আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
জগন্নাথের বিষয় আশয়...
বিষয় আশয় থেকে রোজগার কমে যাওয়ায় নীলাচলপতির বিলাস বসনে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছে। বারো মাসে তেরো পার্বণে তাঁর জমকালো নানাবিধ পোশাকের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগানোও মুশকিল হয়ে পড়ছে। অনেক ‘বেশ’ কালক্রমে অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে। হাতি-ঘোড়া-আসবাব-তৈজসপত্র বাদ দিয়েও প্রভু শ্রীজগন্নাথের রয়েছে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিশাল এক মালিকানা। ‘মাদলাপাঁজি’র বর্ণনায় ওড়িশার রাজা অনঙ্গভীমদেব একাই আড়াই লক্ষ সোনার মোহর দান করেছিলেন। সূর্যবংশীয় রাজারাও তাদের আরাধ্য দেবতাকে দানধ্যান করেছিলেন প্রচুর। তবে মুসলিম শাসকরা বারেবারে শ্রীজগন্নাথের রত্নভাণ্ডার লুট করেছে। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘কালাপাহাড়’ শ্রীমন্দিরকে ধ্বংস করে, লুট করে রত্নভাণ্ডারের যাবতীয় ধনসম্পত্তি। রাজা পুরুষোত্তম দেবের রাজত্বকালে ‘কেসোদাস মারু’ নামে এক মুঘল সুবেদার লুটপাট চালায় মন্দিরে। যদিও উপহার হিসেবে প্রাপ্ত, ১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দের বিভিন্ন অলঙ্কার বর্তমানেও ব্যবহৃত হচ্ছে। সোনা-হীরে-জহরত-নীলকান্তমণি-প্রবাল-মুক্তো ছাড়াও রয়েছে রুপোর নানা দুর্মূল্য অলঙ্কার ও তেজস। ‘রেকর্ড অব রাইটস’-এর চতুর্থ ভাগে দেখা যাচ্ছে রত্নভাণ্ডারের ‘বাহার ভাণ্ডারে’ তিনটে সোনার নেকলেস বা ‘হরিদা খাণ্ডি মালি’ রয়েছে, যার প্রতিটির ওজন ১২০ তোলা বা ১৩৯৯.৬৫৬ ভরির বেশি। জগন্নাথ-বলভদ্রের সোনার শ্রীভুজ আর শ্রীপায়েরার ওজন ৮১৮ (৯৫৪০ ভরি) এবং ৭১০ (৮২৮১ ভরি) তোলা। শ্রী জগন্নাথ, শ্রীবলভদ্র ও সুভদ্রার সোনার মুকুটের ওজন যথাক্রমে ৭১১৪ ভরি, ৫০৬২ ভরি ও ৩২০৭ ভরি। রয়েছে সোনার জপমালা, স্বর্ণপত্র, সোনার ফুলদানি, সোনার কৌটো, সোনার বাটি, সোনার ছাতা, উষ্ণীষ, সোনার গ্লাস, স্বর্ণকলস, সোনার রণভেড়ি, সোনার ছোরার হাতল, স্বর্ণঝাড়ি, সোনার জগ, প্লেট, বাতিদান, সোনার পিকদান-টায়রা-ছোট সোনার ছাতা। রয়েছে রুপোর কলসি-পদ্মফুল-শঙ্খ-তালাচাবি-লাঠি, সাতটা বাতির ঝাড়লণ্ঠন, শাবল, ছোট তরোয়াল, রুপোর গাছে ফুলের মতো ফুটে থাকা শাঁখের গুচ্ছ, সানাই, বাঁশি, চক্র, ঢাল, কোমরবন্ধ প্রভৃতি। রত্নভাণ্ডারের ‘বাহার’ বা ‘বাইরের ভাণ্ডার’ তিনটে তালাচাবি ও ‘ভিতর ভাণ্ডার’ দু’টো তালাচাবিতে সুরক্ষিত। একটি চাবি রাজার কাছে থাকে, অন্য দুটি যথাক্রমে ‘ভাণ্ডার মেকাপ’ ও মন্দির কর্তৃপক্ষের হেফাজতে থাকে। রত্নভাণ্ডারের রত্নসামগ্রীকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। ভিতর ভাণ্ডারের (১ নং বিভাগ) রত্ন কখনও ব্যবহার করা হয় না। দ্বিতীয় ভাগের রত্নরাজিকে বিভিন্ন উৎসবে, পার্বণে ব্যবহার করা হয় আর সর্বশেষ ভাগের (৩নং বিভাগ) রত্ন-অলঙ্কার নিত্যদিনের সেবাকাজে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৬—৭৮ সালব্যাপী সরকারি তত্ত্বাবধানে রত্নভাণ্ডারের চুলচেরা হিসেবনিকাশ পর্ব চলে। তারপরে প্রস্তুত করা হয় এক সুবিস্তৃত তালিকা। সেই তালিকা অনুযায়ী ১ নং বিভাগে রয়েছে ৩৬৭ ধরনের সোনার অলঙ্কার/সামগ্রী যা কখনও ব্যবহার করা হয় না। তার ওজন ৪৩৬৪ ভরি। ২ নং বিভাগের ৭৯ ধরনের সোনার গহনা বিভিন্ন পার্বণে ব্যবহৃত হয়, তার ওজন ৮১৭৫ ভরি। আর শেষ বিভাগে ৮ ধরনের নিত্যব্যবহার্য গয়নার ওজন ২৯৯ ভরি। সবমিলিয়ে ৪৫৪ ধরনের সোনার গহনা বা সোনার সামগ্রীর ওজন ১২ হাজার ৮৩৮ ভরি। তেমনই ২৯৩ ধরনের রুপোর গহনা বা অন্যান্য বস্তুর ওজন ২২ হাজার ১৫৩ ভরি। ওড়িশার রাজ্যপালের অনুরোধে তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল ৪ জন বিখ্যাত স্বর্ণকারকে ওড়িশায় পাঠান। তাঁরাই রত্নরাজির সঠিক মূল্য নির্ধারণ করেন। এছাড়াও শ্রীজগন্নাথদেবের রয়েছে প্রচুর ভূসম্পত্তি। প্রায় নিখরচায় বছরের পর বছর সেখানে বসবাস বা চাষবাস করছেন বহু-মানুষ। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসের হিসেব অনুযায়ী ‘সর্বরাকর’, ‘একহাজারত মহল’ ও ‘সাইতিশহাজারি মহলে’ রাজস্ব বকেয়া ৩০ লাখ টাকার বেশি। মন্দির কর্তৃপক্ষের বয়ানে মামলা চালানোর মতো অর্থনৈতিক সঙ্গতি শ্রীজগন্নাথদেবের নেই। সুতরাং গগনচুম্বী বকেয়া অনাদায়ীই থেকে যাচ্ছে। তাই সরকার এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে ভাবনাচিন্তা চলছে শ্রীজগন্নাথদেবের কিছু অলঙ্কার বন্ধক রেখে যদি মোটা অঙ্কের সুদ মেলে, তাহলে সংসারের হালও ফেরে আর মামলা মোকদ্দমার খরচটাও উঠে আসে।
ইতিহাসের আলপথ বেয়ে...
সত্যযুগে রথযাত্রার অবতারণা ভক্ত প্রহ্লাদের হাত ধরে। ভবগান বিষ্ণুকে রথে উপবেশন করিয়ে তা নিজে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ভক্ত প্রহ্লাদ। তাঁর হৃদয়-রথে তখন অধিষ্ঠিত স্বয়ং তাঁর ভগবান। বর্তমান যুগের রথযাত্রায় আপামর বিশ্ববাসীর ভগবান জগন্নাথদেব। শ্রীমন্দির থেকে ভাই-বোনকে নিয়ে গুণ্ডিচা মন্দিরে তাঁর আগমনই সাড়ম্বরে পালিত হয় পুরীতে। উৎকলভূমি পেরিয়ে সেই রথযাত্রার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
পুরাকালে অবশ্য মোট ছ’টি রথের প্রয়োজন পড়ত। বড়দাণ্ড বা শ্রীমন্দির থেকে গুণ্ডিচা বাড়িতে যেতে সারদা নদী পেরোতে হতো। বর্তমানের বলগন্ডীতে বয়ে যেত সারদা নদী। আদরের মাসি দেবী অর্ধাশনির অবস্থান সেখানেই। রথ নদী পেরোতে পারবে না বলে নদীর অপর পাড়ে রাখা থাকত আরও তিনটি রথ। অর্ধাশনির মন্দিরে চালের পিঠের ভোগ জগন্নাথের খুব প্রিয়। ভোগ খেয়ে মাসির আদর যত্নে কিছুদিন কাটিয়ে আবার সারদা নদীর অপর পাড়ে যাত্রা।
গোটা যাত্রাপথে সপার্ষদ নৃত্যরত চৈতন্য মহাপ্রভু দিনের বেলায় রথের সঙ্গেই থাকতেন। সন্ধ্যা ঘনালে বিশ্রাম নিতেন ‘জগন্নাথবল্লভ উদ্যানে’। মহাপ্রভুর সঙ্গে প্রভু নিত্যানন্দ, নরহরি সরকার, বক্রেশ্বর পণ্ডিত এমনকী শ্রী-অদ্বৈতও উন্মত্তের মতো নেচে চলতেন। ভাবাবেগে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত সকলের। মহাপ্রভুর দু’চোখ বেয়ে অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। তিনি একবার সামনে একবার পিছনে, এভাবেই সকলকে সঙ্গত করছেন। রথের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে শ্রীচৈতন্য, মেঘশ্যামল-দেবকীনন্দনের উদ্দেশ্যে গাইছেন, ‘নাহর বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্য ন শূদ্র....।’ রাজা প্রতাপরুদ্রের চোখের সামনে ঘটে চলেছে মহাজাগতিক দৈবলীলা। শ্রীজগন্নাথ তন্ময় হয়ে মহাপ্রভুর শ্লোক শুনছেন। শুনতে শুনতে বিগলিত তিনি। আরাধ্য আর আরাধ্যা কখন যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেলেন। বিষয়ী প্রতাপরুদ্র দেখছেন রথের উপরে আসীন যিনি, রথের সামনেও সেই তিনি। এই মহাভাব প্রত্যক্ষ করে স্বরূপ গেয়ে উঠলেন সেই বিখ্যাত গান, ‘সেই তো প্রাণনাথ পাইলুঁ/ যাহা লাগি মদনদহনে ঝুরি গেলুঁ’। মহাপ্রভু তাঁর গলার গোড়ের মালাটি ছুঁড়ে দিলেন জগন্নাথের দিকে। জগন্নাথের কণ্ঠবেষ্টিত সেই মালা আবার ফিরে এল মহাপ্রভুর কাছে। একের পর এক মালা মহাপ্রভু নিচ্ছেন, তদগতচিত্তে তা ছুঁড়ে দিচ্ছেন ভক্তদের উদ্দেশ্যে। কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন এঁকে রথ চলেছে নিকুঞ্জে। ভাবলীলার আবেশে থেমে যায় পরমভক্ত নরপতি প্রতাপরুদ্রের হাতের সোনার ঝাড়ু। সম্বিত ফিরলে ফের তিনি চন্দনের জলে ধুইয়ে দিতে শুরু করেন ধূলিমলিন রথের রাস্তা। রাধাস্বরূপে গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা রথের ‘দক্ষিণামুখী’ প্রত্যাগমন অর্থাৎ গুণ্ডিচা থেকে শ্রীমন্দিরে আগমনকেই প্রাধান্য দেন বেশি।
প্রতাপরুদ্রের রাজত্বের শেষদিকে রথ বিধিমাফিক পথে নামল। ডাহুক আর কলাবৈঠিয়ারা রথ টানতে উদ্যোগী হল। কিন্তু রথের চাকা নড়ে না। এল হস্তীযূথ। তাদের প্রবল পরাক্রমেও রথ নট নড়নচড়ন। আশঙ্কিত রাজা ভাবলেন নিশ্চয়ই নিয়ম পালনে নিষ্ঠার অভাব হয়েছে। কুপিত ও রুষ্ট হয়েছেন প্রভু। দৌড়ে গেলেন মহাপ্রভুর কাছে। রাজার মিনতিতে ধীরেসুস্থে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য এলেন রথের কাছে। প্রথমেই হস্তি-ডাহুক-কলাবৈঠিয়া থেকে মুক্ত করলেন রথকে। তারপর রথের রজ্জু ভক্তদের হাতে তুলে দিয়ে পরম মমতায় স্পর্শ করলেন রথ। গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলল রথ। রজ্জুর টানে নয়, ভক্তিসুধারসের প্রাবল্যে রথ যেন উড়ে চলল। রাজা প্রতাপরুদ্র মহাপ্রভুর পায়ে লুটিয়ে পড়েছেন, চোখের জলে ধুয়ে গেল দুই কোমল শ্রীচরণ। পার্থিব জগতের মায়া কাটিয়ে মহাপ্রভু যখন বিষ্ণুলোকে, প্রতাপরুদ্রের মনে হচ্ছে এই বিশ্বসংসার ফাঁকা, অর্থহীন এক প্রলাপ। সর্বহারা প্রতাপরুদ্রের অবস্থা বোধহয় সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন রবি-বাউল। তাই তিনি গাইলেন ‘সে যে মনের মানুষ/ কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে?/ ডাক না রে তোর বুকের ভিতর,/ নয়ন ভাসুক নয়নধারে’।
রথের পনেরো দিন আগে অনরবাহ প্রথায় ‘স্নানযাত্রা’ সমাপ্ত হয়। ১০৮ ঘড়া বদ্ধ কুয়োর জলে অবগাহনের ফলে জগন্নাথদেবের জ্বর হয়। ‘চাহনি মণ্ডপ’ থেকে গোটা স্নানযাত্রা প্রত্যক্ষ করেন শ্রীলক্ষ্মী। অন্ত্যজ দয়িতাপতিরা মা লক্ষ্মীর সঙ্গে যৌথভাবে সেবা-শুশ্রূষায় সারিয়ে তোলেন জগন্নাথকে। শ্রীঅঙ্গ নতুন করে চন্দন চর্চিত হয়। এই ১৫ দিন জগতপতি থাকেন অন্তরালে।
স্নানযাত্রার সময় শ্রীজগন্নাথ ‘গণেশ বেশ’ ধারণ করেন। গণপতি বেশেরও রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। কর্কট দেশের ‘কানিয়ারি’ গ্রামে বাস করতেন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ গণপতি ভট্ট। ‘ব্রহ্মপুরাণ’-এর একটি শ্লোকে তিনি দেখলেন, স্বয়ং বিষ্ণু স্থূল শরীরে নীলাচলে বিরাজমান। তাঁর দর্শনেই জন্মমৃত্যুর অমোঘ কালচক্র থেকে জীবকুলের মুক্তি। যাত্রা শুরু হল নীলাচল অর্থাৎ পুরী অভিমুখে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গণপতি পৌঁছলেন পুরীর সিংহদ্বার ‘আঠারো নালায়’। প্রতি বছর বন্যায় উৎকলে প্রচুর ফসল নষ্ট হতো। তাই প্রজাদের দুর্গতির দিকে তাকিয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ‘মুটিয়া’ নদীর উপর আঠারোটি নালার সমাহারে এক সেতুবন্ধন করলেন। আঠারো নালার স্থাপত্য আজও বিস্ময়। কথিত আছে, আঠারো নালাতে উপস্থিত হয়েই নাকি শ্রীজগন্নাথ দর্শনের আনন্দে মহাপ্রভু মহাভাবে নিমজ্জিত হন। যাই হোক, গণপতির সামনে দিয়ে কয়েকজন লোক তখন নীলাচলনাথের দর্শন সেরে হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে আঠারো নালা পেরচ্ছিল। গণপতি ভাবলেন, এরা তাহলে মুক্তিলাভে অসমর্থ। কারণ, ব্রহ্মস্বরূপে পরমাত্মার সঙ্গে মিলনে তো নশ্বর দেহ থাকারই কথা নয়। দ্বিধাগ্রস্ত ব্রাহ্মণ! তবে ব্রহ্মপুরাণ কি ভুল? গণপতির সংশয়ের অবসানে সৌম্য বৃদ্ধের বেশে হাজির হলেন স্বয়ং মদনমোহন। গণপতির সংশয় নিরসন করলেন। পরমব্রহ্ম সত্যিই নীলাচলে উপস্থিত, কিন্তু তিনি যে বাঞ্ছাকল্পতরু। যে ভক্ত তাঁর কাছে যা চায় তিনি সেভাবেই তার বাসনার নিবৃত্তি ঘটান। যে পথিকদল হাসতে হাসতে সংসারে ফিরে গেল, তারা তো সংসারে ফিরতেই উন্মুখ। আর যে মুক্তি চায় মুরলীধর তাকে মুক্তি দেন। গণপতি বৃদ্ধের কথা শুনে উপস্থিত হলেন শ্রীমন্দিরে। সেদিন ছিল স্নানযাত্রা। গণপতি ভট্টের দৃষ্টি চুম্বকের মতো স্থির শ্রীবিগ্রহের বিশাল নির্লিপ্ত দুই নয়নে। পরমব্রহ্মের এরকম মানুষী চোখ কেন? এ দারুমূর্তি কখনওই সচ্চিদানন্দ নন! তার এত পথ আসাটাই বৃথা। মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়ায় গণপতি ভট্ট আবার ফিরে যেতে উদ্যত! ভক্ত আহতচিত্তে ফিরে যাচ্ছে দেখে জগন্নাথের হৃদয় আলোড়িত হল! জগমোহনে গতকালের প্রবল খাটাখাটনিতে সেবক বিষ্ণুশর্মা মুদিরথ পান্ডা তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। প্রভুর স্বপ্নাদেশে ঘুম ভেঙে তড়িঘড়ি মূল ফটকের দিকে ছুটে ধরে আনলেন গণপতি ভট্টকে। স্তম্ভিত গণপতি অতিপ্রাকৃতের আশায় আবারও চললেন বিগ্রহ সমীপে। কিন্তু তাঁর আরাধ্যকে তো সেই ঠুঁটো বিগ্রহ-মূর্তিতে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না! হঠাৎ কে যেন কানে কানে গণপতি ভট্টকে বলল, ‘মনকে স্থির সংযমী করে অবলোকন কর দারুমূর্তিকে।’ দু’বার চোখ কচলে গণপতি ভট্ট দেখলেন শুঁড়দোলানো একদন্ত গণেশ তাঁর দিকে চেয়ে ফিকফিক করে হাসছে। স্বয়ং শ্রীহরি হাত বাড়িয়ে গণপতিকে ডাকছেন, ‘এসো, আমার কাছে এসো, পরমভক্ত আমার, আমার হৃদয়ে লীন হয়ে যাও’। গণপতি তখন প্রাণের ঠাকুর শ্রীজগন্নাথকে অনুরোধ করলেন, ‘করুণাসাগর, তুমি যদি ভক্তবাঞ্ছায় কল্পতরু হও, তাহলে তোমার এই অধম ভক্তের ইচ্ছাপূরণে প্রত্যেক স্নানযাত্রায় গণপতি বেশ ধারণ করবে!’ তারপর সমবেত জনতা চোখের সামনে দেখল গণপতি ভট্টের দেহ থেকে এক আঙুল সমান দিব্য জ্যোতির্ময় এক পুরুষ পরমাত্মার শরীরে লীন হয়ে গেল! গণপতির নিথর শরীর ভূপতিত পাথরের পাষাণ মেঝেতে। সেই থেকে স্নানযাত্রার দিন, ‘গণেশ বেশে’ সাজিয়ে তোলা হয় জগন্নাথদেবকে। স্মরণ করা হয় পরম ভক্ত গণপতি ভট্টকে।
বৌদ্ধধর্মের আচার বিচারের কিছু ছাপ বিদ্যমান জগন্নাথ তর্পণে। শ্রীমূর্তির শরীরে ব্রহ্মমণি বা শ্রীকৃষ্ণের অস্থির সংস্থাপন হয় নবকলেবরে। হিন্দুধর্মে মৃতদেহের দাঁত-নখ-অস্থি-চুল অপবিত্র, তার সংরক্ষণ শাস্ত্রসম্মত নয়। কিন্তু বৌদ্ধরা মৃতদেহের দাঁত-নখ-চুল সংরক্ষণ করে তার উপর স্তূপ নির্মাণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের অস্থি সংরক্ষণ, নবকলেবরে তা পুনঃস্থাপন স্পষ্টতই বৌদ্ধপ্রভাব। বহুকাল পরে দাক্ষিণাত্যের সুদূর কেরলের পাণ্ড্যপ্রদেশে থেকে পাণ্ডাবিজয় নামে এক পরাক্রমী রাজা উৎকলরাজ্যে আসেন। সঙ্গে ছিলেন বিষ্ণু অন্তপ্রাণ মন্ত্রী দেবেশ্বর। রাজা-মন্ত্রী সদলে উদ্ধার করেন দারুমূর্তিকে। গুণ্ডিচামন্দিরের মহাবেদিপিঠ, যেখানে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সহস্র অশ্বমেধযজ্ঞ সমাধা করেন, সেখানে তিনটি দারুমূর্তির অভিষেক পর্ব সম্পন্ন করান তিনি। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন ত্রিমূর্তিকে। রথযাত্রার সময় ত্রিমূর্তির শ্রীমন্দির থেকে গুণ্ডিচামন্দিরে আগমন ঘটে। তাই রথযাত্রা ‘পাণ্ড্যবিজয়’ বা ‘পহণ্ডিবিজয়’ নামেও পরিচিত।
রত্নভাণ্ডারের অদ্যাবধি অপ্রকাশিত, যাবতীয় গোপন সরকারি তথ্য, পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের ভূতপূর্ব প্রশাসক ও বর্তমান লিয়াঁজ অফিসার ডঃ ভাস্কর মিশ্রের সৌজন্যে প্রাপ্ত।