সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
গার্স্টিন প্লেসের নামকরণ হয় মেজর জেনারেল জন গার্স্টিনের নামানুসারে। যিনি ছিলেন বাংলার সার্ভেয়ার জেনারেল। পরবর্তীকালে ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছের এই ছোট্ট গলি কলকাতা কর্পোরেশন অধিগ্রহণ করে নাম দেয় গার্স্টিন প্লেস। মেজর জেনারেল গার্স্টিনের বর্তমান ঠিকানা সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমিট্রিতে। গার্স্টিন সাহেব আজ না থেকেও রয়ে গেছেন কলকাতার ইতিহাস আর মিথে।
একসময় গার্স্টিন প্লেসের ওই তিনতলা বাড়িটি ছিল ঐতিহ্যের অপর নাম। যে বাড়িতে একসময় যাতায়াত করতেন বহু গুণী শিল্পী। কিন্তু নানা কারণে এর সঙ্গে জুড়ে গেছে অলৌকিক তকমা। পুরনো নিস্তব্ধ লম্বা করিডর, অজস্র স্টুডিও, ব্রিটিশ কাঠামো যেন সেই দাবিকেই সমর্থন করে। শোনা যায়, ওই বাড়ি হওয়ার আগে এই অঞ্চলে ছিল এক কবরখানা। কোম্পানির শাসনের গোড়ার দিকে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে যে সব ইংরেজ মারা যেতেন, তাঁদের এখানেই সমাধিস্থ করা হতো। আবার এই গার্স্টিন প্লেসের পিছনেই রয়েছে সেন্ট জনস চার্চ। সেখানে রয়েছে জোব চার্নকের কবর, লেডি ক্যানিংয়ের কবর থেকে শুরু করে কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতি। রয়েছে রোহিলা যুদ্ধের স্তম্ভও। বলা বাহুল্য ভৌতিক পরিবেশের বা গল্পের জন্য আদর্শ প্রেক্ষাপট। সময়ের সঙ্গে যা আরও পোক্ত হয়েছে।
এখানকার ভৌতিক ঘটনার সাক্ষী হওয়া মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। যেই তালিকায় আছেন প্রথম সাহেব ডিরেক্টর পি ওয়ালিক থেকে পরবর্তী কালের নানান শিল্পী, কর্মী, প্রহরী অনেকেই। কখনও কেউ অনুভব করেছেন অশরীরী অস্তিত্ব! অফিস ঘরে স্বচক্ষে সাহেব ভূত প্রত্যক্ষ থেকে রেকর্ডিং রুমের বাইরে অশরীরী শ্রোতার দর্শন বিরল নয়। এমনকী, মাঝেমধ্যে তেনাদের উৎপাতও সহ্য করতে হয়েছে কাউকে কাউকে।
যেমন— ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ খ্যাত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রেরও এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছিলেন ‘ও বাড়ি ভূতুড়ে।’ একবার তিনি গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছিলেন ওই বাড়ির তিনতলার অফিসে। পরে নীচে এসে মনে পড়ে তিনি কাজের ফাইলটা ফেলে এসেছেন। তখন বেয়ারা মেহেরবানকে ফাইলটি আনতে পাঠালে আতঙ্কিত হয়ে ফিরে আসে সেই বেয়ারা। সে জানায়, তিনতলায় ঘরে এক সাহেব ফাইলপত্তর ঘাঁটছে। এমনকী তাঁকে নাকি অশরীরী তাড়াও করেছিল।
তাঁর নাম গ্যারি সাহেব। যার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ শুধু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রেরই নয়, হয়েছে অনেকেরই। একবার দুই কর্মী রেকর্ড আনতে গিয়েছেন অফিসের একটি ঘর থেকে। হঠাৎ কেউ একজন তাঁদের থেকে রেকর্ডটি কেড়ে নেয়! তাঁরা দেখেন, লোকটি এক সাহেব। যিনি মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। শিল্পী বিকাশ রায় তাঁর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন এই গ্যারি সাহেবের। সন্ধেবেলায় রেকর্ডরুমের আশপাশেই তিনি ঘোরাফেরা করতেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরির সময় লীলা মজুমদারের এক সহকর্মী সাহেব ভূত দেখে চাকরি ছেড়ে বেঁচেছিলেন। গ্যারি সাহেবের ফাইলপত্র তছনছ, আলমারি, মাইক্রোফোন ধরে টানাটানি এরকম উপদ্রবের সম্মুখীন হয়েছেন অনেকেই। আবার রাতের অফিসে গ্যারি সাহেবের পিয়ানো শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে কারওর কারওর।
অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঘোষক থাকাকালীন এক রাতে দেখেন অপরিচিত একজন অফিস রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। তখন তিনি গানের ট্র্যাক বাজাচ্ছিলেন। এতে বিরক্তি বোধ করায় পরে তিনি রিসেপশনে গিয়ে অভিযোগ জানালে, জানতে পারেন, কাউকে নীচ থেকে উপরে পাঠানো হয়নি। এমনকী, সিঁড়ি দিয়ে কাউকে উপরে যেতেও দেখা যায়নি। হয়তো কোনও অন্য অশরীরী সাহেব দেখা দিয়েছিলেন তাঁকে। সময়ে সময়ে অন্য ঘোষকরাও অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করেছেন ঘরে। আবার রাতের স্টুডিও থেকে ভেসে আসা অশরীরী যান্ত্রিক সঙ্গীত শুনে শিহরিত হয়েছেন অনেক কর্মীই।
এখনও নাকি রাতের শহরে সেইসব শব্দ ভেসে আসে মাঝেমধ্যেই। সত্যিই সেই শব্দ আসুক বা না আসুক আজকের দিনে দাঁড়িয়েও কান পাতলেই শোনা যায় গার্স্টিন প্লেসের নানা কথা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুরনো গার্স্টিন প্লেস আজকে অচেনা হলেও এর ছায়াময় জগৎ আজও রহস্যময়। ভূত মানে যেমন অশরীরী, তেমনই ভূত মানে ইতিহাসও বটে। আর ঐতিহ্যের ‘ভূতে’র সঙ্গে অশরীরী মিথের মিশেলে কলকাতার মধ্যেই বহাল তবিয়তে রয়েছে অন্য এক কলকাতা।