গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
শৈলী দাস, একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা বরাবরই অবহেলিত এবং বঞ্চিত। ঘরে ও বাইরে তাঁদের অবদান খুব কম লোকই স্বীকার করতে চান। একজন গৃহবধূ তাঁর সারাটা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রান্না করেন, ঘর গোছান, কাপড় কাচেন, স্বামী সহ অন্যান্যদের সেবা করেন, সন্তানপালন করেন এবং একটা সুখের সংসার গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি কি তাঁর এই গৃহশ্রমের কোনও কদর পান? তিনি কি এর বিনিময় কোনও পারিশ্রমিক পান বা উল্টে কি কেউ তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করেন? উত্তর, না। কোনও চাকুরিরতা মহিলা যদি অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, তখন কি কেউ তাকে বলে, ‘তুমি বিশ্রাম নাও, আমি সংসারের কাজ করে দিচ্ছি?’ উত্তর, না। আসলে মহিলাদের গৃহশ্রমকে শ্রম বলেই মানা হয় না। এখনও সংসারের যাবতীয় কাজকে মেয়েলি বলা হয় এবং খুব সহজ বলে ভাবা হয়। অনেকেই ভাবেন যে মহিলারা গৃহশ্রম করতেই পৃথিবী এসেছেন, তাই আলাদা করে তাঁদের গৃহশ্রমের কোনও কদর করার দরকার নেই।
তাপস মুখোপাধ্যায় , শিক্ষক
ঘরে হাড়ভাঙা পরিশ্রমকে আদতে কেউ আজও ‘পরিশ্রম’ বলেই স্বীকার করে না। কথায় কথায় তাই ‘তোমরা করোটা কী সারাদিন ধরে?’— এই শুনতে শুনতেই জীবন কেটে যায় অধিকাংশ মহিলার। চাকরিতে যেমন পদোন্নতি আছে, মাইনে বাড়ে, একটা দাম দেওয়া হয় পরিশ্রমের। মেয়েরা তো তার কিছুই পান না। তাঁদের প্রোমোশন নেই, মাইনে নেই। তাঁরা বিনা বাক্যব্যয়ে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করে যান আজীবন ধরে। চাকরিজীবীরা তো কাজ করে কিছু পাওয়ার আশায়। আর মহিলারা বছরের পর বছর সংসারের কাজ করেন বিনা চাহিদায়। তাঁদের এই পরিশ্রমকে যদি একটু সম্মান দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো তাঁদের মনের নরম মাটিতে ফুল ফোটে।
দিব্যেন্দু রায়, অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী
অতীতের একান্নবর্তী পরিবারের দিন আজও মনে পড়ে। মা, ঠাকুরমা, বৌদিরা সংসারের জন্য হাড়ভাঙা খাটনি খাটতেন, শুনতেন প্রত্যেকের নানা অভিযোগ। সব দায়িত্ব পালন করতেন হাসিমুখে। শ্রমদানের কোনও নির্দিষ্ট সময় ছিল না। সব কাজ সেরে পরিবারের সকলকে খাইয়ে দিয়ে মা যখন নিজে শেষে খেতে বসতেন, তখন বাটিতে হয়তো পড়ে থাকত ছোট্ট একটা মাছের টুকরো। কেউ কোনওদিন খোঁজ নিয়ে দেখেছে? সময় বদলেছে। এখন নিউক্লিয়ার পরিবারই বেশি। সন্তানের লেখাপড়া, সংসারের যাবতীয় কাজ অনেক গৃহকর্ত্রীকেই একা করতে হয়। আজ কর্পোরেট গৃহকর্তা অফিস বা বাড়িতে বসে ল্যাপটপ খুলে টার্গেট-ফেলিওর নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সংসারে সময় দেন না। কোথাও খুঁত পেলে অপবাদ দেন। ফলে মহিলাদের গৃহশ্রমের কদর নেই।
নীলেশ নন্দী, লেখক
ছোটবেলা থেকেই মহিলারা শিক্ষা পেয়ে এসেছেন বিয়ের পর গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ তাঁদেরই সামলাতে হবে। ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব, সবই তাঁরা পালন করবেন। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের এমন অনেক কাজ করতে হবে, যা কেবলমাত্র তাঁদের জন্যই নির্ধারিত। এর পিছনে অবশ্যই পুঁজিবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা রয়েছে। মহিলাদের এই গৃহশ্রমের কদর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্বশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ির লোকেরা করেন না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের উপর দৈনন্দিন নিপীড়ন বাড়তেই থাকে। কারণ, মহিলাদের গার্হস্থ্য কাজের অংশগুলি এখনও পর্যন্ত সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়।
কৃষ্ণা মাইতি, দশম শ্রেণির ছাত্রী
এটা সত্যিই যে মহিলাদের গৃহশ্রমের কদর নেই। আমি নিজেই মাকে সারাদিন বাড়ির কাজ করার পর বাইরের কাজ সামলাতে দেখেছি, তারপরেও দিনের শেষে মাকে শুনতে হয়েছে ‘সারাদিনে করছটা কী?’ মায়ের কিছু করতে ইচ্ছে করে না এমন নয়, যখন এত কিছু করার পর তার পরিশ্রমের কেউ মূল্য বোঝে না সেখানেই সবথেকে কষ্ট হয়। মা সকালবেলা উঠে আমাদের জন্য জলখাবার করে বাড়িতে টিউশন পড়ান, তারপর সকলের জন্য রান্না করেন, বাচ্চাদের স্কুলের জন্য তৈরি করেন, নিজে তৈরি হয়ে স্কুলে যান। তারপর স্কুল থেকে এসে বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে বিকেলে টিউশন পড়ান, আবার সন্ধেবেলা ঠাকুর পুজো করে আবার একটা টিউশন ব্যাচ পড়ান। এত কাজের পরেও বাবা বাড়ি ফিরে এসে যদি বলেন কী করছেন তিনি সারাদিন, তাহলে বলুন কত খারাপ লাগে একটা মানুষের! সত্যিই এ সমাজে বিশেষ করে গ্রামের দিকে এমন পরিস্থিতি এখনও রয়েছে।
বিপক্ষে
সুমন দে, কেন্দ্র সরকারি কর্মচারী
দেশ থেকে ভূমি সবই মাতৃরূপে পূজা করে ভারতীয়রা। ভারতীয়দের পারিবারিক সংস্কৃতিতে মহিলাদের স্থান সবসময় আগে। অতীত থেকেই সংসারের সব সিদ্ধান্ত মহিলারা নিয়ে আসছেন। আমার মতে, দেশে নব্বই শতাংশ পরিবারে স্বামীর উপার্জিত টাকার আশি শতাংশ স্ত্রীর হাতে দেওয়া হয় সংসারের খরচ চালানো ও সঞ্চয়ের জন্যে। সন্তান কোন স্কুলে পড়বে, কী খাবার খাবে, কার সঙ্গে মিশবে, বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রী নির্বাচন সব কিছু বাড়ির মহিলারা নির্ধারণ করেন। অধিকাংশ পুরুষ চাকরিজীবী মহলে নিজের স্ত্রীকে ‘হোম মিনিস্টার’ বলেন। মহিলারা গৃহশ্রমের মাধ্যমে পরিবার নামক রাষ্ট্রের মূল কাণ্ডারী। ফলে ‘মহিলাদের গৃহশ্রমের কোনও কদর নেই’ যুক্তিটার গ্রহণযোগ্যতা নেই।
দেবাজীব সরকার, বেসরকারি চাকুরে, অ্যাকাউন্ট্যান্ট
একজন মহিলা যখন নিজের সংসারের জন্য শ্রম দেন, তার কদর তিনি পান পরিবারের অন্যান্যদের তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসায়। তাঁর শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিক না পেলেও পরিবারের অন্যান্যদের কাছ থেকে তিনি সম্মান অর্জন করেন। একজন মহিলার গৃহশ্রমকে যদি আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করে তার কদর আছে কি নেই সেই প্রশ্ন তুলি, তাহলে একজন পুরুষ, যে তাঁর পরিবারের জন্য বাজার বা অন্য কোনও কাজ করছে, তখন সেই কাজগুলোর জন্যও সেই পুরুষের পারিশ্রমিক পাওয়া উচিত।
নরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কবি ও লেখক, পুরুলিয়া
একটা কথা আছে ‘আমি নারী আমি সব পারি’। সংসারের চুল বাঁধা থেকে রান্না করা, সব মহিলারা করেন। গৃহশ্রমের কদর নিশ্চয় আছে। তাই বর্তমান স্বামী সোশ্যাল মিডিয়াতে যা-ই বলুন, আড়ালে মহিলাদের গৃহকর্মের সুনামই করেন। মহিলারা আজ সব দিকে এগিয়ে। মহিলাদের গৃহকর্মের সাফল্যের কথা বিভিন্ন রিয়্যালিটি শো-তে ধরা পড়ে। আমি একজন অবিবাহিত পুরুষ হয়েও মহিলাদের পক্ষেই বলছি।
সুপ্রিয়া সেন, প্রাক্তন শিক্ষিকা
সূর্যোদয় না হলে পৃথিবী অন্ধকার, তেমনই মহিলা ছাড়া সংসার অচল। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নীরবে, নিঃশব্দে চলছে তাঁদের কাজ। বাড়ির সদস্যরা সম্পূর্ণ নিরাপদ, নিশ্চিত, নির্ভরশীল এই মাতৃরূপিণী দশভুজার উপর। সময় বদলেছে, মহিলারা গৃহশ্রম শেষে বাহির জগতে প্রবেশ করছে। একদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি দু’টি ছেলে গল্প করছে তাদের মায়েরা কোন অফিসে চাকরি করেন, কীভাবে যান, তাদের গর্ব মা কত কাজ করেন! আমার মনের চোখ দিয়ে দেখলাম কত আনন্দ, সুখ, শ্রদ্ধা নিবেদন করছে
মায়ের প্রতি তাদের আলাপনে। কে বলে মহিলাদের গৃহশ্রমের কদর নেই! মুখে বলতে না পারলেও মনে সযত্নে রোপণ করা আছে।
দেবাশিস ভট্টাচার্য, রাজ্য সরকারি কর্মচারী
এখন মহিলাদের অনেকেই বাইরে কর্মরত। তবু তাঁরা সময় বাঁচিয়ে সংসারে শ্রম দেন। আর যে মহিলারা চাকরি করেন না, তাঁরা তো পুরো সময়টাই সংসারে দেন। আধুনিকতার যুগেও মায়েদের গৃহশ্রমের বিকল্প নেই। প্রতিটি সংসারের উন্নতির পিছনে আছে একজন মহিলার অক্লান্ত পরিশ্রম। তাই কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখায় নারীর মূল্যকে জলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ সহজলভ্য হলেও জল ছাড়া জীবন বিপন্ন। তাই যতদিন পৃথিবী থাকবে, ততদিন আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে তাঁদের জন্য আসন পাতা থাকবে।