আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
যতই দিন এগিয়েছে, ততই সিপিএমের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে। সেটি হল ‘উই নো অল’ সিনড্রোম। অর্থাৎ আমরা সব জানি। এই মনোভাবের ক্ষতিকর দিক হল, ক্রমেই বুদ্ধি বিবেচনা, মানুষের পালস বোঝার ক্ষমতা এবং নিরপেক্ষ রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষমতা লোপ পায়। তাই দেখা গিয়েছে সিপিএম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গভর্নমেন্টকে ‘গরমেন্ট’ বলা, হয়তো কবিতার ভুল প্রয়োগ, সভা-সমাবেশে অজ্ঞাতে বেঠিক তথ্য প্রদান, আরবান এলিট এডুকেটেড অ্যাটিটিউডের সঙ্গে মানানসই না থাকা আচার-আচরণ, বক্তব্যের ধরন ইত্যাদিকে অনেক বড় ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নেয়। আর মনে করে, ওই ভুলভ্রান্তিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিততে দেবে না কখনও। এই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিকে বোঝার চেষ্টা না করে, শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই বেশি করে সামনে নিয়ে এসে প্রচার করার মধ্যে সিপিএম যতটা মমতাকে এমব্যারাস করার আনন্দ পেয়েছে, হাসাহাসি করেছে, ততটা কিন্তু নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক এবং দলের শ্রেণি চরিত্র বজায় রাখতে পরিশ্রম করেনি। হঠাৎ করে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে চলে এসে সিপিএম প্রবলভাবে যখন ‘শিল্পই আমাদের ভবিষ্যৎ’ হিসেবে প্রচারে নিজেদের নিমজ্জিত করে ফেলল, তখন একবারও ভাবল না যে, নিজেদের এতকালের বেসিক পলিটিক্যাল ক্যারেক্টার থেকেই বেরিয়ে এসে সরাসরি কর্পোরেটের হয়ে কথা বলা এবং কৃষিজমি দখল করার হুমকির অর্থ হল— ১৯৬৪ সাল থেকে যে শ্রেণি তাদের সঙ্গে ছিল এবং ছিল প্রধান ভোটব্যাঙ্ক, সেই কৃষক তাদের পাশ থেকে সরে গেল। কৃষক সিপিএমকে বিশ্বাস করত। সেই কৃষক সিপিএমকে ভয় পেতে শুরু করল। আর এই দুর্দান্ত সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাজে লাগালেন।
মমতা কংগ্রেসের থেকে উঠে আসা নেত্রী। অর্থাৎ সিপিএমের ভাষায়, বুর্জোয়া কর্পোরেট দলের নেত্রী। কিন্তু তিনিই নিমেষে হয়ে গেলেন কৃষকদের রক্ষাকর্ত্রী। আর শ্রমিক-কৃষক ঐক্য জিন্দাবাদের দল সিপিএম হয়ে গেল কৃষকদের কাছে ভিলেন। এভাবে নিজেদের দলের শ্রেণিচরিত্র বদলে ফেলা সিপিএম আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। কারণ, তাঁরা ততদিনে একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে হাততালি আর সমর্থন পাওয়ার মায়াবী উজ্জ্বলতা আর গ্ল্যামারের সন্ধান পেয়েছে। সেই শ্রেণিটি হল ধনী ও শহুরে মধ্যবিত্ত। এই দুটি শ্রেণি কোনওদিনই স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য সরকার বা দলের উপর খুব বেশি নির্ভর করে না। এরা ইস্যু, হুজুগ, নাগরিক এজেন্ডা ইত্যাদিতে গা ভাসায়। তাই টাটা ও সালিম গোষ্ঠীর শিল্পসম্ভাবনায় তারা সিপিএমকে সমর্থনে গা ভাসালেও সিপিএমের গুন্ডাবাহিনী যখনই একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে শুরু করল, তখন রাজ্যে শান্তি বিঘ্নিত হওয়া ও এই ক্যাডাররাজত্ব দেখে বিরক্ত হয়ে ওই শ্রেণিটিও সরে এল সন্তর্পণে। সুতরাং ২০১১ এবং সিপিএম দেখল পায়ের নীচে মাটি নেই।
সিপিএমের মনোভাব, আচরণ এবং চরিত্র কি বদলে গিয়েছে গত ১০ বছরে? একেবারেই নয়। সিপিএম আজও মনে করেছে মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করে ভুল করছে। লক্ষ করা যাবে, সিপিএম একটা কথা খুব বলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো বিজেপিকে হাতে ধরে নিয়ে এসেছেন এই রাজ্যে। প্রশ্ন হল, এই রাজ্যে সিপিএম অনেক আগে থেকেই তো আছে। মানুষ তাদের কেন বেছে নিল না? মমতা হাত ধরে বিজেপিকে নিয়ে এলেন, আর মানুষও তাদের আলিঙ্গন করে ফেলল কেন? সিপিএমকে কেন পরিত্যক্ত খাতায় ফেলে দিল মানুষ? একটাই সিম্পল প্রশ্ন, কেন মানুষ সিপিএমকে ভোট দেয় না? কেন মানুষ ক্রমেই সিপিএমকে হারানো একটা মজার খেলায় পরিণত করেছে? কারণটা কী? এই প্রশ্নের উত্তর সিপিএম খোঁজারই চেষ্টা করেনি। শুধু অন্যদের খারাপ বলে গিয়েছে। সিপিএম নিজেদের উন্নত, শিক্ষিত, আদর্শবান এবং নীতির গজদন্তমিনারবাসী হিসেবেই বিবেচনা করে আজও। রাজনৈতিক শিক্ষা এবং বিশ্লেষণের সামান্যতম মেধা আর সিপিএমের মধ্যে দেখা যায় না। বিগত ১০ বছরে সিপিএমের ধারাবাহিক রাজনীতি কী ছিল?
কতটা বুদ্ধিহীন একটি পার্টি হলে ভোটের আগে টুম্পার গান আর আধুনিক ফ্ল্যাশ মব ডান্স দেখিয়ে প্যারোডি গানের সঙ্গে দিদি ও মোদিকে হারাতে চায় একটি কমিউনিস্ট দল? কেন সিপিএমের শ্রেণিচরিত্র বদলে গিয়েছে? একটি উদাহরণ। এবার ভোটে বিশেষ কিছু মুখকে সামনে নিয়ে এসে সিপিএম সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল প্রচার করেছে যে, এই প্রার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এঁরাই অন্য সব দলের থেকে ভালো। খুব ভালো কথা। কিন্তু আজই যে কোনও সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করা হোক সিপিএমের কৃষক নেতা কে? শ্রমিক নেতা কে? নিম্নবর্গের নেতা কে? দেখা যাবে মানুষ জানে না। কেন জানে না? কারণ সিপিএম এই শ্রেণির নেতাদের প্রজেক্টই করেনি। এককালে অন্য দলের সঙ্গে তাদের তো এখানেই ফারাক ছিল। যোগ্যতম শ্রমিক, কৃষক নেতা ছিলেন। অথচ সেই ফারাক তারা নিজেরাই মুছে দিয়েছে। সিপিএমের বর্তমান অভিমুখ আরবান এলিট এডুকেটেড মিডল ক্লাস অর্থাৎ সিপিএম শহুরে পার্টিতে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ক্রমেই গ্রাম, ব্লক, পঞ্চায়েত তো বটেই, শহরাঞ্চলেও নিজের একটা স্ট্রং পলিটিক্যাল মেসেজ দিয়ে ফেলেছেন বছরের পর বছর ধরে সেটা বুঝতে পারেনি বিরোধীরা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী নানাবিধ ভাতা দিয়ে মানুষকে বার্তা দিতে পেরেছেন যে, সরকার তাদের কথা ভাবে। যথাসাধ্য সামান্য হলেও সাহায্য করছে। এটা যতটা না পাইয়ে দেওয়া, তার থেকে বেশি কাঁধে হাত রেখে পাশে থাকার মেসেজ। সিপিএম ক্রমেই সব আদর্শ ও নীতিকে বিসর্জন দিয়ে একটিমাত্র লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল। সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিপিএমের রাজনীতি। সেটি হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাও। একটা কমিউনিস্ট পার্টি একজনমাত্র মহিলাকে পরাস্ত করাকে কেন্দ্র করে ওভার অবসেসড হয়ে গেল। তাই যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে, মমতাকে আমাদের দল আর হারাতে পারবে না, তখন সিপিএম ভোটাররা নরেন্দ্র মোদির মধ্যে পেয়ে গেল সেই স্বপ্নপূরণের সুযোগ। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক জমিতে শক্তিশালী যে প্রতিপক্ষের শূন্যতা এসেছিল, সেই শূন্যস্থান দখল করে নিতে আগ্রাসীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিজেপি। সিপিএমের ভোটব্যাঙ্ক ও নিচুতলার ক্যাডার প্লাস হিন্দু-মুসলিম তাস। এই হয়ে গেল বিজেপির শক্তি। এবং চূড়ান্ত সফল হয়ে গেল ২০১৯ সালে। সিপিএম ভেবেছিল এই ভোটাররা আবার ২০২১ সালে ফিরে আসবে। কেন আসবে? কারণ কী? তারা মমতাকে হারাতে চেয়েছে। তাই মোদির দলকে ভোট দিয়েছে ২০১৯ সালে। এবার ২০২১ সালে মমতাকে সরাসরি হারানোর সুযোগ। তাহলে তারা তো আরও বেশি করে মোদির দলকে ভোট দেবেন। এটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ সিপিএমে ফিরতে যাবে কেন? সিপিএম একটি বিশেষ দলের সঙ্গে জোট করে ভাবল মুসলিম ভোট বিভাজিত হয়ে যাবে। মমতা বিপদে পড়বেন। অর্থাৎ সেই এক ফরমুলা। মুসলিম ভোটারকেও বোকা মনে করা। তারা যেন জানে না যে, ভোট বিভাজিত হলে বিজেপির সুবিধা! সিপিএম দিন দিন ইম্যাচিওরড হয়ে যাচ্ছে কেন? এটাই একটা উদ্বেগের বিষয় বাম রাজনীতির।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌভাগ্য যে, বিজেপি ঠিক সেই একই ভুল করল। অর্থাৎ রাজনীতিবিদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আন্ডারএস্টিমেট করা। আজ থেকে ৩৭ বছর আগে ২৯ বছর বয়সে যে মহিলা এমপি হয়েছেন, যিনি তারপর কখনও কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন, কখনও কয়লা, কখনও আবার ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে, অবশেষে দু’বার ভারতের রেলমন্ত্রী হয়েছেন, তাঁর মতো সরকারি সিস্টেমকে বাংলার আর একজনও রাজনৈতিক ব্যক্তি জানেন না। গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থাটাই তিনি ভিতর থেকে চেনেন। অথচ হাস্যকর ব্যাপার হল, এই সেদিন রাজনীতি শুরু করা রাজ্য বিজেপির কিছু নেতা সেই মমতাকে টক্কর দিতে ওই একইভাবে তাঁকে আন্ডারএস্টিমেট করে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিয়ে চললেন তাঁরা। কারা? যাঁদের অনেকেই রাজ্যে মোট পঞ্চায়েত সমিতি ক’টা আছে জানেন না। স্থায়ী সমিতি, কর্মাধ্যক্ষদের কাজ কী? জানেন না। কীভাবে একটি নির্বাচনের বুথ সামলাতে হয়? জানেন না। সেটা কিন্তু ২০১৯ সালেও ছিল। কিন্তু তখন বিজেপি নিজের চরিত্র বজায় রেখে লড়াই করেছে। অর্থাৎ নিজেদের দলের নেতাদের সামনে রেখেই লড়াই করেছে। আর বিশেষ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বার্তা। তাই সাফল্য পেয়েছিল বিজেপি। এবার অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হল।
বিজেপি তৃণমূলের ঘর থেকে দলে দলে নেতাদের নিয়ে এল। যাঁদের বিরুদ্ধে নিজের দলের কর্মী-নেতাদের ক্ষোভ বিক্ষোভ এতকাল ধরে। তাঁরা বিজেপিতে এসেই শুধু যে প্রার্থীপদ পেল তাই নয়, সবথেকে বেশি সম্মান ও গুরুত্ব পেল। এই তৃণমূল থেকে আসা নেতারা আবার নতুন দলের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য দেখাতে গিয়ে এত চড়া দাগে পুরনো দল ও নেতানেত্রীদের আক্রমণ করতে শুরু করলেন যে, তাঁরা বুঝতেই পারলেন না যে, মানুষ তাঁদের এই ভোলবদলকে সুবিধাবাদী রাজনীতি হিসেবেই দেখছে। এই নেতাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসায় বিজেপির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ পুরনো অর্থাৎ আদি কর্মী, নেতারা চলে গেলেন পিছনের সারিতে। আদি বনাম নব্য একটি বিভাজন তৈরি হল বিজেপির মধ্যে। আরএসএসের একটি উচ্চ আদর্শ ছিল। সেটি সম্পূর্ণ ভুলুণ্ঠিত হল এভাবে যাকে তাকে দলে নেওয়ায়।
কয়েকজন ছাড়া বিজেপির রাজ্য নেতাদের অধিকাংশ বাংলাকে পুরোদস্তুর চেনেন না। দিলীপ ঘোষ তাঁর দলকে অবশ্যই জনপ্রিয় করেছেন। কিন্তু তাঁর একক হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি পরিপূর্ণ। বরং অন্য যে নেতাদের সামনে আনা হয়েছে,তাঁদের কেউ টিভি চ্যানেলের নেতা। কেউ পাইকপাড়া থেকে গড়িয়াকে মনে করেন বাংলা। আবার কেউ ভোটে হেরে যাওয়ায় স্পেশালিস্ট। টিভি চ্যানেল ও ফেসবুককেই এবার বিরোধীরা ভোটের লড়াইয়ের ময়দান হিসেবে ধরে নিয়েছিল। এই নেতারা লাগাতার সভা সমাবেশ, ফেসবুক, চ্যানেলে হুমকি-হঁশিয়ারির প্রতিযোগিতা করেছিলেন। কারণ, তাঁরা লক্ষ্য করেছেন যত বেশি থ্রেট দেওয়া যাবে, ততই প্রচার পাওয়া যায় মিডিয়ায়। তাই অগ্নিবর্ষণ করা হুমকির জগতে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। একবারও তাঁদের কেউ থামানোর চেষ্টা করেনি। তাঁরা যে সাধারণ মানুষের চোখে পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছেন এবং সবথেকে বেশি বিপদে ফেলছেন নিজের দলকে, এটা বোঝার মতো রাজনৈতিক মেধা তাঁদের ছিল না। একটি সমাজকে চেনা, তাকে বিশ্লেষণ করা, বাংলার শহর ও গ্রামীণ চরিত্রের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা করা, মানুষের মনস্তত্বকে বোঝার চেষ্টা করা, এসব বুদ্ধিমানের কাজটা বিরোধীরা করেনি। তারা হঠাৎ ময়দানে নেমেই করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে অবস্থান নিয়ে শুধুই টিভি ফুটেজ, ফেসবুক শেয়ার আর বিতর্ক বিতর্ক খেলায় নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলল।
ঠিক এরকম সময়ে বাংলা বিজেপির সর্বনাশ করে দিল তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাঁরা ভাবলেন, বাংলা ভোট অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স টেস্ট। অর্থাৎ সবার জন্য একই সিলেবাস। একই প্রশ্ন। একই উত্তর। বিহার, ইউপিতে যে পলিটিক্স, বাংলাতেও তাই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রধান দুই প্রচারক নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের মধ্যে ক্রমেই গত ৮ বছরে একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে যে, তাঁরা রাজনীতির চাণক্য। তাঁরা একের পর এক ভোটে জয়ী হয়েছেন। সেটা মনে রেখেছেন। কিন্তু একের পর এক ভোটে যে হেরেও গিয়েছেন, সেটা মনে রাখেননি। এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হরেকরকম নেতা-মন্ত্রীদের নিয়ে এসে বাংলার মানুষকে এই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে লেকচার দেওয়া শুরু করলেন। তাঁরা যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যশাসন কিংবা সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদির সমালোচনা এবং নিজেরা ক্ষমতায় এসে কী করবেন সেই প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন, তাহলে ফলাফল হয়তো অনেক ভালো হতো। তা কিন্তু তাঁরা করলেন না। তাঁরা যথারীতি নিজেদের স্বভাবসিদ্ধ ভয় দেখানোর পরিবেশ তৈরি করে ফেললেন। আর একটা বার্তা দেওয়া যে, বাংলার সব এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, আমরা এসে বাংলাকে নতুন প্রাণ প্রদান করব। একটি জাতি নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে নিজেদের নিম্নগামী সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করে হা হুতাশ করে। কিন্তু যদি বহিরাগতরা এসে তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, সেটা মন থেকে মানতে চায় না কেউ। এক্ষেত্রে সেটাই হল। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতারা এসে রবীন্দ্রনাথ, স্বামীজি নিয়ে বাঙালিকে এমনভাবে শিক্ষা বিতরণ করতে গেলেন যে, সেটা নিয়ে চরম হাসাহাসি হল।
কখনও ভয় দেখানো হল— এনআরসির নামে। কখনও ভীতি ছড়ানো হল ক্ষমতায় এসে কীভাবে শায়েস্তা করা হবে বিজেপি বিরোধীদের, সেই সম্ভাব্য ব্যবস্থার চিত্র অঙ্কন করে। একজন প্রধানমন্ত্রী সাধারণ নেতাদের মতোই সভার পর সভায় শুধুই ভাইপো, সিন্ডিকেট, কাটমানি ইস্যুতে আটকে রইলেন। তিনি স্পেসিফিক যদি ঘোষণা করতেন যে, কোথায় কী শিল্প করবেন, কোথায় কোন খাতে কত বরাদ্দ করবেন, কোন প্রকল্পে কর্মসংস্থান হবে, কোন পরিকাঠামো নির্মাণ করা হবে, কোথায় শিল্পপতিদের নিয়ে এসে বিরাট লগ্নি করা হবে, তাহলেও মানুষ হয়তো আশাবাদী হতেন। বিশ্বাস করতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সঙ্গে সাধারণ পাড়ার বিজেপির ভাষণে কোনও ফারাকই দেখা গেল না। বরং তিনি ‘দিদি ও দিদি’ জাতীয় সস্তা চটকদারিতে ক্ষণিকের হাততালি পেয়ে নিজেকে হালকা করে দিলেন জনমানসে।
সমস্যা হল, বিজেপির বহিরাগত নেতারা বাংলার একটা ডিসেন্ট কালচারকে বোঝার চেষ্টা করেননি। যারা ব্রিগেডে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই দেওয়া ‘এক ছোবলেই ছবি’ ডায়ালগে হাততালি দিচ্ছে, তাদের বাইরেও যে একটা বৃহৎ বাংলা আছে, সেটা বিজেপি নেতৃত্ব জানারই চেষ্টা করেননি।
বাংলা মন থেকে বাংলাই থাকতে চায়। চরিত্রগতভাবে। কিন্তু একটা আশঙ্কা তৈরি হল যে, বাংলা আর বাংলার মতো থাকবে না বিজেপি ক্ষমতায় এলে। পাল্টে যাবে। উত্তর ভারতীয় আগ্রাসনের কবলে পড়বে। সংস্কৃতি থেকে ধর্মপালনের অধিকার বদলে যেতে পারে। এসব আশঙ্কা আরও বেশি বিজেপিবিরোধী মনোভাব তৈরি করল। এটা বুঝেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বেশি করে বাঙালিয়ানাকেই ভোটের অভিমুখ করে দিলেন। এই নির্বাচন যে বাংলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার লড়াই, এরকম একটি বার্তা দিতে সক্ষম হলেন। প্রচারের গতিপ্রকৃতিও সেদিকেই ধাবিত হল। বঙ্গ বিজেপি মমতার বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিপক্ষ নয়। প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে গেলেন অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি, জগৎপ্রকাশ নাড্ডারা। ফলে বাংলা বনাম বহিরাগত লড়াইটা অন্য মাত্রা পেয়ে গেল। এর ফলে সবথেকে বড় ক্ষতি হল বঙ্গ বিজেপির। তারা নিজেরাও মমতার প্রতিপক্ষ হতে চায়নি। করতে চেয়েছে মোদিকে। সুতরাং মমতার প্রতিপক্ষ হয়ে গেলেন মোদিই। যা হয়ে গেল কাউন্টার প্রোডাক্টিভ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত সতর্ক ও আশঙ্কার মধ্যে থাকবেন। কেন? তিনি তো জয়ী হয়েছেন! তাঁর কীসের ভয়? ভয় হল, বিরোধীরা এবার থেকে তাঁকে যেন সিরিয়াসলি নিতে না শুরু করেন। একজন মহিলা চারবার নরেন্দ্র মোদিকে হারিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং এখন থেকে জাতীয়স্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তুমুল আগ্রহ ও আকর্ষণ শুরু হয়েছে। তাবৎ অবিজেপি দলগুলি তাঁকে সামনে রেখেই আগামী দিনে মোদি বিরোধী লড়াইয়ে ঝাঁপাতে চাইছে। মমতা মনে প্রাণে চাইবেন, বাংলার বিরোধীরা এই প্রবণতাকে হেসে উড়িয়ে দিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিরোধীরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করুক। তিনি কখনও চাইবেন না যে, বিরোধীরা তাঁকে সমীহ করুক, রাজনৈতিকভাবে ভয় পাক অথবা তাঁর রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করুক। বরং তাঁর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, ভুল তথ্য প্রদান, হঠাৎ করে রেগে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়কে আক্রমণ করে, ব্যঙ্গ করার মধ্যেই যেন বিরোধীরা আগের মতোই আবদ্ধ থাকেন। ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেমন অপমান করলাম’ এই মনোভাব নিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিভি টক শোতে যেন বিরোধীরা আত্মতৃপ্ত থাকেন। তাহলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ মসৃণ হবে। এতকাল এটাই হয়েছে।
২০২১ সালে বাংলার স্বজাত্যভিমানের লড়াই জয়ী হয়েছে। অর্থাৎ দল নয়, বহুকাল পর বাঙালি জয়ের স্বাদ পেয়েছে একটি জাতি হিসেবেও। সেই কারণেই দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ— এই তিনটি সর্বনাশে বিপর্যস্ত সেই জাতির বহুকাল পর একটি অধরা স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছে। স্বপ্নের নাম ২০২৪! বাঙালি প্রধানমন্ত্রী!
সহযোগিতায় : সত্যেন্দ্র পাত্র