গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
বয়স শুধু থাবা বসিয়েছে মুখের চামড়ায়। তবে সতেজ গলাটা শুনে বেশ বোঝা যায় তাঁর প্রতিবাদের ঝাঁজ কেমন ছিল। সেই ঝাঁজে মিইয়ে গিয়েছিল গোটা গ্রাম। একদিন ‘ডাইনি’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল যে বধূকে, ঘোমটার আড়ালে চোখের জল ফেলে বসে থাকেনি সে। ছেলেমেয়ে নিয়ে গাছের তলায় রাত্রিযাপনেও ভয় পায়নি। কারণ একটা জিনিস খুব ভালো জানত সে, ভয় পেলে বেঁচে থাকাটা সম্ভব হবে না। ছেলেদের মুখে খাবার জোগাড়ও হবে না। তাই শোক করার সময় তার হাতে ছিল না। শহরের এক পড়ন্ত বিকেলে চেয়ারে বসে অতীতের দিনগুলো ফিরে দেখছিলেন ঝাড়খণ্ডের পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত লড়াকু সমাজ-সংস্কারক ছুটনি মাহাতো। বয়স এখন ৬৫-৬৬। শরীর ঋজু। মুখে আলগা হাসি, প্রত্যয়ের।
ছুটনি তাঁর কাজের পুরস্কার (দ্য সোশিওফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস) নিতে এসেছিলেন কলকাতা শহরে। উদ্যোক্তা সাবরি হেল্পেজ। সংস্থার তরফে আরতি সিং বলেন, ‘এ সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জন্য ছুটনি মাহাতোর মতো অসংখ্য মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তাঁদের সম্মান জানাতে চেয়েছি আমরা।’
গ্রামেগঞ্জে বধূদের ডাইনি অপবাদে মেরে ফেলা অথবা সমাজচ্যুত করার খবর প্রায়শই চোখে পড়ে খবরের কাগজে। এই যুগে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার গল্পের পাশেই এই খবরগুলোও থাকে। যা জানান দেয়, ভারতের এই বাস্তবটা এখনও জ্বলন্ত। এভাবেই একদিন ছুটনিকেও বেছে নেওয়া হয়েছিল। ডাইনি অপবাদ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
হঠাৎ করে এসে কেউ বলল, ছুটনি ডাইনি, আর সবাই মেনে নিল? দৃপ্ত গলা বলে উঠল, ‘কেন নেবে না ম্যাডাম? আমি তো ছেলেদের স্কুলে পড়াতে পাঠাচ্ছিলাম। আত্মীয়-প্রতিবেশীর ছেলেরা গোরু ছাগল চরাচ্ছে। কেন ভালো লাগবে কারও? সম্পত্তির কারণও ছিল। আমার স্বামী ছিল এক ছেলে। শ্বশুরের পরে তো সব সম্পত্তি সে পেত। সেটাও কারও ভালো লাগেনি নিশ্চয়ই। প্রথমেই বের করে দেয়নি। আগে মারধর করত। বেশ কয়েকদিন। কত দিন মার খাব? সহ্য করতে পারিনি। বেরিয়েই এসেছিলাম। এখনও সেই সংসারের বাইরে।’ বিয়ের বারো বছর পর শ্বশুরবাড়ি থেকে গলাধাক্কা। অপবাদ। শ্বশুরবাড়িতে মহিলারাই নির্যাতন চালাত। মানসিক, শারীরিক দুই-ই। টানা আট মাস গাছের তলায় দিন কাটিয়েছেন। কী কী সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন? ‘কোথায় আর যাব? খাওয়াদাওয়া দিত বড় বোন। ওর ছেলেপুলে নেই। খেতিবাড়ি করে যেটুকু চাল ডাল ঘরে থাকত, গোড়ার দিকে স্বামী এসে দিয়ে যেত। এইভাবে চলত। দুঃখ ধরে রেখে কী করব বলুন? একবছর লেগে গেল আবার ঘর বানাতে। এক ছেলে তখন তিন বছরের। সেই ছেলেকে বিএড পড়িয়েছি। জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কুড়োতাম। বেচতাম। একটা সংস্থায় এক হাজার টাকা দিত। সেটা ১৯৯৭ সাল। ঝাড়খণ্ডে এখন আমায় সবাই জানে-মানে। ৩২ বছর হল শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছি। আমি যা সহ্য করেছি, সে জিনিস কোনও মেয়েকে যেন করতে না হয়। কেউ কারও নয় ম্যাডাম। ওই দুঃখ আমি জানি। তাই ওই দুঃখের ভাগ নিতে চাই। ডাইনি অপবাদ, বধূ-নির্যাতন যাই ঘটুক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেয়েদের পাশে আছি।’ সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নিপীড়িতা মেয়েদের সমর্থনে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যই বছর তিনেক আগে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছিলেন। গোটা দেশ ছুটনিকে চিনে নিয়েছিল তখনই। ঝাড়খণ্ড পেরিয়ে লড়াই তাহলে গোটা দেশে ছড়িয়েছে? ‘২০০১ সাল থেকে কাজ করছি। কত মেয়ে আসে। এখন তো হাইলাইটে চলে এসেছি! সব কাগজ পড়ে। আমার কথা জানায়। বলে ওর কাছে যাও, সাহায্য পাবে। কারও ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। কারও মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে...।’ তবে সব দিক খতিয়ে দেখে পা ফেলেন সতর্ক ছুটনি। নির্যাতিতা হলেও তাঁদের আধার বা ভোটার কার্ড চেয়ে নেন। কে কে আছে পরিবারে, সব তথ্য জেনে নেন। না হলে তাঁরও বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। ছুটনির কথায়, ‘আমি তো ধরুন ওই মেয়ের জন্য কেস করলাম, থানা পুলিস করলাম। তারপর শ্বশুরবাড়ির চাপে বা অন্য কিছুর জন্য সে বলে দিল আমি তো ছুটনির কাছে যাইনি! তখন আমি কী করব? আমি বিপদে পড়ব কেন?’
একা একা কাজ করছেন বহু দিন। প্রয়োজনে মেয়েদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে দ্বিধা করেন না ছুটনি। ‘কেউ বলে মাথা ব্যথা, কেউ বলে পেট ব্যথা। ডাইনি বলে দেয় কোনও বাড়ির বউকে। তার ছেলেমেয়ের কী অবস্থা হবে ভাবুন। মা ডাইনি! এটা কেউ মানতে পারে? বীরবাস গ্রামে (ঝাড়খণ্ড) ছুটনির অফিসে ন্যায় মিলবে, পড়শি রাজ্যের অনেকেও এখন জানে এ কথা,’ একতোড়ে বলে যান ষাটোর্ধ্বা।
যারা ডাইনি অপবাদ দিয়েছে বা নির্যাতন করছে— দু’পক্ষকেই তিনি ডেকে পাঠান অফিসে। দু’পক্ষের বক্তব্য শোনেন। তারপর রেকর্ড করে রাখেন সব। ছেলেরা সাহায্য করে কাজে। প্রয়োজনে কোর্টকাছাড়ি বা থানাকেও জানান। তারপর কি পরিবার মেনে নেয় সব? ছুটনি বলেন, ‘না অত সহজে মিলমিশ হয় না। কিন্তু আমার কথা শুনে মেয়েটার উপর অত্যাচার ওরা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। কোনও পরিবার হয়তো বলে মেয়েটা ডাইনি, ওকে ছোঁব না। আমি বলি ছুঁও না, ওকে ঘাঁটাবেও না। ও ওর মতো থাকবে, তোমরা তোমাদের মতো। তবে ডাইনি আর কখনও বলবে না। আমার অফিসে নিপীড়িতা অনেক মেয়ে তিন-ছ’মাস থাকে। সাহস দেওয়ার চেষ্টা করি। আশপাশের সবাই এসব দেখে আর বলে ওই দেখো ডাইনির অফিস!’ বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়েন ছুটনি!
পেরিয়েছে ৩২টা বছর এভাবেই। এসেছে আত্মবিশ্বাস। নিজেকে যুক্ত করেছেন ‘ফ্রি লিগাল এইড কমিটি’-র সঙ্গে। ছেলে বউ মেয়ে নাতি নাতনি সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার সাহস ও শিক্ষা এখন থেকেই দিচ্ছেন তিনি। বয়স হচ্ছে। তাঁর পরের প্রজন্মকেও তো জানতে হবে, কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ছুটনির কথায়, ‘আমি মরে গেলে কাজটা তো থেমে যাবে না। ওদের বলি শিখে নাও, নির্যাতিতা কেউ এলে কীভাবে কথা বলবে, কী বলবে, ওদের কীভাবে সম্মান করবে, সব কিছু। ওটাই ট্রেনিং। কেউ বিচার চাইতে এলে তাড়িয়ে দিও না। কাল আমিও তো অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন আলো এসেছে। কিন্তু তার জন্য গর্ব কোরো না।’ শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পেরিয়েছে ৩২টা বছর এভাবেই। এসেছে আত্মবিশ্বাস। ছুটনির এক ছেলে প্যারা টিচার, আর এক ছেলে চাকরি করেন। এ শহরে ২০ বছরের নাতি সুরয মাহাতো এসেছিল সঙ্গে। ছোট থেকে দাদির কাজ দেখে দেখে বড় হয়েছেন এই তরুণ। কোর্টেও গিয়েছেন। তখনও দাদির এত পরিচিতি ছিল না। এখন আবেদন কীভাবে লিখবেন নির্যাতিতা, সেখানে কী কী অভিযোগ জানাবেন ইত্যাদি সব শিখিয়ে দেন তাঁরাই। এরপর উকিল আসেন দাদির ডাকে। উকিলের পরামর্শমতো কাজ এগয়। নির্যাতিতাকে আশ্রয় দিয়ে তার প্রতি সহানুভূতি দেখানো, এসবেই এখন দড় সুরযরা। যে মহিলার উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে, তাঁর বাড়ির লোকও আদালতের নির্দেশ মানতে বাধ্য হন, জানালেন তিনি। মেয়েটি যদি এরপরেও অত্যাচারিত হয়, বা তাঁকে মেরে ফেলা হয় কিংবা তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, অভিযোগ থেকে রেহাই নেই বাড়ির লোকের। তাই বাড়ির লোক সতর্ক থাকেন। সেভাবেই ‘লিখাপড়ি’ হয়, বললেন ছুটনির নাতি।
ওড়িশা, হাজারিবাগ, চাতরা, পশ্চিমবঙ্গের মালদহের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছেন সুরযরা।
কাউকে ‘ডাইনি’ বলে দেগে দেওয়া হয় কীভাবে? সুরয জানালেন, ‘ধরুন কোনও বাড়ির বউয়ের অনেকদিন বাচ্চা হয়নি। এদিকে তার ননদের বাচ্চা আছে, সেই বাচ্চার হয়তো কঠিন রোগ। তখন তার জন্য সে দায়ী করবে বাড়ির বউকে। ননদই বলবে বউদির বাচ্চা নেই, আমার বাচ্চা নেবে বলে এসেছে, ও ডাইনি। এইভাবে সবাই বলে। কারও চোখ কটা বা খয়েরি চুল থাকলে, ছ’টা আঙুল থাকলে অনেকে বলে দেয় সে ডাইনি। মূলত বাড়ির বউরাই লক্ষ্য। আর দেখুন, ডাইনি না থাকলে ওঝাদের রোজগার তো মার খাবে। তাই ভগবান যেমন আছে, ডাইনিও আছে— গ্রামের লোক এটাই
মানে!’
যে বাড়ি থেকে একদিন দাদিকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, সেই বাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে আর? ‘অনুষ্ঠান পরবে যাওয়া-আসা আছে। এখনকার কেউ তো দায়ী নয়। জমিবাড়ি আমরা কিছু পাইনি। সব নিয়ে নিয়েছিল।’
এর মধ্যেই দাদি চলে আসেন একগাল হাসি নিয়ে। বলেন, ‘চলো চলো অনেক কথা হয়েছে। আর কাজ নেই!’ ছুটনি ছুট দিলেন পলকেই।