সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
গুরু হরগোবিন্দ: কোনও পার্থক্য নেই। আমার ঈশ্বর একজনই। তার নাম সত্য। সত্যই সৃষ্টিকর্তা ও ক্ষমাসুন্দর।
জাহাঙ্গির: আমাদের এই পৃথিবী সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
গুরু হরগোবিন্দ: ঈশ্বর বিশ্বের স্রষ্টা। আবার তিনিই একদিন এই পৃথিবী ধ্বংস করবেন। এরকম লক্ষ লক্ষ পৃথিবী আরও আছে। আমরা কেউ সেটা জানি না। তবে অনুভূতি তীব্র হলে অনেক সময় যেন টের পাওয়া যায়। আমরা জানি না যে, সংখ্যায় কত। ঈশ্বর জানেন। তিনি সর্বশক্তিমান। কতটা শক্তি তাঁর? আমরা জানি না। সেটাও তিনিই জানেন।
জাহাঙ্গির: হিন্দু না মুসলিম? কাদের ধর্ম বেশি উন্নত?
গুরু হরগোবিন্দ: সত্যরূপী আলো নির্মাণ করেছেন। সেই আলো থেকে এই জগতের জন্ম। সৃষ্টিকর্তার মধ্যেই থাকে সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যেই থাকেন সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং ভালো অথবা মন্দ— সকলই সমান তাঁর কাছে। কে বেশি ভালো এরকম প্রশ্ন অবান্তর।
জাহাঙ্গির: কে যোগ্য শাসক?
গুরু হরগোবিন্দ: সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হল সত্য। অর্থাৎ ঈশ্বর।
শিখগুরু হরগোবিন্দকে দিল্লি ডেকে পাঠিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির। এই গুরুর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। দূর দূরান্ত থেকে তাঁর কাছে সব ধর্মের মানুষ যায়। সন্দেহ হচ্ছে জাহাঙ্গিরের। প্রতিদিন সকাল ও বিকেল, দু’বার করে দরবার বসান গুরু। সেখানে শুধুই যে ধর্মযাপন নিয়ে কথাবার্তা হয় তা নয়। জীবনের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে তাঁর শরণাপন্ন হয় মানুষ। এমনকী তিনি নিজে এক অসামান্য যোদ্ধা। বাবা অর্জন সিংকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছিলেন জাহাঙ্গির। সেই ক্ষোভ তাঁর আজও আছে। এমনকী একবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠান মুঘল সম্রাট। সঙ্গে ছিল আরও ৫২ জন রাজা। গোয়ালিয়র দুর্গে আটক রেখেও গুরুর প্রভাব কাটানো যায়নি। প্রবল বিদ্রোহ হয়ে যায় অমৃতসর থেকে লাহোর পর্যন্ত। জাহাঙ্গির তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
শিখগুরু হরগোবিন্দের শক্তি সম্পর্কে একটা সময় শ্রদ্ধাশীল তো বটেই, জাহাঙ্গির সমীহ করা শুরু করেন। কারণ একবার এই শিখ গুরুকে সঙ্গে নিয়েই জাহাঙ্গির গিয়েছিলেন শিকারে। দিল্লির ঠিক বাইরের এক জঙ্গলে। আচমকা জাহাঙ্গিরের সামনে এক বাঘ। জাহাঙ্গির কী করবেন? ঝাঁপ দিতে উদ্যত সেই বাঘ। হঠাৎ উড়ে এলেন যেন গুরু হরগোবিন্দ। তিনি দাঁড়ালেন বাঘ আর সম্রাটের মাঝখানে এবং তরবারি দিয়ে একাই লড়াই করলেন বাঘের সঙ্গে। জয়ীও হলেন। চমৎকৃত জাহাঙ্গির সেই প্রথম শিখ গুরুকে প্রণাম করলেন। জাহাঙ্গিরকে গুরু হরগোবিন্দ শিক্ষা দিয়েছেন প্রজাপালনে। বলেছিলেন, যে শাসকের অগ্রাধিকার প্রজাদের কষ্ট দূর করা, তিনিই ইতিহাসে চিরকালীন সম্মান পাবেন। এটাই মানবসভ্যতার নিয়ম।
কিন্তু এটা আসল গল্প নয়। এই কাহিনি বলার কারণ কী? কারণ হল দিল্লিতে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে দেখা করার অথবা নিজের ভক্তদের দর্শন দেওয়ার জন্য গুরু হরগোবিন্দ যেখানে এসে থাকতেন, সেই স্থানের আশ্চর্য এক মাহাত্ম্য। যার নাম ‘মজনু কা টিলা’।
তিনটি ধর্মের এক বিস্ময়কর মিলনস্থল মজনু কা টিলায় আজ দু’রকম মানুষের ভিড়। প্রেমিক-প্রেমিকা। নিরালা সময়যাপনের জন্য। আর দ্বিতীয় পর্যটকদের প্রিয় হল খাদ্য। তিব্বতের খাবার খেতে হলে কোথায় আসতে হবে দিল্লিতে? মজনু কা টিলায়। কিন্তু কে এই মজনু?
ষোড়শ শতাব্দীর এক সুফি সাধক। আসল নাম আবদুল্লা। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিবেদন করলেও আবদুল্লা নিজেকে ঈশ্বরের প্রেমিক হিসেবেই বিবেচনা করতেন। ডাক নাম নিয়েছিলেন মজনু। কিন্তু শুধুই একাকী সাধনা করব, এই জগতে এসেছি অথচ জীবজগতের কাজে আসব না— এই জীবনযাপন তো অর্থহীন। তাই সামান্য যেটুকু ক্ষমতা, সেই সাধ্য নিয়েই মজনু এক পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন জীবসেবার। যমুনা নদীর নৌকার মাঝি হয়েছিলেন। গরিব মানুষকে বিনামূল্যে তিনি যমুনা নদী পার করিয়ে দিতেন। তখন দিল্লির শাসক সিকন্দর লোধি। হঠাৎ জানা গেল এক গুরুজি এসেছেন দিল্লিতে। যমুনা তীরে তিনি থাকছেন। ১৫০৫ সালের ২০ জুলাই। মজনুর জীবনের বাঁক বদল হল। তিনি দেখতে পেলেন সেই গুরুকে। যাঁর নাম গুরু নানক!
শিখগুরু মহামানব গুরু নানকের সংস্পর্শে এসে প্রকৃত সাধনার সন্ধান পেলেন মজনু। আর গুরু বললেন, ‘এই যে তুমি স্বার্থহীনভাবে মানুষকে উপকার করে চলেছ, এটাই হল ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা। কোনও সাধনাই এর থেকে বড় হতে পারে না।’ মজনু গুরুকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিলেন আর হলেন বিশুদ্ধ সাধক। গুরু নানক এই মজনুর ঘাটের কাছে এসেছিলেন। তারপর আবার গুরু হরগোবিন্দও এই স্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন দিল্লিযাপনের জন্য। মজনুর কর্মস্থান তথা বাসস্থানের সেই পাহাড়ি অংশটির নাম হয়ে গিয়েছিল ক্রমেই ‘মজনু কা টিলা’। ১৭৮৩ সালে অকাল সেনার সেনাপতি যোদ্ধা বাঘেল সিং ধালিওয়াল শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকজি এবং ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দের স্মৃতিধন্য মজনু কা টিলায় গড়ে তুললেন এক গুরুদ্বার। দিল্লিতে প্রাচীন যে কয়েকটি গুরুদ্বার রয়েছে, মজনু কা টিলার এই গুরুদ্বারটি তার মধ্যে অন্যতম। এই অঞ্চলেই মুসলিম সাধক আবদুল্লার সঙ্গে দেখা হয় গুরু নানকের।
কিন্তু না, কাহিনি সমাপ্ত হল না। ১৯৫৯ সালে দলাই লামা তাঁর অনুগামীদের নিয়ে লাসা থেকে মধ্যরাতে পালিয়ে এসেছিলেন এক অবিস্মরণীয় সফর করে। গুপ্তঘাতকদের চোখ এড়িয়ে। আক্রমণকারীদের হাত এড়িয়ে। দীর্ঘ পরিক্রমার পর ভারতের দ্বারপ্রান্তে হাজির হন তিনি ও তাঁর অনুগামীর দল। এর পরের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। সেই যে দলাই লামার সঙ্গীরা, তারা একটা সময় ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। একটি বড় অংশ রাজধানী দিল্লির একটি বিশেষ অঞ্চলে তাঁরা বাসা গড়লেন। কোথায়? মজনু কা টিলা সংলগ্ন জনপদে। মুসলিম, শিখের পর মজনু কা টিলায় বহুত্ববাদের বহতা নদীতে মিশ্রিত হল তিব্বত থেকে আসা বৌদ্ধরা।
মজনু কা টিলায় অবিরত ভিড়। পর্যটকের। প্রেমিক-প্রেমিকার। খাদ্যরসিকের। ধর্মপ্রাণের। ইতিহাস সন্ধানীর। মজনু কা টিলা থেকে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা এক মহাপ্রাণ বিশ্বকবি লিখেছিলেন ভারতের আত্মার বাণী! সেই বাণী যেন মজনু কা টিলায় জীবন্ত হয়ে দেখা যায়। কী সেই বাণী?
‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’।