আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
জয় বাংলা। জয় শ্রীরাম। ইনক্লাব জিন্দাবাদ।
মোদ্দা কথা— সুসজ্জিত চেহারার ছোট কিংবা বড়পর্দার চেনা মুখগুলো আজ অচেনা গণ্ডিতে ধরা দিচ্ছেন। দুষ্ট-মিষ্টি প্রেমের প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা মারকাটারি সংলাপ বলে হাততালি কুড়ানোর কারিগররা রুপোলি পর্দা ছেড়ে রাজনীতির শুষ্ক ময়দানে খেলতে নেমেছেন। স্ক্রিপ্ট পড়ে ক্যামেরার সামনে যাঁদের দিন কাটত, আজ তাঁদের হাতে মাইক্রোফোন। কাঁধে উঠেছে ঝান্ডা। বিলাসবহুল গাড়িতে করে বাড়ি থেকে শ্যুটিং ফ্লোর পর্যন্ত যাঁদের যাতায়াত ছিল, আজ তাঁরাই কাঠফাটা রোদে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে গলা চড়াচ্ছেন।
এটাই কি সময়ের দলিলে পথের পাঁচালি না অনুরাগের ছোঁয়া! উত্তর মিলবে কয়েক বছর পর। যেদিন হয়তো এ সময়টাই ধরা পড়বে তারকাদের দেশে কোনও এক ছায়াছবিতে।
নেতারাই রাজনীতি করেন। কোথাও হয়তো এই লাইনটা এবার বদলাচ্ছে। রাজনীতি অভি-নেতারাও করেন! অভিনয় যদি পেশা হয়, তাহলে রাজনীতিটা নেশা হয়ে উঠছে তারকাদের কাছে। রাজনীতির অন্দরে দক্ষিণ ভারতের তারকাদের দাপট বহুদিনের। এম জি রামচন্দ্রন, এনটিআর রামারাও, এম করুণানিধি, জয়ললিতা চলচ্চিত্র জগতে যেমন সুনাম কুড়িয়েছেন, তেমনই রাজনীতিতেও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। রিল লাইফ থেকে রাজনীতির অচেনা গণ্ডিতেও তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন ‘আসল হিরো’।
দক্ষিণের পথ ধরেই কি অভিনয় আর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে উত্তরে! সুনীল দত্ত, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, রাজ বব্বর, গোবিন্দাদের দিয়ে বাজিমাতের চেষ্টা হয়েছে। আর এখানেই বঙ্গ জীবনের অঙ্গে ঢুকে পড়েছে ‘অভিনয়’। থুড়ি রাজনীতিতে।
রাজনীতির পাঠশালায় অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রীদের নাম লেখানো একেবারেই নতুন নয়। হাল আমলে চর্চাটা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু শিকড় অনেক গভীরে। অনুপকুমার, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়রা বামপন্থাকে একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। প্রার্থীও হয়েছিলেন। দিন যত এগিয়েছে, ততই দেখা গিয়েছে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড ছেড়ে রাজনীতির আঙিনায় হাতপাকা করতে শুরু করে দিয়েছেন অভিনেতারা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ঘোষিত বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু কোনওদিনই লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে মিছিল করেছেন এমন ছবি দেখা যায়নি। বরং বাইরে থেকে পার্টিকে সমর্থন জুগিয়েছেন। সেটাই ছিল পার্টির বড় শক্তি। তাই বাঙালির ‘অপু’র নিথর দেহ পদযাত্রা করে বেলাশেষে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা।
ঘোষিত বামপন্থীদের তালিকায় উল্লেখযোগ্য নাম বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। ২০০৬ সালে আলিপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁকে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। বিপরীতে ছিলেন তৃণমূলের তাপস পাল। সেবার জিততে পারেননি বিপ্লব। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর গায়ে ‘দলবদলু’ তকমা কেউ সেঁটে দিতে পারেনি। বললেন, ‘মৃত্যুর পরে স্বর্গে গিয়েও সিপিএম থাকব।’ দেবদূত ঘোষ, সব্যসাচী চক্রবর্তী, বাদশা মৈত্র, শ্রীলেখা মিত্রদের সদ্য ব্রিগেডের সমাবেশ দেখা গিয়েছে। ১০ বছর আগে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা থেকে ক্ষমতাচ্যুত একটি রাজনৈতিক দলের ‘আগামীর লাল নিশান’কে তুলে ধরার বার্তা দিয়েছেন তাঁরা। তা সিপিএমকে কতটা অক্সিজেন জোগাবে সেটা সময়ই বলবে।
কারণটা খুবই স্পষ্ট। এখন তো স্টার, সুপারস্টার, মেগাস্টারদের জোড়াফুল কিংবা পদ্মফুলের ভিড়ে শামিল হওয়ার পালা। এবারের বিধানসভা নির্বাচন যে ‘তারকাখচিত’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জুন মালিয়া, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশানী মুখোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, রাজ চক্রবর্তী, লাভলি মৈত্র, সোহম চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিকরা ‘রাজনীতির প্রোডাক্ট’ নন। তাহলে কি শুধুমাত্র তাঁদের মুখকে ব্যবহার? নাকি সিনেমার বাজারে ঘাটতি বলে টিকে থাকার লড়াইয়ে রাজনীতিতে পা রাখা? প্রশ্নটা উঠতে বাধ্য।
একই কথা কিন্তু প্রযোজ্য গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো রুদ্রনীল ঘোষ, পাপিয়া অধিকারী, যশ দাশগুপ্ত, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, পায়েল সরকার, তনুশ্রী চক্রবর্তী, হিরণ চট্টোপাধ্যায়দের ক্ষেত্রে। আরও একজন রয়েছেন, তিনি এঁদেরও গুরু— মহাগুরু মিঠুন চক্রবর্তী।
সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করেন, সেলিব্রিটি ক্যান্ডিডেট হলে তাঁকে মানুষের কাছে চেনাতে বিশেষ অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয় না রাজনৈতিক দলগুলিকে। এ ক্ষেত্রে বাড়তি লাভ পরিচিত মুখ।
সেই কারণেই কি ন’বারের টানা সাংসদ সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়াকে ২০১৪ সালে হারিয়ে দিতে সক্ষম হন তৃণমূলের মুনমুন সেন? আবার মাঠে-ঘাটে কাদা মেখে থাকা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে হার মানতে হয়েছিল কলকাতার ‘রসগোল্লা কুইন’ দেবশ্রী রায়ের কাছে।
‘দাদার কীর্তি’র নায়ক তাপস পালকে কোনওদিনও ভুলতে পারবে না বাঙালি। অমলিন হাসি, মুগ্ধ করা অভিনয় ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে শুধুমাত্র বন্দি থাকেনি। তিনি যেমন অভিনয়ের ক্ষেত্রে রেখে গিয়েছেন স্পষ্ট ছাপ, তেমনি রাজনীতির আঙিনাতেও বিচরণ করেছেন সহজ সরলভাবে। দু’বারের বিধায়ক, দু’বারের সাংসদ হয়েছেন। তবে মেকআপ ছেড়ে রাজনীতির জামা গায়ে দিয়ে ‘আমি তাপস পাল বলছি...’ বক্তব্যে বিতর্কেও জড়িয়েছেন।
তাপসের সঙ্গে হিট জুটির নায়িকা শতাব্দী রায় বর্তমানে তৃণমূলের সাংসদ। ইদানীং সিনেমার পর্দায় তাঁকে দেখা না গেলেও, রাজনীতিবিদ হিসেবে ধরা দিচ্ছেন টিভির পর্দায়। চলচ্চিত্র জগৎ থেকে শিল্পীদের রাজনীতিতে নাম লেখানোর বিষয়টিকে সহজভাবেই দেখতে চান শতাব্দী। তবে, সন্দেহ একটা থেকেই যায়। সেই উষ্মাই ধরা পড়ল ‘গুরুদক্ষিণা’র নায়িকার গলায়, ‘শিল্পীরা রাজনীতিতে এলে ভালোবাসায় ভাগ বসে। ফ্যান ফলোয়ার্সরা ধাক্কা খান।’
এখানেই উল্লেখ করার মতো বিষয় জনপ্রিয় চিত্রতারকা চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর নাম। গত ১০ বছর ধরে বিধায়ক রয়েছেন। জিততে পারলে এবার হ্যাটট্রিক হবে। ‘বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, মা গেলে মা পাওয়া যায় না’ ডায়লগে হল কাঁপানোর পর রাজনীতিক চিরঞ্জিত বলছেন, ‘গ্রামে বসে চাষির বাড়িতে কলাপাতায় ভাত খেলেই বাংলা পাওয়া যায় না।’
২০১৪ সালে ‘বিন্দাস’ নামে একটি ছবিতে ধরা দিয়েছিল তৃণমূলের স্লোগান—‘বদলা নয় বদল চাই।’ ছবির গল্পের ক্যানভাসও ছিল গড়বেতা ও কেশপুর। আর এবার ‘পরিবর্তন’ আর ‘প্রত্যাবর্তন’-এর লড়াইতে তারকার ছুটছেন। বলা ভালো একটু দ্রুত গতিতেই।
কিন্তু কেন? বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে বামেদের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও সক্রিয় রাজনীতিতে নেমেছিলেন খুবই কম সংখ্যক। এরপর এল ২০১১ সালের সন্ধিক্ষণ। ছেয়ে গেল ‘পরিবর্তন চাই’-এর হোর্ডিং। হোর্ডিংয়ে অনেককেই দেখা গিয়েছিল। আর এখন?
টিভি খুললে কিংবা সিনেমা হলে বসে যে মুখগুলোকে দেখা যেত, আজ তাঁদের হাতেই রাজনৈতিক দলের পতাকা। যা নিয়ে ফেসবুক-ট্যুইটারে-হোয়াটসঅ্যাপে চলছে দেদার ট্রোল— ‘আমরা আপনার ফ্যান। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হওয়ার পর আপনাকে ভালোবাসতে কিঞ্চিৎ হলেও অসুবিধা হচ্ছে।’
‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’— এই ডায়লগ বাঙালি গোগ্রাসে গিলছে। কিন্তু ভোট বাজারে ব্রিগেডে মোদির সভায় যখন ডিস্কো ড্যান্সার বলছেন, ‘আমি জলঢোঁড়াও নই। বেলেবোড়াও নই। আমি একটা কোবরা। গোখরো আমি। জাত গোখরো। এক ছোবলেই ছবি,’ তখন মিঠুন চক্রবর্তীকেও জনতা জনার্দনের তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে।
তারকাদের মধ্যে সন্ধ্যা রায় থেকে দেবশ্রী রায়, আবার দেব, মিমি, নুসরত অনেকেই বিধানসভা বা লোকসভায় পা রেখেছেন। একইভাবে বিজেপির সাংসদ হয়েছেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, জর্জ বেকার, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতো চিত্র তারকারা। রাজনীতির প্রতি ঝোঁক বাড়াতে অন্যায় দেখেন না তাঁরা। রূপা মনে করেন, ‘ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা যদি রাজনীতিতে আসতে পারেন, তাহলে চিত্রতারকাদের রাজনীতির আঙিনায় নাম লেখাতে অসুবিধা কোথায়?’
সিনেমায় একটা রোল করার সময় প্রাণ ঢেলে কাজ করেন শিল্পীরা। বক্স অফিসে তাঁর ছবিকে হিট করাতে অভিনয়ে, পেশাদারিত্বে কোথাও খামতি রাখতে চান না তাঁরা। তাই রাজনীতিতেও অভিনেতারা প্রাণ ঢেলে কাজ করবেন, এমনটাই আশা জর্জ বেকারের।
দেশসেবা, সমাজসেবার কাজে রাজনীতি একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে থাকলে সেটা এককভাবে যতটা করা যায়, তার থেকে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় রাজনীতির হাত ধরে। এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নবাগতরা।
কিন্তু এই প্রশ্নটাও উঠছে, বাংলা সিনেমার বাজার মোটেও ভালো নয়। তার ওপর লকডাউনে টানা বন্ধ ছিল সিনেমা হল। সিনেমার পাশাপাশি ধারাবাহিকের শ্যুটিংও বন্ধ ছিল। লকডাউনের প্রভাব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্ষীয়ান অভিনেতাদের যুক্তি, সবাইকেই টিকে থাকার লড়াই করতে হয়। তা রাজনীতি হোক বা শিল্প জগৎ। আর রাজনীতি যেন এঁদের কাছে টিকে থাকার পরশপাথর।
আবার সেলিব্রিটিদের কাঁধে ভর করে হয়তো কয়েকটা আসন জেতা যায়। কিন্তু গোটা ভোট বৈতরণী পার করা যায় না। অভিনেতাদের সামনে রেখে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করা মুশকিল যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে। কারণ ওঁরা তো সকলে রাজনীতির অ-আ-ক-খ জানেন না। তাঁরা শুধুমাত্র নিজেকে রাজনীতির ‘জয়-পরাজয়’-এ বাজি রাখতে পারেন। আবার এঁদের কাজের ধরনটাও আলাদা। ভোর চারটের সময় যেমন শ্যুটিং থাকে, তেমনই মধ্যরাতেও শ্যুটিং শিডিউল পড়তে পারে একজন অভিনেতার। অথচ, নেতাদের কিন্তু অ্যাক্টিভ থাকতে হয় ২৪ ঘণ্টা। তাই দু’নৌকায় পা দিয়ে চলা বেশ দুরূহ কাজ।
রাজনীতিবিদরাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং করবেনও। রাজনীতির চাবিকাঠি রাজনীতিবিদদের হাতেই। এমনকী অভিনেতাদের টিকিট পাওয়ার ভাগ্যের তালাও খোলে নেতাদের হাতযশে।
তাহলে রাজনীতির ময়দানে ওরা কি ‘আগন্তুক’!
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়