সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের সেনাবাহিনীতে প্রতিদিন আহত হচ্ছেন বহু সেনা। হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। মাঠের মধ্যেই তাঁবু ফেলে চিকিৎসা চলছে। কারও হাত-পা ভাঙা, কারও বা শরীরের কোনও অঙ্গ বাদ গিয়েছে। মাঠে সারাক্ষণ গাড়ি ভর্তি আহত সৈনিকরা আসছেন। দেখা গেল, তাঁবুতে চিকিৎসারত সৈনিকদের মুহূর্মুহূ চিৎকারে ফালা ফালা হচ্ছে এলাকা। সেই চিৎকারের প্রাবল্য এতটাই যে গাড়িতে করে আসা আহত সৈনিকের অনেকেরই হার্ট ফেল হচ্ছে! হিটলারের দুই সেনাপতি ঠিক করলেন এমন এক ব্যবস্থা করতে হবে যাতে এই চিৎকার আহতদের কানে না যায়। খবর গেল জার্মানির সেরা বাদ্যযন্ত্রীদের কাছে। তাঁরা সকলে মিলে একটানা একই সুর বাজিয়ে যাবেন দিনভর। চিৎকারের আওয়াজ ছাপিয়ে বাজল সঙ্গীতের সুর। তবে দুপুর এবং রাতে লাঞ্চ ও ডিনারের কারণে এক ঘণ্টা করে বন্ধ থাকে এই সঙ্গীত। সেনাদের চিকিৎসারত এক চিকিৎসক খেয়াল করলেন, এই দু’টি ঘণ্টাও সেনারা আর তেমন চিৎকার করছেন না। বরং সঙ্গীতের সুর তাঁদের মনে ও শরীরে আরাম এনে দিচ্ছে। গান দিয়ে কষ্ট লাঘব করার সেই শুরু!
গান শুনতে কে না ভালোবাসেন! বেশিরভাগ মানুষই গনের কথা বা সুরের প্রেমে পড়েন। সুর-ছন্দ-তাল-লয় মিলিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায়ও মিউজিক থেরাপির প্রয়োগ বহু পুরনো পন্থা। যদিও প্রাচ্যের দেশগুলি এখনও এই পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু পাশ্চাত্যে বহু বড় অস্ত্রোপচারের পর রোগীকে মিউজিক ও শাস্ত্রীয় ঘরানায় সুর শোনানোর রেওয়াজ আছে।
কী লাভ তাতে?
লঘু বাদ্যযন্ত্র বা সুর প্রথমে কানের মাধ্যমে প্রবেশ করে স্পিচ এলাকায়। তারপর তা প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে। মানুষের সবধরনের আবেগের কেন্দ্রস্থল এই হাইপোথ্যালামাস অঞ্চল। ওষুধের মধ্যে থাকা নানা রাসায়নিক যেমন শরীরে মিশে রোগের বিরুদ্ধে লড়ে, গানের সুরের ভিতরেও তেমন নানা রিদম ও শব্দতরঙ্গ থাকে— যা হাইপোথ্যালামাস থেকে শরীরের নানা কোষে ছড়িয়ে পড়ে বিকল্প চিকিৎসার মতোই কাজ করে। আবার গানের সুরের যে তরঙ্গ, তা ত্বকের রোমকূপের মাধ্যমেও শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। কোষে কোষে সুর ছড়িয়ে পড়ার এটিও একটি মাধ্যম। মূলত, স্ট্রেস কমাতে, হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ব্যথাবেদনা কমাতে এই থেরাপির বিশেষ কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। এমনকী, স্ট্রোক পরবর্তী রোগীদেরও সেতার, সরোদ, ভায়োলিনের মতো বাদ্যযন্ত্রের সুরের মূর্ছনায় রেখে শিথিল হয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সাড়া ফিরিয়ে আনার কাজেও মিউজিক থেরাপি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ইদানীং আমাদের দেশেও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এই চেষ্টা শুরু হয়েছ।
তাহলে কি ওষুধের বিকল্প গান?
অসুখে ওষুধ সবসময়ই প্রয়োজন। কিন্তু ওষুধের সঙ্গে সঙ্গীতকে জুড়ে দিলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। পেন ম্যানেজমেন্টের বেলায় কিন্তু মিউজিক্যাল পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি সফল। সেক্ষেত্রে গান নিজেই একটি ওষুধ হয়ে উঠছে।
তাহলে কি ব্যথা হলেই গান শুনব আর সেরে যাবে?
বিষয়টি এত সরল নয়। প্রত্যেকটি মানুষের শরীরের জটিলতা ভিন্ন। সেই অনুপাতে তাঁদের জন্য গানও আলাদা হবে। কার শরীর কী ধরনের সুর ও কণ্ঠসঙ্গীতে বেশি আন্দোলিত হবে, কার কোনটি প্রয়োজন তা ঠিক করেন পেশাদার থেরাপিস্টরা। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে যে হাতে গোনা কয়েকটি সংস্থায় এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়, তাঁরা পেশাদার থেরাপিস্টের সাহায্য নিয়েই কাজটি করেন। একই রকমের শারীরিক সমস্যা আছে, এমন কয়েকজন রোগীকে একত্র করে সঙ্গীতের সুর শোনানো হয়। সঙ্গীতজ্ঞ ও থেরাপিস্টদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে এই অভ্যেস জারি রাখলে এতে ফলও মিলছে।
কীভাবে গান শুনলে লাভ
অনেকেই ভাবছেন, সারাদিনই তো সুর শুনছি বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনার চেষ্টা করছি, কই মানসিক আরামের বাইরে আর তো কিছুই হচ্ছে না! ব্যথা-বেদনা কোথায় কমছে?
আসলে গান শোনার পদ্ধতির উপর লুকিয়ে আছে এই থেরাপির সাফল্য। আর প্রয়োজন দীর্ঘদিনের অভ্যেস। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বেশ কয়েক মাস ধরে গায়ক বা যন্ত্রীর সামনে বসে বা তাঁর দশ-বারো ফুটের মধ্যে অবস্থান করে সুর শুনলে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নানা উপকার হয়। গান শুনতে হবে সরাসরি। কোনও মাইক্রোফোন, প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্র বা হেডফোনের মাধ্যমে নয়। তাতেই মিলবে উপকার। যেমন:
• অনিদ্রা, স্লিপ ডিজঅর্ডারের নানা সমস্যা কাটাতে রাতে এই থেরাপি খুব কাজে আসে। তাই ঘুমোতে যাওয়ার আগে কিছু রাত্রিকালীন রাগ শোনার পরামর্শ দেওয়া হয়।
• মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমাতে গান অব্যর্থ ওষুধ। স্নায়ুকে শীতল করে মানসিক উত্তেজনা পরিহার করে নানা মৃদু সঙ্গীত।
• ব্যথা-বেদনা সারাতে সুরের শব্দতরঙ্গের বিশেষ ভূমিকা প্রমাণিত। দীর্ঘদিন ধরে রোগীকে গান শোনানোর পেশাদারি থেরাপি দিলে উপকার হয়।
• অটিজম আক্রান্তরাও মিউজিক থেরাপিতে ভালো থাকে। সাধারণত কম বয়সেই এই রোগ ধরা পড়ে। তখন থেকেই শিশুর চিকিৎসা ও নানা থেরাপির পাশাপাশি মিউজিক থেরাপি চালু করলে, শিশু চিকিৎসায় দ্রুত সাড়া দেয় ও ভালো থাকে।
• অবসাদ, ক্রোধ, ক্ষোভ, লোভ ইত্যাদি নানা নেতিবাচক আবেগকে সঙ্গীতের সুরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
• গর্ভাবস্থায় লঘু সুর ও মৃদু গান ভ্রুণের স্বাস্থ্য ও মন ভালো রাখে।
• গানের সুর হার্টরেটও ভালো রাখে। মনের চাপ কমিয়ে হার্টকে তরতাজা রাখে গান।
কখন কোন রাগ?
রোগীকে কোন সময় গান শোনানো হচ্ছে, থেরাপি নির্বাচনের সময় সেটিও খেয়াল রাখা হয়। ভারতে যেমন সকালের দিতে ভৈরবী রাগ আদর্শ। পিলু গাইতে হবে দুপুরে। সন্ধ্যায় থেরাপি দিলে অনেক সময় ভরসা করা হয় ইমন রাগের উপর। রাতে রোগীর শরীরে ভালো কাজে আসে কেদার রাগ।