গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
খারদুংলা। একসময় এই রাস্তাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মোটরযান যোগ্য পথ। হাজার হাজার পর্যটক লাদাখে আসে এই দুঃসাহসিক মোটরযান অভিযানের জন্য। সেই অভিযানের সাক্ষী হতেই লাদাখের উদ্দেশে আমরা কয়েকজন বন্ধু পাড়ি দিয়েছিলাম।
হিমাচল প্রদেশের মানালি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম। দূরত্ব প্রায় ৪৭৩ কিমি। রোটাং পাস হয়ে আমাদের প্রথম রাত্রিবাস ছিল সারচুতে। যত দূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত বাদামি রঙের পাহাড়ের মাঝখানে এক নির্জন জায়গা। প্রচণ্ড হাওয়ার দাপট তেমনই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। বিদ্যুৎ আলোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। চারদিকে অসংখ্য তাঁবু। চার্জ কমে যাওয়া চার্জারের আলোয় গা ছমছম পরিবেশে সেই তাঁবুতে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম লেহ্ শহরের উদ্দেশে।
পথের মনোমুগ্ধকর শোভা ভোলার নয়। পাহাড়ের রঙে যে এত বৈচিত্র্য আছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। গৈরিক, কমলা, হলুদ, বাদামি, লালচে আরও কত বিচিত্র রং নিয়ে নানান ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের গায়ে হওয়া দাগ কেটে তৈরি করেছে নানা রূপ। এতদিন ছবিতে নানা রঙের পাহাড় দেখেছি, লাদাখে এসে তা চাক্ষুষ হল। লেহ্ শহর যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
পরের দিন সকালে বেরলাম লেহ্ ভ্রমণে। প্রথমেই হেমিস গুম্ফা। তারপর ১২তলা বিশিষ্ট থিকসে গুম্ফা। সেখানে পদ্মাসনে বসা ২৫ ফুট উঁচু বৌদ্ধ মূর্তিটি এক কথায় অনবদ্য। সেখান থেকে ৪ কিমি দূরে শ্যে প্রাসাদ। শিল্প সুষমামণ্ডিত প্রাসাদের অসাধারণ কারুকাজ মন ভরিয়ে দিল। প্রাসাদের অদূরেই দেখা গেল সিন্ধুনদ। তখন সন্ধ্যা নামছে। সূর্যাস্তের রঙিন আভা ছড়িয়ে পড়েছে সিন্ধু নদের জলে। গোধূলির নরম স্নিগ্ধ রক্তিম আলোর সঙ্গে মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত নদের জল। মনটাও যেন রঙিন হল। ভারী মনোরম সে দৃশ্য।
পরের দিন যার জন্য আসা, লাদাখের সেই রোমাঞ্চ নিবিড়ভাবে উপভোগ করার জন্য লেহ্ থেকে মোটরবাইক ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম খারদুংলার উদ্দেশে। লেহ্ শহরের বিভিন্ন জায়গায় মোটরবাইক ভাড়া পাওয়া যায় খারদুংলা যাওয়ার জন্য। উচ্চতা ১৮৩৮০ ফুট। বেশ বিপদসঙ্কুল পথ। এই পথে যেতে গেলে অবশ্যই লেহ্ শহরের ডিসি অফিস থেকে অভ্যন্তরীণ পারমিট করিয়ে নিতে হবে। অনলাইনও আবেদন করা যায়।
শুরু হল আমাদের রোমাঞ্চকর পথ চলা। একপাশে উঁচু পাহাড়, আর অন্যপাশে অন্তহীন খাদ। একটু অসাবধান হলেই মৃত্যু অনিবার্য। চলতে চলতে মনে হল কোনও এক কল্পনার রাজ্যে এসে পড়েছি। আকাশচুম্বী ধূসর পর্বতমালা। খাড়াই ঢাল। কোথাও বরফের চাদরে ঢেকে যাওয়া বিস্তৃত পাহাড়। আবার কখনও বা সুনীল আকাশে ভেসে থাকা সাদা মেঘের ভেলা। এ যেন প্রকৃতির অপার মহিমা। হৃদয় এবং আত্মায় প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম। চলতে চলতে মনে হল এবার বুঝি আকাশকেই ছুঁয়ে ফেলব। যতই উপরে উঠছি বাতাস ততই শীতল থেকে শীতলতর হচ্ছে। ক্রমশ অক্সিজেনের অভাব বোধ হতে থাকল। সঙ্গের অক্সিজেনের ক্যান থেকে অক্সিজেন টেনে আবার উঠতে শুরু করলাম। আর তার খানিক বাদেই শুরু হল গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারপাত। চারদিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড়গুলো বরফের আকার নিয়েছে। মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। মনোমুগ্ধকর মায়াময় পাহাড়ের সেই রূপ ভোলার নয়। অবশেষে সমস্ত ভয় জয় করে পৌঁছলাম খারদুংলা। অপার্থিব আনন্দে মন ভরে গেল। কোনও শৃঙ্গ জয়ের আনন্দের চেয়ে এই জয় কোনও অংশে কম মনে হল না। কনকনে ঠান্ডা বাতাসের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশিক্ষণ উপভোগ করা গেল না। সামনেই ক্যাফেটেরিয়া। কফির অর্ডার দিয়ে ভেতরে বসলাম। হাড়ে যেন কাঁপন লাগছিল। কফির উষ্ণতা আর ধূমায়িত ম্যাগি খেয়ে খানিক গরম হল শরীর। সেনাবাহিনীর আতিথেয়তা ও সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়েছি গোটা পথ। একরাশ ভালোলাগা, বিস্ময় আর চমক নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
কীভাবে যাবেন: দিল্লি থেকে বিমানে লেহ্ যাওয়া যায়। সড়কপথে মানালি হয়ে বা কাশ্মীর পৌঁছে শ্রীনগর থেকে যাওয়া যায়।