সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
এই ব্যান্ডেল গির্জায় যুগ যুগ ধরে মাদার মেরির মূর্তি আর জাহাজের একটি মাস্তুল স্বমহিমায় বিরাজমান। কিন্তু এই গির্জায় জাহাজের মাস্তুল এল কীভাবে? সেটা জানতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক শতাব্দী।
সালটা ১৪৯৮। পালতোলা জাহাজে চড়ে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা -গামা উপস্থিত হলেন ভারতবর্ষে। সঙ্গে ১৬০ জন নাবিক। ভারতবাসী সানন্দে সেদিন গ্রহণ করেছিল সেই বিদেশি অতিথিদের। এই ঘটনার পর ইউরোপীয়দের কাছে খুলে যায় ভারতে আসার জলপথ। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এলেও পরবর্তীকালে দেশ জয়ের নেশা পেয়ে বসল পর্তুগিজদের। গোয়া, দমন, দিউ, কোচিন, বোম্বাই প্রভৃতি ছোট ছোট রাজ্যগুলো অধিকার করার পর তাঁদের নজর পড়ল বঙ্গদেশের উপর। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব মহম্মদ শার কাছ থেকে বাণিজ্যের অনুমতি পেয়ে সরস্বতী নদীর তীরে সপ্তগ্রামে তারা বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তুলল। পরবর্তীকালে সরস্বতী নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পর্তুগিজরা সপ্তগ্রাম ত্যাগ করে। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের অনুমতিক্রমে ভাগীরথী নদীর তীরে তারা বসতি গড়ে তোলে। নবনির্মিত এই শহরের নাম হয় ‘উগোলিম’। হোগলা বনের প্রাচুর্যের জন্য লোকমুখে ‘উগোলিম’ নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘হুগলি’ নাম ধারণ করে। হুগলি শহর গোড়াপত্তনের কিছুদিন পর থেকেই পর্তুগিজ মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের জন্য সপ্তগ্রামের কাছে ব্যান্ডেলে আসতে শুরু করেন। ব্যান্ডেল তখন একটা অজগাঁ। এখানেই তাঁরা নিজেদের প্রধান ধর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন। এই অঞ্চলের অনেক অধিবাসীই এই সময় মিশনারিদের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে এইভাবেই ঐতিহাসিক ব্যান্ডেল চার্চের গোড়াপত্তন।
মুঘল সম্রাট আকবর পর্তুগিজদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দিলেও পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা তাঁদের প্রতি এত সহৃদয়তার পরিচয় দেননি। আকবরের পর তাঁর পুত্র জাহাঙ্গির সম্রাট হন। তারপর বংশানুক্রমে মুঘল সিংহাসনের অধিকারী হন সম্রাট শাহজাহান। সুদক্ষ পর্তুগিজ যোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে এঁটে উঠতে না পেরে মুঘল সেনাপতি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এরপর মুঘল যোদ্ধারা গোপনে পর্তুগিজদের দুর্গে প্রবেশ করে। সেই লড়াইয়ে পাঁচজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকের মধ্যে একমাত্র ফাদার জোয়াও দ্য ক্রুজ রক্ষা পান। বন্দি করে তাঁকে আগ্রা নিয়ে যাওয়া হয়। কথিত আছে, হাতির পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয় ফাদারকে। কিন্তু হাতিটি পায়ে পিষে মারার পরিবর্তে ফাদারকে সসম্মানে তার পিঠে তুলে নেয়। এই ঘটনায় শাহজাহান ফাদার ও তাঁর অনুচরদের ব্যান্ডেলে ফেরার অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে ৭৭৭ বিঘা জমি দান করেন। শাহজাহানের দান করা সেই জমির ওপরই সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ব্যান্ডেল চার্চ। এদিকে, মুঘল যোদ্ধারা যখন পর্তুগিজদের উপর হামলা চালায়, সেই সময় টিয়াগো নামে এক বণিক মাদার মেরির মূর্তিটি নিয়ে হুগলিতে ঝাঁপ দেন। এরপর মূর্তি বা টিয়াগোর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায় না। ফাদার জোয়াও দ্য ক্রুজ আগ্রা থেকে ব্যান্ডেলে ফিরে আসার পর গির্জা সংস্কারে উদ্যোগী হন। ফাদারের মনে সর্বক্ষণই সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আর মাতা মেরির পবিত্র মূর্তির চিন্তা তাড়া করে বেড়াত। রাতের বেলা উদাস নয়নে তিনি হুগলি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একদিন গভীর রাতে হঠাৎ করে শুরু হল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। তিনি করজোড়ে প্রভু যিশুর নাম স্মরণ করতে থাকলেন। তার পরের দিন নাকি নদীর পাড়ে মেলে মাদার মেরির সেই হারিয়ে যাওয়া মূর্তি।
আরও একটি অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হন ফাদার। যখন পূর্ণ উদ্যমে মূর্তি স্থাপনের কাজে সকলে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ সকলের নজরে আসে একটা পর্তুগিজ জাহাজ গঙ্গার ঘাটে এসে ভিড়ল। জাহাজের ক্যাপ্টেন একটা মাস্তুল হাতে উপস্থিত হলেন গির্জায়। সকলেই হতবাক। জানতে চাইলেন এর প্রকৃত কারণ। ক্যাপ্টেন জানালেন যে, তাঁদের জাহাজ বঙ্গোপসাগরে এক প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হয়। তখন প্রভুর কাছে তাঁরা প্রার্থনা করেন এই বিপদ থেকে রক্ষা পেলে, যাত্রাপথে প্রথম যে গির্জা চোখে পড়বে, সেখানে তাঁরা এই মাস্তুল দান করবেন। ফাদারের ইচ্ছায় সেই মাস্তুল গির্জায় স্থাপন করা হয়।
৩৫ ফুট লম্বা সেই মাস্তুল ব্যান্ডেলের গির্জায় সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ২০১০ সালের ৯ মে সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিতে এই মাস্তুল ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। তবে পুরাতত্ত্ব বিভাগ মাস্তুলটিকে আবার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। একটি কাচের বাক্সে সেটিকে সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে।