আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
সুপ্রিয় নায়েক। মঙ্গলে কি তবে জল ভল্লুক? ‘একটা আঁশটে গন্ধ আর একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম । ঠিক মনে হল যেন একটা বেশ বড় রকমের ঝিঁঝি ‘তিন্তিড়ি তিন্তিড়ি’ বলে ডাকছে। আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে সেটা বুঝবার চেষ্টা করছি এমন সময় একটা বিকট চিৎকারে আমার রক্ত জল হয়ে গেল।
তারপর দেখলাম প্রহ্লাদকে, তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ডানহাতের মুঠোয় নিউটনকে ধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে এক-এক লাফে বিশ পঁচিশ হাত করে রকেটের দিকে চলেছে।
আর তার পিছু নিয়েছে যে জিনিসটা সেটা মানুষও নয়, জন্তুও নয়, মাছও নয়, কিন্তু তিনের সঙ্গেই কিছু কিছু মিল আছে। লম্বায় তিন হাতের বেশি নয়, পা আছে, কিন্তু হাতের বদলে মাছের মতো ডানা, বিরাট মাথায় মুখজোড়া দন্তহীন হাঁ, ঠিক মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা সবুজ চোখ, আর সর্বাঙ্গে মাছের মতো আঁশ সকালের রোদে চিকচিক করছে...’
‘...এমন সময় একটা দমকা হাওয়ার সঙ্গে আবার সেই আঁশটে গন্ধটা পেয়ে ঘুরেই দেখি ঠিক ওইটার মতো আরও অন্তত দু-তিনশো জন্তু দূর থেকে দুলতে দুলতে রকেটের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখ দিয়ে সেই বিকট ঝিঁঝির শব্দ—‘তিন্তিড়ি! তিন্তিড়ি! তিন্তিড়ি! তিন্তিড়ি! তিন্তিড়ি!’ মঙ্গল গ্রহের এমনই এক অদ্ভুত প্রাণীর কথা লেখা ছিল সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পে। প্রাণীটি যে ঠিক কী ছিল তা স্বয়ং প্রফেসর শঙ্কুও বুঝতে পারেননি। তবে কি প্রাণীটি আসলে ছিল অভিযোজনের ফলে তৈরি হওয়া নতুন কোনও জীব? মঙ্গলে ওই প্রাণী পৌঁছেছিল কীভাবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর অজানা। তবে মঙ্গল গ্রহকে ঘিরে রহস্য সবসময়েই দানা পাকায়। সেই সমস্ত রহস্যের সন্ধানে আধুনিক সময়ে বেশ কয়েকটি রোবট যান পাঠানো হয়েছে মঙ্গল গ্রহে। সেগুলি মঙ্গলগ্রহে প্রাণের সন্ধানে খোঁজ চালাচ্ছে। এমন অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা যে এমন ‘মানুষও নয়, জন্তুও নয়, মাছও নয়’ ধরনের প্রাণীর দেখা পাবে না তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। একথা বলার অন্যতম কারণটা হল ২০১৫ সালে পাওয়া একটি উল্কাপিণ্ড। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, উল্কাপিণ্ডটি আসলে ছিল মঙ্গল গ্রহের পাথর! পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর ৭৫০ কিলোমিটার দূর থেকে উদ্ধার করা ওই ৭১.৫ কিলোগ্রাম ওজনের উল্কাপিণ্ডে ছিল টার্ডিগ্রেড এর ডিম পাড়ার চিহ্ন! অর্থাৎ কয়েক কোটি বছর আগে হয়তো মঙ্গলে ছিল টার্ডিগ্রেড-এর মতো জীব। টার্ডিগ্রেড সম্পর্কে যাঁরা সামান্য খবরও রাখেন, তাঁরা জানেন কেমন সহ্যশক্তি আছে এই প্রাণীর। যে কোনও কঠিন পরিবেশে এরা বেঁচে থাকতে পারে! সহ্য করতে পারে ১৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। এমনকী হিমাঙ্কের ২৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচেও টিকে থাকতে পারে এরা। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে বায়ুশূন্য মহাকাশেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে এরা। সুতরাং মঙ্গলের ভয়াবহ জলবায়ুতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও রাখে টার্ডিগ্রেড। আর কোটি কোটি বছর ধরে মঙ্গলে বাস করতে করতে, জলবায়ুর সঙ্গে যুঝতে যুঝতে জল ভল্লুক হয়তো সত্যিই পরিণত হয়েছে এক অদ্ভুত প্রাণীতে?
কী এই জল ভল্লুক?
টার্ডিগ্রেড বা জল ভল্লুক! নাম যেমনই হোক না কেন, আকারে প্রাণীটি এতটাই ক্ষুদ্র যে তাকে দেখার জন্য মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতে হয়। আট পা যুক্ত এই বিস্ময়কর প্রাণীর নখশুদ্ধ থাবাও রয়েছে। ভল্লুকের সঙ্গে অণুজীবটির চেহারায় মিল থাকায় কেউ কেউ এই প্রাণীটিকে ‘জল ভল্লুক’ বলে ডাকেন। অতিক্ষুদ্র এই প্রাণীটি দেখতে আদুরে হলেও, যে কোনও কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। এমনকী যে পরিস্থিতিতে অন্য প্রাণীরা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে, সেখানেও টিকে যায় জল ভল্লুক। আর তাই, হিমালয় পর্বতে, সাগরের অতলে কিংবা দক্ষিণ মেরুতে জমে থাকা শ্যাওলা নিয়ে মাইক্রোস্কোপের তলায় রাখলেই দেখা মিলবে এই জল ভল্লুকের। দেখা যাবে তারা কেমন সামান্য জলেও সাঁতরে বেড়াচ্ছে! ক্ষুদ্রকায় প্রাণীটির ভল্লুকের মতো থাবা থাকলেও আসলে দেখতে অনেকটা শুঁয়োপোকার মতো। এরা দৈর্ঘ্যে ০.০৫ মিলিমিটার থেকে ১.২ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
বাসস্থান
এরা যেখানে খুশি বাস করতে পারে। পাহাড়ের ওপরে কোনও এক হ্রদের তলদেশে। কিংবা ধূসর মরুভূমিতে! আবার রেডিয়েশন বা তেজষ্ক্রিয়তাও সহ্য করার ক্ষমতা রাখে টার্ডিগ্রেড। সাঁতরে বেড়াতে পারে ফুটন্ত জলে। চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও কল্পনার বাইরে। জানা যাচ্ছে, সাগরের গভীরে যে চাপ থাকে, তাতে যে কোনও বস্তুই চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে, সেখানেও এরা অনায়াসে খেলে বেড়ায়। এমনকী, কোনও স্পেসস্যুট ছাড়াই এরা ভেসে থাকতে পারে মহাকাশে! ২০০৭ সালে একটি ইউরোপীয় গবেষক দল ১২ দিনের জন্য একটি ফোটন-এম৩ রকেটের সাহায্যে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রায় হাজার তিনেক জীবন্ত জল ভল্লুক পাঠিয়েছিলেন। টার্ডিগ্রেডগুলি যথারীতি পৃথিবীতে ফিরে আসে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন মহাকাশের মতো জায়াগাতেও জীবনযাপন করেছে জল ভল্লুক। এতএব একথা স্পষ্ট যে, পৃথিবীর বুকে সব ধ্বংস হয়ে গেলেও টিকে যাবে জল ভল্লুক।
আবিষ্কার
১৭৭৩ সালে জার্মান প্রাণীবিদ জোহান আগস্ট এফ্রেম গোজ জল ভল্লুক আবিষ্কার করেন। তিনি প্রাণীটির নাম দেন ‘টার্ডিগ্রাডা’। এই শব্দের অর্থ ‘স্লো স্টেপার’ বা ধীরে হাঁটে এমন প্রাণী। ১৭৭৬ সালে ইটালিয়ান জীববিজ্ঞানী ল্যাজারো স্পালানজানি আবিষ্কার করেন, নিজের দেহের ছোটখাট কিছু পরিবর্তন করে জল ভল্লুক যে কোনও কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম। বেশ কিছু কঠিন পরিস্থিতি যেখানে জল ভল্লুকের ধ্বংস নিশ্চিত, সেখানে এরা এমন এক অবস্থায় চলে যায় যে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় জল ভল্লুক বোধহয় প্রাণ হারিয়েছে! এই অবস্থার নাম ক্রিপ্টোবায়োসিস। এই অবস্থায় দেহ কার্যত সমস্তরকম কাজকর্ম করা বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ এরা শরীরের অন্দরের সমস্ত কাজকর্ম ০.১ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে। অসহনীয় পরিবেশে এরা নিজেদের পা এবং দেহ গোল করে গুটিয়ে নেয়। এই সময় এদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি জেলির মতো পদার্থ দ্বারা ঢাকা পড়ে যায়। সব মিলিয়ে এরা জলশূন্য একটি গোলাকার বলের আকার নেয়। গোলাকার এই জল ভল্লুককে বলে ‘টান’। এইভাবে এরা খাদ্য এবং পানীয় ছাড়া থাকতে পারে প্রায় ৩০ বছর! পরবর্তীকালে জলের সংস্পর্শে আসলেই এরা পুনরায় সজীব অবস্থায় ফিরে যায়। এমনকী এদের ডিমও উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়া অবধি ৩০ বছর পর্যন্ত না ফুটে থাকতে পারে! জল ভল্লুক এক ধরনের প্রোটিন তৈরিতে সক্ষম। এই প্রোটিন তাদের ডিএনএ’কে তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। অন্যদিকে জলের মধ্যে থাকার সময়ে অক্সিজেনের তীব্র অভাব হলে এরা নিজেদের প্রসারিত করে দেয়। ফলে জল ভল্লুকের প্রসারিত দেহের কোষ বেশি পরিমাণে অক্সিজেন শোষণ করতে থাকে ও এর ফলে তারা জলের তলায় কম অক্সিজেনেও টিকে যায়।
জল ভল্লুকের সহন ক্ষমতা নিয়ে অবাক হওয়ার আরও বাকি আছে। প্রায় ৭৫ বছর আগের করা এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ১২০ বছরের পুরনো ডিম ফুটেও নাকি জল ভল্লুক বেরিয়েছে! অবশ্য ওই গবেষণার সম্পূর্ণ তথ্য সেভাবে প্রকাশ পায়নি কোথাও। তাই গবেষণাটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। তবে এই জল ভল্লুক নানা ধরনের কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার অসীম ক্ষমতা অর্জন করলেও, স্বাভাবিকভাবে এদের বেঁচে থাকার সময় কয়েকমাস থেকে বড়জোর এক বছর।
খাদ্যাভ্যাস
তরল পদার্থ পান করেই বেঁচে থাকে টার্ডিগ্রেড। জলজ শ্যাওলা থেকে তরল শোষণ করে জল ভল্লুক। সেখান থেকেই সংগ্রহ করে পুষ্টি উপাদান।
টার্ডিগ্রেডের ছানা
জল ভল্লুক একসঙ্গে প্রায় ৩০টি ডিম পাড়ে। পরিবেশ ভালো থাকলে ৪০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে ছানা বের হয়।
চাঁদে জল ভল্লুক
বছর দু’য়েক আগের ঘটনা। একটি ইজরায়েলি মহাকাশ যান বেশ কিছু বইপত্র, ডিএনএ-এর নমুনা এবং কয়েক হাজার জল ভল্লুক নিয়ে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল। তবে সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করা হয়নি মহাকাশযানটির। তার আগেই চঁদের বুকে ভেঙে পড়ে ওই নভোযান। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, এই মুহূর্তে চাঁদে ছড়িয়ে পড়েছে কয়েক হাজার জল ভল্লুক। আর এই প্রাণীটি যে কোনও পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম। সুতরাং ভবিষ্যতে জল ভল্লুকরাই চাঁদের মাটি শাসন করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। হয়তো তখন চাঁদের মাটিতে পা দিলে সত্যিই তারা ‘তিন্তিড়ি তিন্তিড়ি’ শব্দ করে তেড়ে আসবে!
ছবি ও তথ্য : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে