মস্তিষ্কে ও হৃদয়ে দ্বন্দ্ব বাধলে হৃদয়ের কথাই শুনবে। মস্তিষ্ক হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রধান কেন্দ্র। সব বিষয়ের জ্ঞান লাভ করবার উপযুক্ত মানসিক শক্তি আমরা তা হতেই পাই। হৃদয় হচ্ছে মর্মস্পর্শী সমস্ত ভাব, আবেগ ও অনুভূতির কেন্দ্র। মস্তিষ্কবান লোক নানা শাস্ত্র, বিদ্যা ও বিজ্ঞানে পারদর্শী, পণ্ডিত, উপদেষ্টা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, কৌশলী ও নানা বিষয়ে দক্ষ হন। হৃদয়বান লোক দয়া, উদারতা, পরদুঃখে সহানুভূতি, সর্বজীবে প্রেম প্রভৃতি সদ্গুণে ভূষিত হন। হৃদয়ই মানুষকে সর্বোচ্চভাবের প্রেরণা দেয় ও আত্মানুভূতির রাজ্যে নিয়ে যায়, যেখানে বুদ্ধিবিচারের প্রবেশাধিকার নেই। বিদ্বান ব্যক্তি স্বার্থপর, নিষ্ঠুর ও জঘন্য প্রকৃতির হতে পারে না। যত রকমে পার হৃদয়-বৃত্তির অনুশীলন করবে। হৃদয়ই প্রেমগঙ্গার গোমুখী। হৃদয়ের মধ্য দিয়েই ভগদ্বাণী শোনা যায়, হৃদয়কন্দরেই তিনি দর্শন দেন। তাঁকে পেতে হলে, জ্ঞান ভক্তি মোক্ষ লাভ করতে হলে শাস্ত্রজ্ঞান বা বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজন নেই। বই পড়ে চরিত্রগঠন বা মানুষ তৈরি হয় না—পণ্ডিত-মূর্খই জন্মায়।
‘গ্রন্থ নয়, গ্রন্থি’—গেরো, বন্ধন—ঠাকুর বলতেন। বিশেষতঃ আধুনিক বিদ্যাশিক্ষা তো জগাখিচুড়ি, অনেক স্থলেই মানসিক অজীর্ণতা আনে। ‘পাস’ করা নয়, পাশ গলায় পরা। কিন্তু হায়, ‘পাস’ করার কি মোহই না আমাদের পেয়ে বসেছে! জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনের সব মানসিক ও শারীরিক শক্তিটা ওতেই লাগাই, অনটন সত্ত্বেও ঐজন্যে কষ্টেসৃষ্টে টাকা যোগাড় করি, কত শারীরিক ও মানসিক উদ্বেগ সহ্য করি—ফল প্রায়ই স্বাস্থ্যনাশ এবং জীবন-সংগ্রামে হেরে গিয়ে চারদিক অন্ধকার দেখা! তার ওপর যদি বাল্যবিবাহের ফলে স্ত্রীপুত্রকন্যাদের ভরণপোষণও করতে হয় তো সোনায় সোহাগা। বিশ্ববিদ্যালয়কে যে গোলামখানা বলা হয়েছে তা মিথ্যা নয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষা যা দাঁড়িয়েছে তা অর্থকরীও নয়, কার্যকরীও নয়—অনর্থকারী, আত্মঘাতী। নৈতিক মেরুদণ্ডহীন, ধর্মে শ্রদ্ধাহীন, বিজাতীয়ভাবাপন্ন, জ্যান্তে মরা, তথাকথিত শিক্ষিতদের মধ্যেই বেশিরভাগকে দেখা যায়। নেহাত শুভসংস্কার যাদের তারাই বেঁচে ওঠে।
দুর্লভ মনুষ্যজন্ম পেয়ে তাঁকে পাবার চেষ্টা কর যাঁকে পেলে সব কিছুই পাওয়া হয়ে যায়, পাবার আর কিছু থাকে না। তাঁকে জানবার প্রযত্ন কর, যাঁকে জানলে সকল জিনিস জানা হয়ে যায়, জানবার আর কিছু থাকে না। তাঁকে ভালবাস যাঁকে ভালবাসলে আর সব ভালবাসা—কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি ছাইপাঁশ বলে মনে হবে। এমন ভাবে জীবন গঠন কর যে, মৃত্যুহীন জীবন লাভ করতে পার।
স্বামী বিরজানন্দের ‘পরমার্থ-প্রসঙ্গ’ থেকে