আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
সত্যজিৎ রায়। নামটা শুনলেই মনে হয় যেন একটা আস্ত মহাকাব্য। আর সেই মানুষটার জন্মশতবর্ষের দোরগোড়ায় আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। পাঠকদের উদ্দেশে প্রথমেই বলি, মানিকদার জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে তাঁর স্মৃতিচারণা করাটা আজকে আমার কাছে খুবই কঠিন। কারণ দীর্ঘদিন আমি তাঁর সান্নিধ্যলাভ করেছি। তাই মানিকদার কথা বললেই একরাশ স্মৃতি ভেসে আসছে। খারাপ লাগে আজকে বয়সের কারণে মানিকদার সঙ্গে কাটানো সেই স্বর্ণযুগের অনেক কথাই আমার স্মৃতি থেকে মুছে যেতে বসেছে। তাই আজকে ব্যক্তি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তৈরি হওয়া কিছু স্মৃতিই না হয় আপনাদের সামনে তুলে ধরি।
১৯৫৪ সালে আমার সঙ্গে প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচয়। মিচেল ক্যামেরায় ‘পথের পাঁচালি’র শ্যুটিং শুরু হল। আমি ক্যামেরা কেয়ারটেকার হিসেবে ইউনিটে যোগদান করলাম। সত্যিই বলছি, কোনওদিন ভাবিনি এই সুযোগ পাব। এরপর ১৯৬০ সালে মানিকদা আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ তথ্যচিত্রের দায়িত্ব দিলেন। আর সুব্রত মিত্রের উপরে ‘তিন কন্যা’র ক্যামেরার ভার দিলেন। কিন্তু সুব্রতদার চোখের সমস্যার জন্য ওই ছবিটা শেষপর্যন্ত আমিই শ্যুট করেছিলাম।
মানিকদার কথায় ফিরে আসি। তাঁকে বাইরে থেকে দেখে অনেকেই গম্ভীর ভাবতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন একদম ‘মাই ডিয়ার’ মানুষ। সেটে কোনওদিন মানুষটাকে রাগতে দেখিনি। যদি কখনও কাউকে বকে থাকেন, সেটা তাঁর ভালোর জন্যই। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। কৃষ্ণা বসু বসে রয়েছেন। ঘরে ঢুকলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। ওই দৃশ্যে কৃষ্ণাকে হাসতে হতো। কিন্তু কিছুতেই শটটা মানিকদার পছন্দ হচ্ছে না। তখন মানিকদা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে উঠলেন, ‘কৃষ্ণা, তুমি কি বাড়িতে হাসো না?’ শুধু ওই একটা কথা। ব্যস, পরের শটেই ওকে। আবার এই মানুষটারই সেন্স অব হিউমার দেখলে অবাক হতে হয়। ‘অভিযান’ ছবির শ্যুটিং চলছে। আহত নরসিং মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে হাওয়া করছেন ওয়াহিদা রহমান। হঠাৎ এক ফালি চুল ওয়াহিদার চোখ ঢেকে দিল। মানিকদা আমাকেই বললেন ওঁর মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিতে। আমি সেটা করতেই মানিকদা ফ্লোরের বাকিদের উদ্দেশে বললেন, ‘রায়কে একটা চান্স দিলাম!’
ফ্লোরে ছবির কাজ এগতে কেউ যদি সাহায্য করেন, তাহলে সেই মানুষটি যেন মানিকদার কাছে অন্ধের যষ্টির মতো হয়ে উঠতেন। ‘সোনার কেল্লা’র শ্যুটিং চলছে। আমরা যোধপুর থেকে জয়সলমিরের ট্রেনে। প্রায় ছ’ঘণ্টা সময় লাগবে। হোটেলের থেকে বলা হয়েছিল সঙ্গে খাবার রাখতে। কারণ মাঝে সেইভাবে খাবার পাওয়া যায় না। একটা স্টেশনে গাড়ি থামতেই হঠাৎই কামু মুখোপাধ্যায় সিট ছেড়ে উঠে চলে গেল। ফিরে এল ঝুরিভাজা, ডালমুট, মিষ্টি নিয়ে। আমি আর মানিকদা তো রীতিমতো অবাক। মানিকদা জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? পরে জানা গেল,কামু একটি মাড়োয়ারি বরযাত্রীকে ম্যাজিক দেখিয়ে খাবারগুলো নিয়ে এসেছে। মানিকদা তো হেসে অস্থির। মানিকদা কামুকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে ফেলুদা অ্যান্ড কোং বেনারসের সরু গলি ধরে মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। মানিকদা বললেন একটা ষাঁড় পেলে খুব ভালো হতো। আমি বললাম, মানিকদা এখন ষাঁড় কোথা থেকে পাওয়া যাবে। আর পেলেও সে ক্যামেরার সামনে আসবে কেন! শ্যুটিং বন্ধ। এদিকে লাইট পড়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর শোনা গেল ‘আসছে আসছে’ রব। এখানেও সেই কামু। সে ষাঁড় বাবাজীবনকে একটা মুলোর লোভ দেখিয়ে তাকে লোকেশনে নিয়ে হাজির!
সময়ের সঙ্গে মানিকদার পরিবারের সঙ্গে আমার অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার মা ওঁকে ডেকে পাঠাতেন। আমি প্রায়দিনই ওঁর বাড়িতে যেতাম। চিত্রনাট্য তৈরি হলে মানিকদা সবাইকে তাঁর বাড়িতে ডেকে নিতেন। তারপর শ্যুটিংয়ের পরিকল্পনা করা হতো। বউদি (বিজয়া রায়) এলাহি খাবার দাবারের আয়োজন করতেন। এই খাবারের প্রসঙ্গেই বলি, শ্যুটিংয়ের সময় মানিকদা কিন্তু পরিমিত আহার পছন্দ করতেন। শুধু স্যান্ডউইচ খেতেন। তবে খাদ্যরসিক ছিলেন। রুটি আর অড়হর ডালও ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। যোধপুরে শ্যুটিং চলছে। আমরা সেদিন বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। মানিকদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খেলে?’। আমি বললাম, ‘খুব ভালো ঘিয়ে ভাজা কচুরি আর জিলিপি খেয়ে এলাম।’ সঙ্গে সঙ্গে অনিলদাকে (চৌধুরী) নির্দেশ দিলেন, ‘এই, রায় আজকে যা খেয়ে এসেছে, কালই আমার চাই।’
মানিকদা কোনওদিন কম্প্রোমাইজ করে ছবি করেননি। সবচেয়ে বড় কথা শ্যুটিংয়ে কোনও সমস্যার কথা বললে, তিনি সেটা এড়িয়ে না গিয়ে মন দিয়ে শুনতেন। যেমন ‘ঘরে বাইরে’র ইন্ডোর শ্যুটিং রাতে চলছে। তাই লাইট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাতীলেখা-সৌমিত্র রয়েছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে, ঘরের মধ্যে তিনটে পেল্লাই সাইজের আয়না ছিল। কিন্তু আয়নার জন্য লাইট করতে অসুবিধা হচ্ছে। মানিকদাকে কিছু বলতেই ভয় লাগছে। তারপর মনস্থির করে গিয়ে বলতেই মানিকদা ওঁদের দু’জনকে একটু অ্যাডজাস্ট করে দাঁড়াতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা মিটে গেল। আমারও কাজ হয়ে গেল। ইউনিটকে স্বাধীনতা দিতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। পালামৌতে তখন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং চলছে। প্যাকআপের পর সন্ধ্যায় সৌমিত্র, শুভেন্দু, রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জরা সাধারণত একসঙ্গে আড্ডা মারতেন। একটু আধটু পানাহারও চলত। একদিন সবাই সেরকম আড্ডায় মেতেছেন। একদিন সেখানে হঠাৎই মানিকদা এসে হাজির। সবাই ভয়ে গ্লাস নামিয়ে রেখেছেন। কিন্তু রবি ঘোষ ছিলেন মজার মানুষ। টুক করে গ্লাস তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘মানিকদা, আমরা একটু খাচ্ছি।’ মানিকদা হেসে বললেন, ‘বেশ। খাও। আমি তাহলে যাচ্ছি। তবে কাল কিন্তু এখানেই শ্যুটিং। ভুলে যেও না।’ মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন মানিকদা।
শ্যুটিং প্যাকআপের পরেও মানিকদার সঙ্গে প্রচুর আড্ডা হতো। ছবি নিয়ে কথা হতো। ভালো কোনও বিদেশি ছবি দেখলেই আমাদের সেটা দেখতে বলতেন। আউটডোরে রাতে শ্যুটিংয়ের পর দীর্ঘক্ষণ আমরা একসঙ্গে তাস খেলতাম। কিন্তু লক্ষ করতাম, তারপর একটা সময় উনি ঠিক উঠে চলে যেতেন। তাড়াতাড়ি ডিনার করে ঘরে গিয়ে চিত্রনাট্যে বুঁদ হয়ে থাকতেন। শ্যুটিং ফ্লোরে আমরা মানিকদার জন্মদিনও পালন করেছিলাম। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং চলাকালীন মানিকদার জন্মদিন পড়েছিল। বাড়ির বাইরের উঠোনে সাঁওতালি নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রচুর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শ্যুটিং সেরে ফিরে মানিকদা তো দেখে অবাক। বললেন, ‘তোমরা করেছ কী! এটা তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।’ তবে বুঝতে পেরেছিলাম মুখে বললেও তিনি মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন। মনে পড়ছে ওইদিন সাঁওতাল রমণীদের সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুরও নাচের তালে পা মিলিয়েছিলেন।
মানিকদার সঙ্গে ছবিদার (বিশ্বাস) একটা মজার ঘটনা বলি। তাহলে দুই মহারথী সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। ‘দেবী’তে একটা দৃশ্যে ছবিদাকে পড়ে যেতে হবে। ছবিদার হাঁপানি ছিল। তাই ওইভাবে শট দিতে তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি করলেন কী, শ্যুটিংয়ের দিন গোটা বুকে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে ফ্লোরে চলে এলেন! বললেন, ‘মিস্টার রায়, বুঝতেই পারছেন আমি তো এই শট দিতে পারব না।’ মানিকদা ছিলেন বুদ্ধিমান। বুঝতেই পেরেছিলেন ছবিদা মজা করছেন। তখন ছবিদাকে সুব্রতদা বললেন, ‘আপনি যতটা পারেন শটটা দিন, আমি ঠিক শট কেটে নেব।’ কিন্তু মানিকদাও নাছোড়বান্দা। ঠিক বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবস্থা করলেন। তারপর দুটো শটে ওকে হয়ে গেল। ছবিদা হেসে মানিকদাকে বললেন, ‘আমি নিজেকে চালাক ভাবতাম। কিন্তু আপনি যে আমার থেকে আরও বড় চালাক সেটা আজকে বুঝতে পারলাম।’
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। মানিকদা সারা জীবনে প্রচুর পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। ওঁর সঙ্গে আমি কখনও বিদেশ সফর করিনি। তবে তিনি জাতীয় পুরস্কার নেওয়ার সময় বেশ কয়েকবার আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম। জাতীয় পুরস্কার শুনলেই আমাদের মনের মধ্যে কী ভীষণ উত্তেজনা হতো। অথচ, ওইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনেও মানুষটার মধ্যে উত্তেজনার লেশমাত্র থাকত না। বিদেশ থেকে ‘গোল্ডেন লায়ন’ কিংবা ‘গোল্ডেন বেয়ার’ পুরস্কার নিয়ে এলেন। আমরা সবাই এয়ারপোর্টে ওঁকে রিসিভ করতে গিয়েছি। তখনও দেখতাম একদম নির্লিপ্ত। আসলে অত বড় মাপের মানুষ বলেই হয়তো সাফল্যকে কখনও তিনি কাজের উপরে স্থান দেননি।
২৩ এপ্রিল ১৯৯২। মনে হয়, আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা দিন। বেলভিউ থেকে খবর এল মানিকদা আর নেই। যেন আমার দ্বিতীয়বার পিতৃবিয়োগ হল। মনে হয়েছিল পায়ের তলা থেকে যেন মাটিটাই সরে গেল। মানিকদাকে শেষযাত্রায় দেখতে যাইনি। কারণ যে মানুষটার সঙ্গে এত স্মৃতি, তাঁকে সামনে ওই অবস্থায় দেখার শক্তি আমার মধ্যে ছিল না। সারাদিন চুপ করে বাড়িতে বসেছিলাম। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। আমি জানি, আজকে মানিকদার নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আজকে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি তাঁর জীবনদর্শন ও কাজকে সেইভাবে উদ্যাপন করলাম? বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতবাসী কি তাঁকে যোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে? ১৯৯৭ সালে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে গেস্ট লেকচারার হিসেবে গিয়েছি। মানিকদার ছবি নিয়ে পড়াতে গিয়ে ছাত্রদের থেকে শুনতে হল, ‘আমরা তো হিন্দি ছবি তৈরি করব। আমাদের সেইভাবে শেখান।’ অবাক হয়ে শুধু ওদের দিকে তাকিয়েছিলাম! নতুন প্রজন্মের কাছে আমার আবেদন, তাঁরা যেন সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে আরও সিরিয়াস হন। মনে মনে একটা স্বপ্ন দেখি— কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত কাজ নিয়ে একটা বিশ্বমানের সংগ্রহশালা তৈরি হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সত্যজিৎ উৎসাহীরা সেখানে হাজির হয়ে মানুষটাকে আরও ভালোভাবে চিনতে পারবেন। জানি এটা বাস্তবায়িত হলেও আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না। কিন্তু যেখানেই থাকি না কেন, সেদিন আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না।