উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো নামগুলো শুনলেই বাঙালির সবার আগে যাঁর নাম মনে আসে তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে যিনি আবিষ্কার করেন সিন্ধু সভ্যতার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর মহেঞ্জোদারো। যদিও বর্তমান আলোচ্য বিষয় আবিষ্কর্তা নন, আবিষ্কার। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে মহেঞ্জোদারোর গুরুত্ব আগেই বোঝা গেলেও সংস্কৃতির বিচারে সে যে হরপ্পার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা— এই উপলব্ধি রাখালদাসই প্রথম করতে পেরেছিলেন। ১৯২১-’২২ নাগাদ যখন তিনি মহেঞ্জোদারোতে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেন তার ঠিক একবছর আগে দয়ারাম সাহানি খনন করেন হরপ্পা। হরপ্পা থেকে কিছু শিলমোহর এর আগেও পাওয়া গিয়েছিল বটে কিন্তু সেগুলো যে প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম এক সভ্যতার অঙ্গ সেই উপলব্ধিতে পৌঁছনোর সূচনা হয়েছিল আজ থেকে একশো বছর আগেকার ওই হরপ্পা খনন থেকেই।
দু’টি মাত্র কেন্দ্র দিয়ে যে সভ্যতা বিশ্ব দরবারে আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই সংখ্যাটা আজ শতবর্ষ পার করে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। বহরে ছাড়িয়েছে ১০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। বালুচিস্তান, সিন্ধ, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, গুজরাত, রাজস্থান, হরিয়ানা ছাড়িয়ে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত ব্যাপ্ত এই সভ্যতার আবিষ্কারের প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছি তার গভীরে। সময় পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই পাল্টেছে তার সম্বন্ধে আমাদের বহু প্রাথমিক ধারণাও।
সিন্ধু নদ ও তার বিভিন্ন উপনদীর ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই সভ্যতার প্রথম পরিচয় ছিল সিন্ধু সভ্যতা হিসেবেই। কিন্তু গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান যত এগতে লাগল, দেখা গেল যে এই সভ্যতার একটা বিরাট বড় অংশ বাঁধা রয়েছে বর্তমানে বিলুপ্ত প্রাচীন সরস্বতী ও তার সঙ্গী নদীগুলির আশপাশে। সরস্বতীর শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত দিয়ে এখন ঘগ্গর নামের একটি বৃষ্টির জলে পুষ্ট ছোট জলধারা শিবালিক পার্বত্য প্রদেশ থেকে রাজস্থান পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। এই ধারাটি যখন ভারতের গণ্ডি টপকে পাকিস্তানে ঢুকত তখন পাকিস্তানে সে নাম নিত হাকরা। যার শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত আজও দেখা যায় সেখানকার চোলিস্তান মরুভূমি, বাহাওয়ালপুর অঞ্চলে।
স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে পাঁচের দশকে অমলানন্দ ঘোষ এই ঘগ্গর নদীপ্রবাহের পাশে বেশ কিছু হরপ্পা সভ্যতা কেন্দ্র আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে সাতের দশকে পাকিস্তানের হাকরা নদীর শুকনো খাতের পাশে প্রায় ৩০০ মাইল এলাকা জুড়ে মহম্মদ রফিক মুঘল আবিষ্কার করেন এই সভ্যতার প্রচুর কেন্দ্র। তারপর ধীরে ধীরে প্রাচীন সরস্বতীর তীর ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শনে। আজ তার উপত্যকায় সভ্যতা কেন্দ্রের সংখ্যা দু’হাজারেরও বেশি।
প্রথম দিককার গবেষকদের মধ্যে একটা ধারণা প্রবলভাবে জায়গা করে নিয়েছিল যে, এই নাগরিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি মূলত মেসোপটেমিয়া থেকে আগত। কিন্তু গবেষণা যত এগতে থাকে, পরিচয় যত গভীর হতে থাকে বোঝা যেতে থাকে যে এই সভ্যতা স্বতন্ত্র। তার নাগরিকতার বৈশিষ্ট্য, উপাদান সমস্ত কিছুতেই তার স্বাবলম্বী চরিত্র ফুটে উঠতে থাকে। ডব্লিউ এ ফেয়ারসর্ভিস (জুনিয়র), জে এম কাসাল, এফ এ খান, অমলানন্দ ঘোষ, বি বি লাল, সূরয ভান প্রমুখ প্রত্নবিদের গবেষণায় উঠে আসতে থাকে এই সভ্যতার এক প্রাক স্তর, হরপ্পা সভ্যতার আদিরূপের বিবরণ। পাকিস্তানের আমরি, নাল, কোট ডিজি, দাম্বসাদাত কিংবা ভারতের কালিবাঙ্গান, সোথি, সিসওয়াল ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র থেকে পাওয়া যেতে থাকে সেই আদিরূপের সুনিশ্চিত ও সুস্পষ্ট নিদর্শন।
সাতের দশকেই এই গবেষণায় এক নতুন মোড় আসে বালুচিস্তানের বোলান নদীর উপত্যকায় মেহরগড় আবিষ্কারের পর। জারিজ দম্পতি এখানে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত দীর্ঘ খনন কাজ চালান। দেখা যায় যে, হরপ্পার নাগরিক কেন্দ্রগুলির সলতে পাকানো পর্বের সূচনা হয়েছিল মেহরগড়ের গ্রাম থেকেই। নব্যপ্রস্তর যুগের এই বসতি যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা রোদে শুকানো ইটে বাড়িঘর তৈরি করলেও মাটির পাত্র তৈরি করতে তখনও শেখেননি। সূচনার সেই সময়টা খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন অর্থাৎ সে আজ থেকে নয় হাজার বছর আগেকার কথা।
তবে সে সময়ে যে কেবল বোলান নদীর তীরে মেহরগড় ও তার আশপাশেই গ্রামীণ বসতির সূচনা হয়েছিল এমনটা নয়। প্রাচীন সরস্বতীর স্রোতধারার পাশেও হরিয়ানা রাজ্যের ভিরানা গ্রামে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ন’হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল গ্রাম। তবে তাঁরা তখন ইটের ব্যবহার জানতেন না, মাটিতে গর্ত করে তার ওপর খড়, বাঁশ দিয়ে তৈরি করতেন অস্থায়ী বসতি। কিন্তু মাটির পাত্র তৈরি করে সেগুলোকে পুড়িয়ে পোক্ত করে নিতে তাঁরা জানতেন। রফিক মুঘল যখন পাকিস্তানের হাকরা নদীর শুকনো খাতের পাশে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন, তখন তিনি সেখানকার প্রাচীনতম পর্যায়ে এক অস্থায়ী ও গ্রামীণ সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সংস্কৃতিকে তিনি
নাম দিয়েছিলেন হাকরা মৃৎপাত্র সংস্কৃতি। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সময়কালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ভিরানায় খোঁড়াখুঁড়ি করে যে সংস্কৃতির পরিচয় পান, তা ছিল মূলত ওই হাকরা মৃৎপাত্র সংস্কৃতিরই অংশ। যদিও কিছু স্থানীয় বৈচিত্র্য তাদের মধ্যে ছিল। এই সংস্কৃতিকে প্রত্নবিদরা প্রাক হরপ্পা সংস্কৃতি পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর পরেই ক্রমবিবর্তনের ধারায় আসে আমরি, নাল বা কালিবাঙ্গান সংস্কৃতি পর্যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে যা আদি হরপ্পা পর্যায়ের তকমা লাভ করেছে। তবে তখনও তা মূলত গ্রামীণ বসতি।
তারপর ধীরে ধীরে গ্রামের পর গ্রাম, শহরতলি পেরিয়ে আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে গড়ে উঠতে থাকে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবাঙ্গান, লোথাল, ধোলাভিরা বা রাখিগরহির মতো নগরগুলি। তবে কেবলমাত্র মহেঞ্জোদারো ছাড়া আর সব ক’টি নগর কেন্দ্রের সূচনায় ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে নগরে রূপান্তরের ধারাটি স্পষ্ট ভাবে লক্ষ করা গিয়েছে।
মূলত দুটো ভাগে বিভক্ত এই শহরগুলিতে দুর্গপ্রাকার ঘেরা একটু উঁচু স্থানে তুলনামূলক অবস্থাপন্ন বা শাসক শ্রেণীর মানুষ ও তার বাইরে একটু নিচু জায়গায় সাধারণ মানুষেরা বসবাস করতেন বলে প্রত্ন পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। অনেকসময় সমগ্র বসতি অঞ্চলটাই পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হতো।
প্রাচীন পৃথিবীর অন্যান্য সমসাময়িক সংস্কৃতি যেমন মেসোপটেমিয়া বা মিশরীয় সভ্যতার থেকে অনেকাংশেই আলাদা ছিল হরপ্পা সভ্যতা। চুল্লিতে পোড়ানো ইটের ব্যবহার, সুসজ্জিত নগর পরিকল্পনা, একাধিক ঘর যুক্ত একতলা বা কখনও দোতলা পাকা বাড়ি, কুয়ো, বাঁধানো রাস্তাঘাট, জলাধার ও সর্বোপরি চমকপ্রদ নিকাশি ব্যবস্থা প্রাচীন পৃথিবীতে এই সভ্যতাকে এক পৃথক ও বিশেষ পরিচয় প্রদান করেছিল। সমকালীন অন্যান্য সভ্যতায় যেখানে শাসক শ্রেণির বড় বড় অট্টালিকা তৈরি হয়েছে— পিরামিড, জিগুরাত বা দেবতার মন্দির গড়ে উঠেছে, সেখানে হরপ্পা সভ্যতা তার নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবেছে। প্রাচীরগাত্রে রাজারাজড়ার ছবি খোদাইয়ের বদলে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য কুয়ো খোড়া হয়েছে। মহেঞ্জোদারো নগরে এমন প্রায় সাতশো কুয়োর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই সভ্যতা তাই আজও বিস্মিত করে চলেছে আমাদের।
সমকালীন অন্যান্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে তার সুদৃঢ় বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, মেসোপটেমিয়া, উপসাগরীয় (গালফ) অঞ্চলের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত সাবলীল। এর জন্য হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা তৈরি করেছিলেন মূলত চৌকো বা কখনও লম্বাটে ধাঁচের এক ধরনের শিলমোহর, যাতে খোদিত হতো লিপিচিহ্ন ও কিছু বিশেষ পশুমূর্তি। তবে কেবল বাইরের সঙ্গে নয় তার নিজস্ব কেন্দ্রগুলির মধ্যেও চলত নিত্যদিনের ব্যবসা-বাণিজ্য। আফগানিস্তানের বাদাখশান থেকে আসত লাপিস লাজুলি পাথর, আরবসাগর থেকে উঠত ঝিনুক, শঙ্খ। স্থানীয় বা কখনও সুদূর অঞ্চল থেকে আসত স্টিয়েটাইট, আলাবাস্টার, হাতির দাঁত, প্রবাল, জেড, কর্নেলিয়ান, অ্যাগেট, জ্যাসপার পাথর, সোনা, রূপা, তামা, ব্রোঞ্জ বা অল্প দামি পাথর। পৌঁছে যেত ছোট ছোট শিল্পকেন্দ্রগুলিতে। সেখান থেকে তৈরি হয়ে আসত যে প্রসাধনী তা চলে যেত বড় বড় নগর কেন্দ্রগুলোতে। কখনও বা মেসোপটেমিয়ার রাজ পরিবারে। ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বে মেসোপটেমিয়াতে যখন আক্কাদিও রাজবংশের প্রথম রাজা সারগনের রাজত্ব তখন সেখানে উল্লেখ পাওয়া যায় দিলমুন, মাগান আর মেলুহার। এদের সঙ্গেই চলত তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য। দিলমুন হিসেবে চিহ্নিত করা গিয়েছে আজকের পারস্য উপসাগর সংলগ্ন অঞ্চলকে, মাগান এখনকার ওমান। আর মেলুহা-ই হল হরপ্পা সভ্যতা। প্রত্নবিদেরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছেন যে হরপ্পা সভ্যতা থেকে রপ্তানি করা জিনিসপত্র মেসোপটেমিয়ায় যে পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে, সে তুলনায় আমদানি দ্রব্য প্রায় শূন্য। পণ্ডিতরা ধারণা করেছেন যে, হয়তো এমন কোনও বস্তুসামগ্রী হরপ্পায় আসত যা চিরস্থায়ী নয়, সময় যার চিহ্ন মুছে দিয়ে গিয়েছে। তবুও একথা অস্বীকারের কোনও জায়গা নেই যে তার নিজস্ব কেন্দ্রগুলি থেকে যে বস্তুসামগ্রী আদানপ্রদান হতো তাতে সে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল। গুজরাতের লোথালে গড়ে উঠেছিল সমুদ্র বন্দর। আজ প্রায় পাঁচ হাজার বছর পরেও এখনও যা নিজের গরিমা প্রকাশ করে চলেছে। হরপ্পার অধিবাসীরা এমনকী, মেসোপটেমিয়াতেও সম্পূর্ণ নিজেদের একটা গ্রাম গড়ে তুলেছিল।
হরপ্পাবাসীর ধর্মাচরণেও ছিল স্বাতন্ত্র্য। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি স্থানগুলোতে মাতৃদেবতার আরাধনার যে প্রাবল্য লক্ষিত হয়, তেমনটা মোটেও লক্ষ করা যায় না কালিবাঙ্গান, রাখিগরহি বা লোথাল প্রভৃতি কেন্দ্রগুলোতে। এখানে আমরা দেখি অগ্নিকুণ্ড, পশুবলিদান বা কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিবলিঙ্গ। হরপ্পাবাসীর ধর্মে অশ্বত্থ পাতার এক বিশেষ স্থান ছিল। বিভিন্ন শিলমোহর থেকে মৃৎপাত্র সবেতেই অশ্বত্থ পাতার ছবি আমরা দেখতে পাই। দুটি শিং যুক্ত ধ্যানাসনে বসা এক দেবমূর্তিও ছিল হরপ্পাবাসীর আরাধ্য। কিন্তু কোথাও কোনও গগনচুম্বী উপাসনাস্থল প্রস্তুত হয়নি তাঁদের আরাধ্যের জন্য। হরপ্পার মানুষজনের মতোই তাঁদের উপাস্যও অতি সাধারণের মধ্যে দিয়েই হয়ে উঠেছিলেন অনন্য সাধারণ।
এই সভ্যতার দশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় কোথাও কোনও চোখধাঁধানো নির্মাণ নেই। সাধারণ কৃষিকাজ, পশুপালন, ছোটখাট শিল্পসামগ্রী নির্মাণ আর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এই সংস্কৃতিক্ষেত্র।
যদিও ছোট থেকেই বিভিন্ন ইতিহাস বইয়ের পাতায় আমরা দেখে এসেছি, বুঝে এসেছি যে, সিন্ধু সভ্যতা মানেই মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, ধোলাভিরা বা রাখিগরহির মতো নগরই তার আসল পরিচয়, এই সভ্যতা আদপেই একটি নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। তবু এটা তার সামগ্রিক পরিচয় নয়। আমাদের প্রায়ই জানানো হয় না যে, এই নগরের সংখ্যা তো মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। এই সভ্যতার নব্বই শতাংশই মূলত গ্রাম। গ্রামীণ সংস্কৃতির মজবুত ভিত্তিতেই সুদৃঢ় হয়েছিল তার নাগরিক সংগঠন। তাই হরপ্পা সভ্যতাকে আরও কাছ থেকে বুঝে নিতে গেলে কেবল নগরকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। দেখতে হবে হরপ্পার গ্রামবাসী জনজীবনের একদিন প্রতিদিন।
হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের একশো বছর পরও তাই বেশ কিছু বিষয় আজও আমাদের কাছে অধরা থেকে গিয়েছে। আমরা আজও তাঁদের লিখে রেখে যাওয়া অক্ষরগুলি পড়ে উঠতে পারিনি। ফিনিশীয় গবেষক আস্কো পারপোলা বা স্বদেশীয় প্রত্নবিদ এস আর রাও প্রমুখরা চেষ্টা করলেও সাফল্য পাননি। সম্প্রতি বহতা অংশুমালি মুখোপাধ্যায় পাঠোদ্ধার প্রক্রিয়ার একটা রাস্তা বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর এক গবেষণাপত্রে। কিন্তু এর বেশি অগ্রসর আমরা এখনও হতে পারিনি।
হরপ্পা সভ্যতার মানুষেরা কীভাবে তাঁদের মৃতদেহ সৎকার করতেন তারও সামগ্রিক পরিচয় আমাদের কাছে বেশ খানিকটা ছায়াচ্ছন্ন। হরপ্পা, রাখিগরহি, লোথাল, কালিবাঙ্গান, ফারমানা ইত্যাদি কয়েকটা স্থানে কিছু সমাধি পাওয়া গিয়েছে বটে তবে তা হরপ্পার মোট অনুমেয় অধিবাসীর তুলনায় এক শতাংশও নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার অগ্নি সৎকারেরও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তাই অনুমান করা যায় মৃতদেহ সৎকারের একাধিক প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল প্রাচীন মেলুহায়।
হরপ্পাবাসীদের প্রকৃত পরিচয়ও এমন এক প্রশ্ন যেখানে প্রথম দিন থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। সম্প্রতি হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হরিয়ানার রাখিগরহির সমাধিক্ষেত্রের একজন নারীর দেহাবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে যে এঁরা ছিলেন স্থানীয় মানুষ। যাঁরা বিগত দশ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একটু একটু করে গুছিয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের চারপাশটাকে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে একজন অধিবাসীর মুখাবয়ব পুনর্নির্মাণ করেও দেখা গিয়েছে যে আধুনিক সময়ের হরিয়ানার মানুষজনের মতোই ছিল তাঁর অবয়ব।
তবে এই সভ্যতা বিষয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা আজও প্রত্নবিদদের মধ্যে বিতর্ক জাগিয়ে রেখেছে তা হল এর অবসানের কারণ। মোটামুটিভাবে ১৮০০ বা ১৭০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি ক্রমে বিলুপ্ত হতে থাকে। শিলমোহর, মাটির বাসনপত্র, হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্য যুক্ত ইট, শিল্পসামগ্রী আর দেখা যায় না। সাজানো গুছানো নগর বিশৃঙ্খল কাঠামোয় ভরতে থাকে। বাণিজ্যের বিলাসিতা হারিয়ে যায়। নগর সভ্যতার নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে পুনরায় গ্রামীণ সংস্কৃতি নির্ভর আরও সরল এক জীবনধারায় মিশে যায় মেলুহা সংস্কৃতির উপাদানগুলি।
হরপ্পা সভ্যতার এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ হিসেবে ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, অত্যধিক বৃক্ষচ্ছেদন, বহির্বাণিজ্যের অবনতি, বহিঃশত্রুর আক্রমণ বা নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি নানা তত্ত্ব উঠে এসেছে। তবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ অর্থাৎ ১৯০০ বা ১৮০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ প্রাচীন সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া এবং পরিবেশ পরিস্থিতির অবনতির তত্ত্বই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কারের একশো বছর পার করে আমরা ক্রমেই বুঝতে পারছি যে এই খোঁজ তো আসলে আমাদের শিকড়ের সন্ধান। একটু একটু করে আমরা যতই এর কাছে এগিয়েছি, ততই নিজেদের কাছে নিজের অতীতটা একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর তার সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করা যায় যে, এই একশো বছরের হিসেবটা কেবলমাত্র একটা সংখ্যা। পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একটু একটু করে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাকে আগাগোড়া বুঝে নেওয়ার জন্য একশো বছর শুধুই একটা মুখবন্ধ মাত্র। সমগ্র বই তো এখনও পড়েই রয়েছে আগ্রহী পাঠকের অপেক্ষায়।
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষক)
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস