সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
কীসের তাবিজ? পারস্যের সবজওয়াড় থেকে এসেছেন এক সুফি সাধক। শেখ মাখদম সবজিওয়াড়ি। এসেছেন হিন্দুস্তানের দিল্লি নামের শহরে। যেখানে রাজত্ব করছে লোধি বংশের সুলতান। কোন সালে? কোন সুলতানের আমলে? বিতর্ক আছে। মতান্তর আছে। বাহলুল লোধির সময়কাল হল, ১৪৫১ থেকে ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ। আর তাঁর পুত্র নিজাম খান সিকন্দর লোধি সাফল্যের সঙ্গে রাজত্ব চালিয়েছেন ১৪৮৯ থেকে ১৫১৭ পর্যন্ত। ১৫১৭ সালে সিকন্দর লোধির মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেছিলেন তাঁর পুত্র ইব্রাহিম লোধি। যে কথা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্নমত, সেটা হল, এই অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সন্ত মখদম শেখ কবে এলেন দিল্লি? কোনও অভিমত বাহলুল লোধির শাসনকালের শেষ অধ্যায়ে। আবার কেউ কেউ মতপ্রকাশ করেছেন যে, সিকন্দর লোধির রাজত্বকালের প্রথমার্ধে।
মখদম শেখ পারস্যের সবজওয়াড়ে দৈব নির্দেশ পেয়েছিলেন স্বপ্নে। তাঁকে বলা হয়, হিন্দুস্তান নামক এক দেশের দিল্লি নগরীতে যাও। তোমার পরবর্তী সাধনজীবন ওখানেই সম্পন্ন হবে। সেই স্বপ্নাদেশ পেয়েই মখদম শেখের দিল্লি আগমন। দিল্লিতে এসে নগরীতে নয়। গ্রামীণ এলাকার অরণ্যে কুটিরে কিছু ভক্ত আর শিষ্য সহ থাকতে শুরু করলেন সন্ত মখদম শেখ। এক সুফি বাবা এসেছেন জঙ্গলে। সবথেকে আশ্চর্য হল, জঙ্গলের যে অংশে গ্রামবাসী যেতে সাহস পায় না বন্য জন্তুর ভয়ে, সেখানেই আস্তানা এই সন্তের। ক্রমেই জানা হয়ে গেল, আজকাল ওই জঙ্গলে প্রবেশ করলেও দেখা যাচ্ছে মানুষকে আক্রমণ করছে না বন্য জন্তুরা। এমনকী বাঘও নয়। কারণ কী? কারণ ওই সন্তের আশীর্বাদ এবং প্রভাব। তিনি যে অরণ্যে আছেন, সেখানে মানুষের ভীত হওয়ার কারণ নেই। তাঁর ইতিবাচক দৈব প্রভাবে সব বিপদ কেটে যায়।
স্বাভাবিকভাবে সুলতানের কানে যেতে দেরি হল না এই সংবাদ। অতএব তিনি দেখতে চাইলেন কে এমন নয়া সন্ত হাজির হল তাঁর রাজত্বের অন্দরে? যাঁকে আজকাল প্রজারাই ধন্য ধন্য করছে? সাধুই হোক অথবা সেনাপতি। যেকোনও মানুষের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই রাজা-মহারাজা সুলতানদের মধ্যে বরাবরই আশঙ্কার জন্ম হয়। কারণ জনপ্রিয়তার অর্থই হল মানুষের মধ্যে প্রভাব বৃদ্ধি। আর প্রভাবশালী মানুষের ক্ষমতাশালী হতে দেরি হয় না। অতএব শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ডেকে পাঠানো হল মখদম শেখকে। সুফি সন্ত যেতে চান না সুলতানের দরবারে। তিনি একটি ধর্মশালা করেছেন। সেখানে আসে গ্রামবাসী। পথিকের দল। হয় ধর্ম আলোচনা। কিংবা সাধন ভজন। এভাবেই তো দিন কেটে যাবে। এর মধ্যে আবার সুলতানের দরবারে যাওয়ার দরকার কী?
কিন্তু সুলতান ডাকলে তো আর ‘যাব না’ বলা যায় না। অতএব যেতেই হল। কিন্তু সুলতানের অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা তেমন ভালো লাগল না সন্তের। মুখে কিছু বলেননি। দুঃখিতচিত্তে ফিরে এলেন। অন্যদিকে ঝোঁকের মাথায় এবং ক্ষমতার দম্ভে হয়তো বাড়াবাড়ি অসৌজন্য হয়ে গিয়েছে, এতটা দরকার ছিল না, এরকম ভাবলেন সুলতানও। এখানে মনে রাখতে হবে ইনি কোন সুলতান সেটা নিয়ে মতান্তর আছে। অর্থাৎ বাবা বাহলুল লোধি? নাকি পুত্র সিকন্দর লোধি? কার দরবারে গিয়েছিলেন মখদম শেখ? স্পষ্ট নয় পুরোপুরি।
যাই হোক। সুলতান এবার ভাবলেন আমি নিজেই একবার যাই। দেখে আসি। আর কিছুটা ক্ষোভ লাঘব করাও দরকার। হাজার হোক গ্রামবাসী বহুলাংশে একজন সাধককে এভাবে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তাঁকে এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা উচিত নয়। সুলতান অরণ্যে ঘেরা ধর্মশালায় গিয়ে যা দেখলেন সে তো অবিশ্বাস্য! এক বাঘ বসে আছে সন্ত মখদম শেখের পাশে। আর সন্ত সেই বাঘকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। যেন কোনও এক গোরু ঘোড়া ছাগলের মতো নিরামিষাশী প্রাণী বাঘও।
সুলতানকে ঘোড়া থেকে নামতে দেখে সাধক মখদম বাঘকে নির্দেশ দিলেন, স্থানত্যাগ করতে। বাঘও অবনত মস্তকে চলে গেল। এরকম এক অলৌকিক দৃশ্য দেখে সুলতান বুঝলেন তিনি কী ভুলই না করেছিলেন সাধককে তচ্ছিল্য করে। অতএব তিনি কোনও দ্বিধা না করেই কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেন। প্রার্থনা করলেন দোয়া।
সিংহাসন থেকে নেমে এসে সুলতান সাধকের কাছে এসে ঔদ্ধত্য বিসর্জন দিচ্ছে দেখে মখদম শেখ খুশি। এবার এই সুলতানের সার্বিক চিত্তশুদ্ধি হল। ইনি দেশ শাসনের উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কারণ বিনীত হতে শিখেছেন। মক্কা থেকে এক রক্ষাকবচ নিয়ে এসেছিলেন মখদম শেখ। তাঁর বাহুতে বাঁধা ছিল সেই তাবিজ। নিজের তাবিজ খুলে মখদম শেখ পরিয়ে দিলেন সুলতানের হাতে। জানিয়ে দিলেন, যতদিন তোমার বংশ পরম্পরার উত্তরাধিকারী সুলতানরা এই তাবিজ পরে থাকবে, ততদিন তোমাদের বংশের রাজত্ব চলবে। তাই হয়েছিল। বহু বছর ধরে লোধিদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছিল।
দক্ষিণ দিল্লির হৌজ খাসের জনবসতির আড়ালে আজও উজ্জ্বল একটি সমাধিস্থল। শেখ মখদম সাহিবের সমাধি। মেফেয়ার গার্ডেন এলাকায় গেলে দেখা যাবে নির্জন একাকী হয়ে আজও শুয়ে আছেন ইতিহাসের অজানা পৃষ্ঠায় সাধক মখদম সাহিব। সমাধিস্থল বটে । তবে কোনটা তাঁর সমাধি? সেও এক রহস্য।
তার থেকে বড় রহস্য হল, ১৫২৬ সালে ইব্রাহিম লোধির পরাজয় ঘটল কেন? কোথায় সেই তাবিজ? তিনি কি পরেছিলেন বাবরের সঙ্গে যুদ্ধের সময়? নাকি তাবিজ উধাও হয়েছিল তার আগেই? গেল কোথায়?