ নিয়ে। আর সেটাই তিনি করছেন। জোরদার পারমুটেশন। দল অনেকগুলো। তাদের মাথাও অনেক। কেউই খুব কম ক্ষমতাবান নন। বরং নিজের নিজের ক্ষেত্রে তাঁদের যথেষ্ট প্রতাপ। ডিএমকের স্ট্যালিন, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, ধুঁকতে থাকা অবস্থাতেও আরজেডির লালুপ্রসাদ যাদব, শিবির বদলানো নীতীশ কুমার এবং অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আছেন শারদ পাওয়ারও। আসন খুব বেশি পাবেন না, কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঝুলি তাঁর পরিপূর্ণ। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে স্বয়ং সোনিয়া গান্ধীকে বিপাকে ফেলেছিলেন। এখন বিরোধী কুলের কৃপাচার্য হয়ে পরামর্শ বিতরণ করে থাকেন। ফলে মোদিজির পক্ষে সমীকরণ গোছানোটা খুব সহজ নয়। সেক্ষেত্রে উপায় কী? এমন একজন যদি বিরোধী মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, পাবলিকের মধ্যে যাঁর তেমন গ্রহণযোগ্যতাই নেই! কে সেই ব্যক্তি? অনেক খুঁজেপেতেও অবশ্য রাহুল গান্ধী ছাড়া অন্য নাম মাথায় আসবে না। সেখানেই চালটা চেলেছেন মোদিজি। বাকি বিরোধী নেতানেত্রীদের স্রেফ অবজ্ঞা করো। গুরুত্ব দাও রাহুলকে। প্রচার দিয়ে যাও, কিন্তু নেগেটিভ। এটাই স্ট্র্যাটেজি। পাবলিক শুধু রাহুলের নাম শুনবে, কিন্তু ভরসা করতে পারবে না। উল্টোদিকে প্রচারের পাম্প খাবেন রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসও ভাববে, মোদি সরকার ভয় পেয়েছে বলেই রাহুলবাবাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিরোধীদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আর কেই বা থাকতে পারে!
কংগ্রেস বুঝছে কি না জানা নেই, অন্য বিরোধী দলগুলি কিন্তু এই স্ট্র্যাটেজি বুঝে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো স্পষ্টই বলে ফেলেছেন—রাহুল গান্ধীকে বিরোধী মুখ করে তোলাটাই বিজেপির এজেন্ডা। এতেই ওরা সুবিধা পাবে। ফলে বিরোধী জোটের জ্যামিতিতে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস নিয়ে এই মুহূর্তে মহা সংশয়। রাহুল গান্ধী অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। ভারত জোড়ো যাত্রা বের করছেন, বিলেতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করছেন, সংসদে বলার চেষ্টা করছেন। তাও কোনও কিছুই ক্লিক করছে না। কেন? কারণ একটাই, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভেবে নেওয়াটা অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছে এখনও বেশ কঠিন। অন্য বিরোধীরাও নিজেদের মতো ফের সমঝোতার বাতাবরণ তৈরি শুরু করে দিয়েছে। অখিলেশ যাদব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কে সি আর, লালুপ্রসাদ যাদব, ফারুক আবদুল্লা... নামের তালিকা বাড়ছে। এঁদের যুক্তি হল, ভোটের আগে জোট দরকার নেই। ‘শক্তি যার, আসন তার’ ফর্মুলায় লোকসভা নির্বাচনটা লড়ে নেওয়া যাক। গত ভোটের নিরিখে বিজেপির ভোটের হার কত? ৩৭ শতাংশ। এই সমঝোতা মেনে লড়তে নামলে বিরোধীদের আসন বিজেপির থেকে বেশি হতে বাধ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য পরিষ্কার, কংগ্রেস যদি এই কৌশল মেনে আসতে চায়, আসুক। অখিলেশও একই কথা বলছেন। বাকি থাকল লালুপ্রসাদ যাদব এবং কে সি আর। লালুজিকে একটু হাওয়া দিলে অবশ্য তিনি বা তাঁর দল সোনিয়া গান্ধীর দিকে ঝুঁকে যেতেই পারেন। আর কে সি আর? কখন তিনি শাসকের দিকে ঘুরে যাবেন, সেই শঙ্কা থেকেই বেরতে পারে না অন্য বিরোধীরা। ফলে শঙ্কার মেঘ থেকেই যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য, এই মেঘটাই আরও ঘন এবং বিপজ্জনক করে দেওয়া। নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধীরা যতই মারামারি করবে, ততই তাঁর লাভ। ততক্ষণ সর্বত্র তিনি তাঁর প্রভাব নিশ্চিত করবেন। তবে হ্যাঁ, পারমুটেশনটা একটু বেশি করতে হবে। তিনি কণ্ঠরোধ করবেন বিরোধীদের। সংসদ অধিবেশনে মাইক্রোফোন ‘খারাপ’ হয়ে যাবে। সংসদ টিভিতে স্পিকার বলার সময় শোনা যাবে, কিন্তু বিরোধী এমপিদের বক্তব্য হারিয়ে যাবে প্রযুক্তির অন্ধকারে। বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে-অফিসে এজেন্সি হানা দেবে। মামলা চলবে মাসের পর মাস। সেই এমপি-এমএলএদের বন্দিত্বের মেয়াদও বাড়বে। এরপরও যদি কাজ না দেয়, তিনি স্যামুয়েল অল্টম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই পারেন। কে এই অল্টম্যান? ‘ওপেন এআই’য়ের সিইও। তাঁর সংস্থার তৈরি চ্যাটজিবিটি এখন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলেছে। একের পর এক আপগ্রেডেড ভার্সান তৈরি করছেন তাঁরা। গত ১৪ মার্চ বাজারে এসেছে জিবিটি-৪। হিসেব বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সফ্টওয়্যারটি অন্তত ২০টি চাকরির বাজার শেষ করে দিতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষক, আইনজীবী, রিপোর্টার, ট্রাভেল এজেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারের মতো পোস্ট। মোদি সরকারের রণনীতির অধিকাংশটাই ঘিরে থাকে প্রোপাগান্ডা এবং সোশ্যাল মিডিয়া। জিবিটি-৪ তাঁরা একবার কাজে লাগিয়ে দেখতেই পারেন। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা শুধুমাত্র ফেসবুকের তথ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একটা গোটা নির্বাচনের নিয়তি বদলে দিয়েছিল। আর জিবিটি-৪ তো একমাসের মধ্যে ইউটিউবে টাকা কামানো, সোশ্যাল মিডিয়ার এনক্রিপটেড অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়া, এমনকী টুইটারের অ্যালগরিদম ভেঙে দেওয়ার দাবিও করছে। কাজেই স্যাম অল্টম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মোদিজির কুর্সি নিশ্চিত করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে লোক রাখতে হবে না। আর তারপর দুশ্চিন্তাতেও থাকতে হবে না।
এও এক জিওমেট্রি। তবে জটিলতম। এর আকার নির্ধারণ, আর বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া একই ব্যাপার। মোদিজিও কিন্তু বাঘের পিঠেই সওয়ার হয়েছেন। কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, ‘বিরোধীদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত ইডির প্রতি। এই এজেন্সির জন্যই অন্তত তারা জোটবদ্ধ হতে পারছে।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বোধহয় বিজ্ঞানটা ভুলে যাচ্ছেন। পাস্কালের সূত্র কী ছিল? বদ্ধ কোনও তরলকে চাপ দিলে তা সেই তরলের প্রত্যেকটি বিন্দুতে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, একসময় চাপ বেশি হয়ে গেলে তরল পদার্থও কঠিন আধার ভেঙে বেরিয়ে আসে। চব্বিশের ভোটে তেমন কিছু হবে না তো?