উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
কেল্টুদা নকল ছানাবড়ায় রামকামড়টা দেওয়া মাত্র তিতিরের ঘুমটা ভেঙে গেল। মা ডাকছে... স্কুলের ডাক। চোখটা কিছুতে খুলছে না তিতির। যদি স্বপ্নটা আর একটু ফিরে আসে... কেল্টুদার ক’টা দাঁত ভাঙল দেখতে হবে যে! নাঃ, আর এল না। দু’চোখে ঘুম জড়িয়েই উঠে পড়ল ও। লাল মেঝেতে পা পড়তেই আঙুলগুলো কুঁকড়ে এল। দুগ্গা মা কৈলাসে ফিরে গিয়ে শীতকে তাড়া দিয়েছে। পুজোর ছুটি শেষ... আর পূজাবার্ষিকীও। পুজোর আগে থেকেই পূজাবার্ষিকীগুলো চলে আসে। কাগজকাকু দিয়ে যায়। বাবা বলেই রাখে... বেরনো মাত্র যেন বাড়িতে পৌঁছে যায়। একটা, দুটো, তিনটে...। কিন্তু কিছুতেই তিতির সেগুলো হাতে পায় না। মা যেন ওঁত পেতে থাকে, কাগজকাকু দিয়ে গেলেই সবক’টা পূজাবার্ষিকী উঠে যায় আলমারির উপর তাকে। আর চাবি? তিতিরের নাগালের বাইরে। প্রতি বছরের অনুনয়... ‘একবারটি দাও মা। একটু উল্টে দেখেই ফেরত দিয়ে দেব।’ কিন্তু মা যেন শুনতেই পায় না! উত্তর সেই এক, ‘পরীক্ষা হোক, তারপর।’
হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষাটা ওই সময়েই যে থাকে। পড়া পড়া আর পড়া...। মনটা তিতিরের পড়ে থাকে আলমারির উপর তাকে। এবার বাঁটুল কী করল, নন্টে ফন্টে কি কোথাও ঘুরতে গেল? পিসির বাড়ি বা অন্য কোথাও? নাকি কেক নিয়ে মারামারি করে না খেতে পাওয়া একজন ভিখিরির হাতে সেটা তুলে দিল! হাঁদা ভোঁদাই বা এবার কী করল? হুঁশ ফেরে মায়ের বকুনিতে। সেই কখন থেকে বিজ্ঞান বইয়ের পাতাটা আর উল্টোচ্ছে না যে! মা ঠিক খেয়াল করেছে। প্রতি মাসেই কিন্তু বাড়িতে শুকতারা আর কিশোরভারতী আসে। সেটা বাঁটুলদের জন্যই। কিন্তু পূজাবার্ষিকীর ব্যাপারটাই আলাদা। একটু যেন অন্য কিছু... বেশি ভালো। বন্ধুদের সঙ্গে তখন স্কুলে একদম ঝগড়া চলবে না। কুন্তল বা সুমনের যেমন পরীক্ষা-টরীক্ষার ব্যাপারই নেই! আগেই পূজাবার্ষিকী পড়ে নেয়। কিছুতে পেরে না উঠলেই তখন বলতে শুরু করে, ‘জানিস তো, এবার বাঁটুল না...’। দু’কানে হাত চাপা দিয়ে তিতির পালিয়ে যায়। বলে দিলে তো পড়ার মজাটাই চলে যাবে!
উত্তরাধিকার সূত্রে এই ভালোবাসাটা তিতির পেয়েছে বাবার থেকে। কিশোরভারতী, আর ছোট ছোট শুকতারা... সেগুলো সব পরপর মাস ধরে বাঁধানো। বাঁটুল, নন্টে-ফন্টেদের জন্যই বাবা সেগুলো রেখে দিয়েছে... আজও। প্রথম সেগুলোই উল্টে দেখেছিল তিতির। ছবিগুলো... তাদের কথা... কাহিনি। পরপর পড়ে গিয়েছিল সে। প্রথম দিনেই কীভাবে যেন ওরা সবাই খুব কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিল। বাঁটুল নিয়ে তো কোনও কথাই হবে না। প্রথম বাঙালি সুপারহিরো। বাবার কাছে শুনেছে, কলেজ স্ট্রিট থেকে বাড়ি ফেরার সময় নাকি বাঁটুল দি গ্রেটের ভাবনাটা প্রথম মাথায় এসেছিল নারায়ণ দেবনাথের। আদল অনেকটা ‘ডেসপারেট ড্যান’-এর। কিন্তু আদ্যোপান্ত বাঙালি। কিন্তু দেখতে কেমন হবে? বেশি ভাবতে হয়নি নারায়ণবাবুকে। তাঁর প্রাণের বন্ধুই তো আছে... মনোহর আইচ। চেহারাটা ওরকম হলেই তো হয়! ব্যস, তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেল বাঁটুলের অ্যাডভেঞ্চার। সেই ১৯৬৫ সাল থেকে। গোলাপি স্যান্ডো গেঞ্জি, আর টাইট হাফ প্যান্ট। দুই বিচ্ছু ভাগনে ভজা আর গজা সারাদিন কিছু না কিছু বদমায়েশি করে যাচ্ছে। তাদের সাইজ করাই ছিল বাঁটুলের কাজ। সঙ্গে রয়েছে লম্বকর্ণ, পোষা কুকুর ভেদো আর উটপাখি উটো। মাঝে মাঝে দেখা যেত বুড়ি পিসিমাকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়... প্রকাশকরা চেয়েছিলেন, বাঁটুল যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে কেমন হয়? প্রথম প্রথম খুব একটা ভরসা পাননি নারায়ণবাবু। পরে ভাবলেন, করেই দেখা যাক না! বাঁটুল তারপর পশ্চিম পাকিস্তানের উপর আছড়ে পড়ল। ভেঙে ফেলল প্লেন, ট্যাঙ্ক... সব খালি হাতে। পাকিস্তানি সেনা ট্যাঙ্ক থেকে গোলা ছুঁড়ল বাঁটুলকে লক্ষ্য করে। আর বাঁটুল? ফুঁ দিয়ে সেই গোলা ফিরিয়ে দিল শত্রুপক্ষের দিকে। তারপর ওদের ট্যাঙ্কের সামনেটা ধরল... যেখান দিয়ে গোলা বের হয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ট্যাঙ্কটা হয়ে গেল টেনিস র্যাকেটের মতো। হুঙ্কার ছাড়ল বাঁটুল, ‘সব প্যাটন পেটা করে ছাড়ব।’ বাবা বলে, আর হাঁ করে শোনে তিতির।
স্কুলের মাঠে ওপাশের পাঁচিলের দিকে কয়েকটা গর্ত আছে। তিতিরের কল্পনার জালে সেগুলো হয়ে যায় খরগোশের ঘরবাড়ি। টিফিন টাইমে ওখানে মাঝে মাঝে গিয়ে দাঁড়ায় তিতির। এপাশ ওপাশ দেখে নেয়... কেউ নেই তো! তারপর প্রাণপণে ফুঁ লাগায় গর্তে। ফুঁয়ের জোরে অন্য গর্তগুলো দিয়ে যদি খরগোশ বেরিয়ে আসে... ওফ্, সে এক দারুণ ব্যাপার হবে।
* * *
গাড়িটা ফ্ল্যাটের পার্কিং স্লটে রাখতে গিয়ে সমরেশের নজরে এল, পিছনের গাড়িটা অনেকটা এগিয়ে। বিরক্তিতে জিভ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল... ওফ, আবার! এই ভদ্রলোককে বলে বলে আর পারি না! সমরেশের গাড়িটা এখন কিছুটা বেরিয়ে থাকবে। এত রাতে ডাকাও মুশকিল! ধুস! হঠাৎই একটা কথা মাথায় আসা মাত্র হেসে ফেলল সমরেশ... বাঁটুলের কথা। ও যদি সত্যিই থাকত, তাহলে আর চিন্তা ছিল না। টোকা মেরে গাড়িটা সরিয়ে দিত। বিরক্তিটা হুশ করে উধাও হয়ে গেল। লিফটটা তিন তলায় পৌঁছে গিয়েছে। নেমপ্লেটটা দেখলে এখন সমরেশের মনটা খুশি খুশি লাগে। সদ্য করিয়েছে... বাবুইয়ের নামটা জুড়ে। ও এখন সাতে পড়েছে। বাবুইয়ের মধ্যে নিজের ছেলেবেলাটা খুঁজে পায় সমরেশ। সেই খেলতে যাওয়ার বায়না, একগাদা প্রশ্ন, কমিকস... এখানেই সমরেশের মন খারাপের দিস্তা। বাবুইয়ের পড়া বলতে যত স্পাইডারম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, আয়রন ম্যান...। কী যে আনন্দ পায়! এত বলেকয়েও নন্টে ফন্টে, বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদাদের জন্য ওর মনে ভালোবাসা জাগাতে পারল না সমরেশ। ছুটির দিনে এখনও মন চায় বইয়ের আলমারি থেকে পুরনো বাঁধাই করা কমিকসগুলো বের করতে... একলপ্তে পুরোটা পড়ে ফেলতে। ফোনে পর্যন্ত পিডিএফ নিয়ে রেখেছে সমরেশ। মেজাজ ঠিকঠাক না থাকলেই খুলে চোখ বোলায়।
অবাক হল সমরেশ... এত রাতেও পড়ছে বাবুই। তারপরই মনে পড়ল, কাল তো ক্লাস টেস্ট! কোভিডের কল্যাণে অনলাইনে বিদ্যা জরিপ। ছেলে পরীক্ষা দিল, নাকি মা... সে দেখার উপায় নেই।
—কী এত পড়ছিস রে! চল চল, উঠে পড়...।
কথাটা বলেই সুট করে বাথরুমে ঢুকে পড়ল সমরেশ। শুনল পিছন থেকে হুঙ্কার... ‘কী উঠবে? দাঁড়াও! কিচ্ছু পারছে না। জানো তুমি? সারাদিন ছিলে পড়ানোর জন্য? ছেলের পড়ার দিকে এতটুকু নজর আছে? বড় স্কুলে ভর্তি করলেই হয় না...।’
বোমা যে পড়বে, সেটা আন্দাজ করেইছিল সমরেশ। তাই কথাটা ছুড়েই ঢাল বানিয়ে নিয়েছিল বাথরুমের দরজাটাকে। সেখান থেকেই শুনল শ্রীপর্ণা বলে চলেছে, ‘পড়া নিয়ে বসার বেলায় নেই, সারাদিন শুধু কমিকস হাতে নিয়ে ছেলেকে উস্কে যাচ্ছে!’
শ্রীপর্ণা বোঝে না, এই কমিকসগুলোই যে শৈশব! নন্টে ফন্টে কেল্টুদারাই বানাবে কৈশোরের শক্ত ভিত। বাবুই পড়ে না তো কী হয়েছে, সমরেশ সময় সুযোগ পেলেই ওকে গল্প শোনায়। বাঁটুলের গল্প, সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের হাউমাউ, কেল্টুদার মাতব্বরি...। উফ্ কী একটা ক্যারেক্টারই না বানিয়েছেন নারায়ণবাবু...। ভালো নাম জানে না সমরেশ। জানার দরকারও পড়েনি কোনওদিন। কেল্টুদাই যথেষ্ট। সে মিথ্যে বলে, চুরি করে, তার জন্য দফায় দফায় নন্টে আর ফন্টেকে হেনস্তা হতে হয়... তাও কেল্টুদা একটা আলাদা আকর্ষণ। সবাই হাফ প্যান্ট, কিন্তু কেল্টুদা ফুল। সবেতে তার মাতব্বরি। খেলতে নেমে আগে ব্যাট করবে, নন্টে ফন্টে খাবার আনলে হাতিয়ে নেবে, কথায় কথায় হম্বিতম্বি করবে... তারপরও মনে হবে, এই দাদাটি না থাকলেই নয়! বাবুই শোনে... মন দিয়ে। সমরেশের সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কলমের জাদু থেকে বেরিয়ে আসা চরিত্রগুলোকে দেখার চেষ্টা করে। বুঝতে চায়।
* * *
—বল তো দেখি, হাঁদার পুরো নাম কী?
—হুঃ, হাঁদারাম গড়গড়ি। ভেবেছিস কী, জানি না! তুই বল তো ভোঁদার পুরো নাম কী?
—ভোঁদা পাকড়াশী। তোর থেকে বেশি জানি।
—বাজে বকিস না। হাঁদা-ভোঁদার পিসেমশাইয়ের নাম জানিস?
—জানি রে জানি, বেচারাম বক্সি।
তিতিরের প্রাণের বন্ধু অনির্বাণ। গলায় গলায় ভাব। কিন্তু ঝগড়াও হয় পুরোদস্তুর। আর একবার ঠোকাঠুকি লেগে গেলেই হল... শুরু হয়ে যায় কমিকস-যুদ্ধ। যে উত্তর দিতে পারবে না, তাকে কান ধরে ১০ বার ওঠবোস করতে হবে। ঝগড়ার সেখানে ইতি। এই লড়াইটা বেশ উপভোগ করে তিতির। সবচেয়ে মজাদার সাবজেক্টের পরীক্ষার মতো। ভাবে, ইস্... যদি ক্লাসের একটা সাবজেক্ট নন্টে ফন্টে হতো, কিংবা বাঁটুল... কী মজাটাই না হতো। তিতির ঠিক একশোয় একশো পেত। আর কেউ ওর ধারেকাছে আসতে পারত না... নাঃ, একটু ভুল হয়ে গেল। অনির্বাণও একশো পেয়ে যেত। তা পাক। অনির্বাণ একশো পেলে ওর এতটুকু দুঃখ নেই। ওদের ক্লাসে ফার্স্ট হয় অভিনন্দন। ওকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের নাম কী? কিছুতেই পারবে না। অনির্বাণ কিন্তু বলবে, ‘এ মা এটাও জানিস না...।’ এজন্যই অনিকে এত ভালো লাগে তিতিরের।
* * *
স্কুলের দু’জন বন্ধুকে ফোন করা হয়ে গিয়েছে সমরেশের। কেউ নম্বরটা দিতে পারল না। আর তো তেমন কারও সঙ্গে যোগাযোগই নেই! তাহলে কার থেকে পাবে...। সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটতে শুরু করল সমরেশ। ফেসবুকে ওই নামে অনেক প্রোফাইল। খুলছে আর ছবি দেখে মেলানোর চেষ্টা করছে সমরেশ। ভেতরটা অধৈর্য হয়ে পড়ছে। স্কিপ করতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল... এটাই না? অনির্বাণ রক্ষিত, ওয়ার্কস অ্যাট ক্যাপজেমিনি... ওয়েন্ট টু যাদবপুর বিদ্যাপীঠ। এই তো! পাওয়া গিয়েছে। ফোন নম্বরটা প্রোফাইলে আছে তো?... আছে। আর চিন্তা নেই। নম্বরটা ডায়াল করল সমরেশ।
—হ্যালো!
ছেলেবেলার মতো একটা উত্তেজনা হচ্ছে সমরেশের।
—সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের নাম কী?
—অ্যাঁ... আচ্ছা... এটাও জানিস না ইডিয়ট, হাতিরাম পাতি।
হো হো করে হেসে ফেলল তিতির। ফোনের ওপারে হাসছে অনিও।
* * *
বাবুইয়ের সঙ্গে সোফায় গা এলিয়ে লরেল-হার্ডি দেখছে সমরেশ। বহুবার দেখা... ছেলের জন্যই রোমন্থন আর কী! চোখ দুটো একটু লেগেই এসেছিল...
—আচ্ছা বাবা, এই লরেল-হার্ডি অনেকটা হাঁদা আর ভোঁদার মতো না! বয়সটা শুধু একটু বেশি!
তন্দ্রা ছুটে গেল সমরেশের। ‘কী বললি?’
—বললাম, এদের বয়সটা কমে গেলে হাঁদা-ভোঁদার মতো লাগবে না?
—তুই হাঁদা-ভোঁদা পড়েছিস?
—উমমম... একটু একটু।
—কোথায় পড়েছিস?
—ওই যে তোমার মোটা মোটা বইগুলো আছে না...
—তোকে কে নামিয়ে দিল?
—কেন... মা! আমার হাত কি আর অত ওপরে যায় নাকি?
সমরেশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শ্রীপর্ণাকে। ডাইনিং টেবিলে বসে কড়াইশুঁটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মুখে একচিলতে হাসি।
—আর কী পড়েছিস?
—বাঁটুল কিন্তু খুব ভালো। সুপারম্যানের মতো। কিন্তু উড়তে পারে না এই যা। আসলে বাংলাটা আমি তো তাড়াতাড়ি পড়তে পারি না, তাই সবটা বুঝতেও পারছি না। টাইম লাগবে। তাড়াহুড়ো কোরো না।
বাবুইয়ের পাকা পাকা কথায় হেসে ফেলল সমরেশ। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে বাংলাটা সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ। তাও অদ্ভুত পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। মাথামুণ্ডু বোঝে না সমরেশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এরা কি কোনওদিন বাংলা কমিকস, সাহিত্যের মজাটা নিতে পারবে না! আজ সত্যি দারুণ লাগছে ওর। আর এক্ষেত্রে হ্যাটস অফ শ্রীপর্ণা। বীজ রোপণ করাটাই ছিল আসল। সেটা ও করতে পেরেছে। এত বছরের চেষ্টায় যা করে উঠতে পারেনি সমরেশ।
—আচ্ছা বাবা, নন্টে আর ফন্টেকে তুমি আলাদা করে চেনো কী করে? দু’জনকেই তো একরকম দেখতে।
লাফিয়ে উঠল সমরেশ। ‘দাঁড়া বইটা নিয়ে আসি...।’
—এই দেখ, নন্টের চুলের পিছন দিকে কেমন একটা টিকি মতো আছে। আর ফন্টের নেই। এটা দেখলেই বুঝতে পারবি।
—কেল্টুদা খুব দুষ্টু না? খালি খালি নন্টে-ফন্টেকে জ্বালাতন করে!
—ওটাই তো মজা রে... ধর কেল্টুদা বোর্ডিং ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাহলে দুষ্টুমিটা করবে কে? নন্টে-ফন্টেই বা কাকে শায়েস্তা করবে বল?
—সেটা ঠিক বলেছ। তাই তো মোটা মতো স্যারটা কেল্টুদাকে সারাক্ষণ তাড়া করে।
মনটা ভরে যাচ্ছে সমরেশের। ওর জন্মেরও কত আগে নারায়ণ দেবনাথ চরিত্রগুলো তৈরি করেছিলেন। সবার আগে ছিল হাঁদা-ভোঁদা। প্রায় ৬০ বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও তারা কিশোর... স্কুলের গণ্ডির সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে এরা সবাই। ছেলেমেয়েদের ভালোলাগা, ভালোবাসা, অ্যাডভেঞ্চার... সব কিছুতেই আছেন নারায়ণ দেবনাথ। পদ্মশ্রী পেয়েছেন... সেদিন কাগজে পড়েছে সমরেশ। আর ভেবেছে, এতদিন পর কেন? আর শুধু এই পদ্মশ্রী বা আক্ষরিক কোনও সম্মানে কি তাঁর সৃষ্টি বেঁধে রাখা যায়? তিনি তো এই সবেরই উপরে। কচিকাঁচাদের ছোট্ট মনে বিরাট যে জায়গাটা তিনি তিলেতিলে গড়ে তোলেন, সেটাই তো পুরস্কার... সম্মান।
—হ্যাঁ রে, তোর ওই আয়রন ম্যান, স্পাইডারম্যানরা কোথায়?
—আছে, তোমার আলমারিতে। মাকে বলেছি তুলে রাখতে। আমি এখন নন্টে ফন্টে পড়ছি। তারপর বাঁটুল, তারপর হাঁদা ভোঁদা পড়ব।... আচ্ছা বাবা, আমাদের ফ্ল্যাটের নীচে একটা বিড়াল এসেছে... তুমি দেখেছ?
—হুম, দেখেছি। কালো বিড়াল।
—না, না... তুমি ভালো করে দেখোনি। ওটা একেবারে কালো বিড়াল নয়। ওর সারা গা কালো, কিন্তু বুক-পেটের কাছটা পুরো সাদা।
—তাই নাকি? খেয়াল করিনি তো!
—বাবা তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। মা একদম ঠিক বলে। ওটা তো এক্কেবারে বাহাদুর বিড়ালের মতো! আমি আর মা ওকে বাহাদুর বলেই ডাকি।
সত্যি... অদ্ভুত একটা ভালোলাগা, শান্তি ঘিরে ধরেছে সমরেশকে। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ব্যাটন হাত বদল করছে। উত্তরাধিকার সূত্রে বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদারা ছবি আঁকছে নতুনের বুকে। কৃতিত্ব একজনেরই... নারায়ণ দেবনাথ। আজও তিনি কচিকাঁচাদের সেন্ট ভ্যালেন্টাইন।