যেখানে ব্যক্তি সেখানেই না সুখ দুঃখের কথা। স্ত্রী, স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়া যে আসক্তিতে আচ্ছন্ন, যখন কঠিন ব্যাধি হয়, বড়ই জ্বালায় যখন ছটফট, তখন স্ত্রী, স্বামী, পুত্র কন্যার কথা চিন্তা করিবার স্থান কোথায়? নিজেকে নিয়াই নিজে হাহাকার নয় কি? সেই সময়কালীন উহার যে মোহের বন্ধন প্রধান নয়, দেহের উপর যে মোহ তাহাই হয় প্রধান। নিজে আছে তাই সকল আছে। এদিকে এই নিয়াই জীবের আসা যাওয়া গতাগতির কথা উঠে। এখানে ধর যিনি ভগবানেতে অনুরক্ত, সেখানে কিন্তু দেহাভিমান নাশের দিক্। তাহা হ’লে এই মোহ, এই বন্ধন নাশ অর্থাৎ বাসনা নাশ না, স্ব। যেখানে বাস কর ‘স্ব না’ রূপেতে প্রকাশ, তার নাশই হয় অর্থাৎ নাশই নাশ হয়। আবার জাগতিক কামনা যা’ বল তার মানেও এই, স্ব প্রকাশের কর্ম নয় বলিয়া যে কর্ম। সে নয়, এই তো হইল আসল কথা, যা বল?
এ শরীর আরও একটি দিকের কথা বলে, কি জান? ইষ্ট যেমন স্বয়ং, নাশও সেই স্বয়ং, নষ্টও সে স্বয়ং। স্বয়ং যেখানে কথাটা থাকে—একমাত্র। তবে আর কার সঙ্গ? তাই না নিঃসঙ্গ অসঙ্গ কথাটা হয়। ছদ্মবেশী যাহাকে বলা হয়; ছদ্মবেশটা কে? সেই তো। জগৎ ব’লে যে কথা বল, জগৎ মানে গতি, আর যে বদ্ধ সেই জীব। বল না যত্র জীব তত্র শিব, যত্র নারী তত্র গৌরী। যেখানে গতাগতির প্রশ্ন থাকে না, বন্ধের প্রশ্ন থাকে না, তা’কে নিত্য বলত। এখন ধর যেখানে গতি, অতএব তার সেখানেই বা বন্ধন কোথায়? এক জায়গায় কি সে থাক্ছে? যে রকম এক যায়গায় থাক্ছে না বল তেমন মনোনাশেও তাকে খুঁজে পাচ্ছ না। যে হেতু এক জায়গায় বন্ধনে থাকছে না, সে হেতু সে মুক্ত বলতে পার কি? আচ্ছা যায় কি, আসে কি? গতি দেখ না সমুদ্রের দিকে। স্বয়ং স্ব-মুদ্রারূপে। এই যে তরঙ্গ জলেরই তো ঢেউ, জলেতেই তো লয়। আর জলই তো ঢেউতে, তাঁরই স্ব-অঙ্গ তো, ঐ জলই অঙ্গ। জল বরফ ঢেউ হবারও মূলে কি? এটাও তো একটা স্থানের কথা। ভেবে দেখ। উপমা সর্বাঙ্গীণ হয় না। তবে জগৎ দৃষ্টিতেও দেখলে তো। আসলে কি পেলে? দেখ। আচ্ছা, এক জায়গায় থাকে না ব’লে নিত্য নয় বলে থাক তো? কি থাকে না? কে থাকে না? কে আসে? কে যায়? পরিবর্তন-বদ্লানটা কি? কে? মূল ধর। সবই তো ছেড়ে যায়। সব ছেড়ে যায়—অর্থাৎ মৃত্যু মৃত্যু হয়ে যায়। কে যায়, কোথায় যায়, কেই বা আসে, কোথায়ই বা আসে? আসা যাওয়াটাই বা কে? আবার কোন ক্রিয়ারই কোন প্রশ্ন নাই, আসা যাওয়ার প্রশ্ন নাই—কোথায় জন্ম, কোথায় মৃত্যু? ভাব।
দেখ, এই যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, তোমরা বল্বে এক আত্মা। আবার তিনি সাকার রূপেতেও স্ব-আকার। স্ব যে সেই নিত্য যিনি আছেন তিনি আকার রূপেতে। তাঁর মধ্যে কি আছে? অক্রিয়া। কি অক্রিয়া? ভগবৎ কর্মই কর্ম আর সব অকর্ম, তোমরা বল না জগৎ দৃষ্টিতে। যে ক্রিয়ার সেখানে প্রশ্ন নাই। সেখানে আছে কি? না, স্ব-ক্রিয়া—স্বয়ং ক্রিয়া রূপেতে। স্বয়ং আকারে, এই জন্যই সাকার বলে। স্বয়ং গুণরূপে, এই জন্যই সগুণ বলে। ঈশ্বর, ঈশ্বরীয় যেখানে প্রকাশ স্বয়ং ক্রিয়মাণ, অকর্তা হয়েও। সেই তিনি সত্য, স্বরূপ।
গোপীনাথ কবিরাজ সংকলিত ‘আমি মা আনন্দময়ী বলছি’ থেকে