সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
সপ্তদশ শতাব্দীর চারের দশকের নেদারল্যান্ড। তখনকার ডেলফ্ট শহর এখনকার মতো এমন ঝাঁ চকচকে নয়। সময় চলতে থাকে তার নিজের ছন্দে। ছোট ছেলেটা এখন কিশোর। এরই মধ্যে পুরসভায় একটা চাকরি পায়। যদিও তেমন বড় কিছু নয়, ঝাড়ুদারের কাজ। মুদির দোকানের চেয়ে মাইনে কিছুটা হলেও বেশি। কর্মস্থলের খুব কাছেই একটা চশমার দোকান। রোজ ওই চশমার দোকানের সামনে অসীম কৌতূহলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। খুব মন দিয়ে দেখে কেমন করে কারিগররা কাচ ঘষে চশমা তৈরি করে।
কাচগুলোকে সুন্দর করে ঘষে মাঝখানটা উঁচু করতে পারলেই তৈরি হয় লেন্স। ছেলেটাও স্বপ্ন দেখে সুন্দর সুন্দর লেন্স তৈরি করার। এক অমোঘ আকর্ষণে সে যেন বারবার তাড়িত হয়। ডিউটি আওয়ার্স শেষ হতে দিনের শেষে বাড়ি ফেরে। তখন শুরু হয় এক নতুন কাজের সময়। তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজ। খুব যত্ন করে কাচ ঘষে লেন্স তৈরি করে ছেলেটা। যত দিন যায় চশমার দোকানের চেয়েও সুন্দর সুন্দর লেন্স তৈরি হয় ওর হাতে। অদম্য উৎসাহে কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দেয় সে। আরও ভালো লেন্স তৈরি করতে হবে। নিজের সৃষ্টি, নিজের পরীক্ষানিরীক্ষা, গবেষণা চলতে থাকে নিরন্তর। একদিন লেন্সটাকে চোখের সামনে ধরে দেখে ভারী অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। লেন্সের মধ্যে দিয়ে যেকোনও জিনিসকে দ্বিগুণ বড় দেখাচ্ছে!
উৎসাহ আরও বেড়ে যায়, শুধু সুন্দর করে লেন্স তৈরি করলেই তো হবে না, এবার সেগুলোকে একটা পরিণত রূপ দিতে হবে। তামার পাত দিয়ে তৈরি একটা ফাঁপা নল এর মাথায় জুড়ে দেয় লেন্সটা। বেশ একটা যন্ত্রের মতো দেখতে লাগে। হ্যাঁ, এটাই পৃথিবীর প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র। যদিও ছেলেটা তখন অত শত বুঝত না। সে তো শুধু আবিষ্কারের নেশাতেই মত্ত ছিল। একদিন নিছক কৌতূহলের বশেই এক ফোঁটা জলের ওপর তার অণুবীক্ষণ যন্ত্রটা ধরল। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না ছেলেটা! কী বিচিত্র অদ্ভুত দর্শন সব জীব ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই এক ফোঁটা জলের মধ্যে! বিজ্ঞানের জগতে খুলে গেল আরও এক নতুন দরজা। সারাদিন ঝাড়ুদারের কাজ আর দিনশেষে বাড়ি ফিরে আবিষ্কারের জগতে মত্ত হয়ে থাকা— এই ছিল তার জীবন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা এখন এক পূর্ণবয়স্ক মানুষ । ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কত কিছুই তাঁর লেন্স দিয়ে দেখেন আর খাতায় টুকে রাখেন। খুব সচেতনভাবে যে, তিনি এই কাজগুলো করেন, তা নয়। এই কাজটার মধ্যে তিনি এক অনাবিল আনন্দ পান। ভাগ্য তো আর সবসময় বিরূপ থাকে না। তাঁর এই আবিষ্কারের কথা রয়্যাল সোসাইটিকে জানান তাঁরই এক শুভানুধ্যায়ী। কিন্তু একজন ঝাড়ুদারের এত পয়সা কোথায় যে নেদারল্যান্ড থেকে লন্ডন যাবেন! তবুও আশা আর প্রচেষ্টা কোনওটাই ছাড়েন না তিনি। রয়্যাল সোসাইটিকে চিঠি লিখে তাঁর যন্ত্রের কথা জানান। সেইসঙ্গে কয়েকটি যন্ত্রের নমুনাও পাঠিয়ে দেন। সে সময় রয়্যাল সোসাইটির স্বীকৃতি না পেলে বিজ্ঞানের জগতে কোনও আবিষ্কারই গুরুত্ব লাভ করত না। সোসাইটির বিদগ্ধজনেরা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখলেন যে, সত্যিই যন্ত্রটি অভিনব। খালি চোখে যা দেখা যায় না, সেসব অতি ক্ষুদ্র অতি সূক্ষ্মবস্তুও দ্বিগুণ বড় হয়ে ওঠে এই যন্ত্রটার নীচে। নড়েচড়ে বসলেন সোসাইটির কর্তারা। সেই ঝাড়ুদারকে ডাক পড়ল। তাঁকে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদে বরণ করা হল। যে সোসাইটিতে গণ্যমান্য বিজ্ঞানীরা ছাড়া কেউই সদস্য হতে পারতেন না। সেখানে একজন ঝাড়ুদার তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি পেলেন। এতক্ষণ যাঁর কথা বলা হল, তাঁর নাম অ্যান্থনি ফিলিপ ভন লিউয়েনহুক।
১৬৩২ সালের ২৪ অক্টোবর নেদারল্যান্ডের ডেলফ্টে জন্মগ্রহণ করেন লিউয়েনহুক। বিজ্ঞানের জগতে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৬৮০ সালে তিনি অণুজীবের অবাতবৃদ্ধি আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রমাণ করেন পতঙ্গের চোখ সরল নয়। আসলে পুঞ্জাক্ষি হল অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্ষুর সমাবেশ। তাঁর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমেই তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন শিরা ও ধমনীর সংযোগস্থলে রক্তজালক বর্তমান। শুধু তাই নয়, রক্তের মধ্যে রক্তরস ছাড়াও আছে আরও বিভিন্ন ধরনের কণিকা। মাছ, উভচর প্রাণী ও মানুষের লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে রয়েছে বিস্তার ফারাক। ঈস্ট, রটিফার, মাংসপেশী, স্নায়ুকোষ, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি সম্পর্কেও বিশদ তথ্য তিনি তুলে ধরেছেন আমাদের কাছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর এই নিরলস সাধনাকে সম্মান জানিয়ে রাশিয়ার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট এবং ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে তাঁরা হুকের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ব্যাকটেরিয়া প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমৃত্যু অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে তিনি গবেষণা করে গিয়েছেন এবং তাঁর জীবৎকালে প্রায় ২৫০টি অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। ১৭২৩ সালের ৩০ আগস্ট এই বিজ্ঞান সাধক পরলোকে গমন করেন।