২০ জুন বিকেল পাঁচটায় জাহাজ প্রিন্সেপ ঘাট ছাড়ল। সেখান থেকে ডায়মন্ড হারবার কতই বাদূর! ওইটুকু পার হয়ে সমুদ্র পৌঁছতে লেগেছিল প্রায় দুদিন—২২ তারিখ দুপুর। তার কারণ, এই মোহনা অঞ্চলে জাহাজকে দুটি বালির চর পার হতে হয়—বজবজের কাছে একটি ও ডায়মন্ড হারবারের মুখে একটি। ভাঁটার সময় এ-দুটি জায়গার কাছে জাহাজ গেলে চরে ধাক্কা লেগে উলটে যেত। তাই দিনের বেলা বান আসার জন্য অপেক্ষা করতে হত। এই দুটি দিন গঙ্গাবক্ষে জাহাজ থাকাতে যাত্রীরা তীরের শোভা উপভোগ করছিলেন। স্বামীজীর কলমে তার বর্ণনা একটু উপভোগ করা যাক: “সে নীল-নীল আকাশ, তার কোলে কালো মেঘ, তার কোলে সাদাটে মেঘ, সোনালী কিনারাদার, তার নীচে ঝোপ-ঝোপ তাল-নারিকেল-খেজুরের মাথা বাতাসে যেন লক্ষ লক্ষ চামরের মতো হেলছে, তার নীচে ফিকে ঘন ঈষৎ পীতাভ, একটু কালো মেশানো—ইত্যাদি হরেক রকম সবুজের কাঁড়ি ঢালা আঁব-নিচু-জাম-কাঁটাল—পাতাই পাতা-গাছ ডালপালা আর দেখা যাচ্ছে না, আশে পাশে ঝাড় ঝাড় বাঁশ হেলছে, দুলছে, আর সকলের নীচে—যার কাছে ইয়ারকান্দি ইরানী তুর্কিস্তানি গালচে-দুলচে কোথাও হার মেনে যায়! সেই ঘাস, যতদূর চাও—সেই শ্যাম-শ্যাম ঘাস, কে যেন ছেঁটে ছুঁটে ঠিক করে রেখেছে; জলের কিনারা পর্যন্ত সেই ঘাস; গঙ্গার মৃদুমন্দ হিল্লোল যে অবধি জমিকে ঢেকেছে, যে অবধি অল্প অল্প লীলাময় ধাক্কা দিচ্চে, সে অবধি ঘাসে আঁটা।...” স্বামীজীর সঙ্গে নিবেদিতার জাহাজযাত্রা এভাবে শুরু হল। স্বামীজীর মনের ও ব্যক্তিত্বের বহু অজানা দিক তাঁর কাছে উন্মোচিত হয়েছিল এই কালে। নিবেদিতা অভিভূত। লিখছেন: শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ-যাত্রায় স্বামীজীর চিন্তা ও গল্পরাশির স্রোত বইছিল। বলা যেত না কোন মুহূর্তে দেখা যাবে অন্তর্দৃষ্টির ঝলক, আর শোনা যাবে নতুন সত্যের বলিষ্ঠ উচ্চারণ। প্রথম দিন বিকেলে আমরা যখন নদীর ওপর জাহাজে বসে গল্প করছিলাম, তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, “যত দিন যাচ্ছে, তত আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, পৌরুষই (manliness) জীবনের সার বস্তু। এই আমার নূতন বার্তা।” গঙ্গার উপর সেই দুদিন স্বামীজী ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছিলেন—শিবরাত্রি উৎসব, কালজয়ী সেই বীরগণ—পৃথ্বীরাজ, বিক্রমাদিত্য এবং তাঁর সিংহাসন, বুদ্ধ ও যশোধরার কাহিনি। কোনও একটি ভাব বা বিষয় তিনি কখনও পুনরাবৃত্তি করতেন না। জাতিভেদের বিষয় আলোচনা, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কার্যাবলি, সর্বোপরি মানবজাতির জয়গান—এসব সমভাবে চলত। নিবেদিতা ‘The Master As I Saw Him’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ “আমাদের গুরুর আবির্ভাব এবং তিরোভাব দুটিই আজ অতীতের ঘটনা, কিন্তু যে-অমূল্য স্মৃতিসম্ভার তিনি অন্তরঙ্গদের হৃদয়ে রেখে গিয়েছেন, তার মধ্যে তাঁর এই মানবপ্রেমের চেয়ে মহত্তর আর কিছুই নেই।”
প্রব্রাজিকা জ্ঞানদাপ্রাণার ‘স্বামীজীর সঙ্গে নিবেদিতার সমুদ্রযাত্রা’ থেকে